সংবাদ শিরোনাম
দোয়ারাবাজারে পুলিশের অভিযানে ভারতীয় ৭১ টি গরুসহ চোরাকারবারি আটক  » «   হুমায়ুন রশিদ চত্বরে চাদাঁবাজ সন্ত্রাসীদের কাছে জিম্মি অটোরিক্সা চালক শ্রমিকরা-অভিযোগ  » «   ১ মন গাঁজাসহ সিলেটের ৩ কারবারি নবীগঞ্জে আটক  » «   প্রবীণের বুদ্ধি নবীনের শক্তির সমন্বয়ে সমাজের অন্যায় অবিচার দূর করতে হবে-জেলা প্রশাসক শেখ রাসেল হাসান  » «   জৈন্তাপুরে কর্মরত সাংবাদিকদের সাথে জৈন্তাপুর মডেল থানা পুলিশের মাসিক প্রেস-ব্রিফিং  » «   গোয়াইনঘাটে পানিতে পড়ে শিশুর মৃত্যু  » «   যাদুকাটায় নৌকা ডুবে পাথর শ্রমিকের মৃত্যু  » «   দোয়ারাবাজারে অবৈধ ভাবে বসত ঘরসহ দোকান পার্ট নির্মান ও রাস্তার গাছ কাটার অভিযোগ  » «   সিলেটে জন্ম নিবন্ধন করাতে গিয়ে বিপাকে পড়ছেন অভিভাবকরা  » «   সিলেটে তালামীযে ইসলামিয়ার মীলাদুন্নবী (সা.) র‍্যালি অনুষ্ঠিত  » «   দক্ষ জনশক্তি দেশ বিদেশের শ্রমবাজারে অবদান রাখবে-শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি  » «   খালেদা জিয়ার মুক্তি ও বিদেশযাত্রা নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে-নাসিম হোসাইন  » «   দোয়ারাবাজারে ভারতীয় চিনিসহ আটক ২    » «   দোয়ারাবাজারে চোরাইপথে আসা ভারতীয় ৩৬ গরুসহ আটক ৮  » «   চুনারুঘাটে বানের পানির মত আসছে বিভিন্ন প্রকার মাদক  » «  

মেয়েটি কেন স্কুল কক্ষে ঘুমায়?

8শেখ তাসলিমা মুন::একজন শিক্ষিকা স্কুল কক্ষে ঘুমিয়ে ভাইরাল হয়েছেন। সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে আমিও দেখেছি সে ছবি। একজন চেয়ারম্যান ছবি তুলে মহানায়ক হয়েছেন। আমরা মেয়েটির টেবিলে মাথা দিয়ে ঘুমানোর ছবি দেখেছি। এলোমেলো হয়ে গেছে তাঁর শাড়ির আচল। পরিশ্রমী শরীরের ক্লান্তি পাহাড় হয়ে স্তূপীকৃত হয়েছে। আর আমাদের লজ্জা।

আমার ছোটবেলার কথা মনে পড়লো। আমার মা একজন শিক্ষক। সারা বছর পেটের পীড়া ছিল আমার মা’র। আলসার। আর ছিল ব্রংকাইটিজ। সংসারের একা অভিভাবক হিসেবে আর সব কাজও তাকে করতে হতো। জমিজমার মামলা চালাতে তাকে দূর শহরে মামলার তারিখে যোগদান করতে হতো। স্কুল থেকে ফরমালি ছুটি মিলতো না। আমার মা শিক্ষক হিসেবে ভাল ছিলেন। বেশির ভাগ সময়ে পেটে পীড়ার জন্য তিনি ক্লান্তিবোধ করতেন। শিক্ষক রুমে এসে ধুঁকতেন তিনি। আমি তাঁর ক্লাসেরই ছাত্রী ছিলাম। অনুভুতিটা প্রকাশ করার নয়।

মা ক্লাসের ভাল ছাত্রছাত্রীকে ক্লাসের দায়িত্ব দিয়ে যেতেন কিছুক্ষণের জন্য। বলে যেতেন ‘কেউ যদি গোলমাল করে নাম লিখে রাখবি। আমি এসে হাইবেঞ্চে দাঁড় করিয়ে রাখবো সারাদিন।’ আমার মা কড়া শিক্ষক হিসেবে নাম করেছিলেন। যার উপরে দায়িত্ব দিয়ে যেতেন, কিছুক্ষণের জন্য শিক্ষক হতে পেরে সে সাত আসমানে থাকতো। তাকে ‘স্যার’ ‘স্যার’ ক্ষ্যাপানো হতো পরে। কিন্তু ক্লাসে কারও কিছু বলার ক্ষমতা ছিল না। মা পনেরো মিনিট শিক্ষক রুমে চিড়ের সাথে লেবু চটকে খেয়ে আবার ক্লাসের হাল ধরতেন। আমার খুব ইচ্ছে হতো আমি একদিন ক্লাসের দায়িত্ব পাই! মা আমাকে দায়িত্ব দিতেন না। হয়তো তিনি মনে করতেন তাতে ‘স্বজনপ্রীতি’ হইতে পারে।

তবে সে দুঃখ ঘুচতে বেশিদিন লাগেনি। আমি যখন এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে বসে আছি। আমার মনে দুঃখ অনেকবার ঘুচিয়েছেন তিনি। পেটের ব্যথায় ছটফট করেছেন তিনি। আমি তাঁর ক্লাস নিতে স্কুলে ছুটতাম। মার কলিগরা এ বিষয়ে কোন প্রতিবাদ করেননি। আমি আমার মার ক্লাস নিতাম। স্যাররা কী কী ক্লাস নিতে হবে, কোন কোন ক্লাস নিতে হবে লিস্ট ধরিয়ে দিতেন। বিষয়টি বেআইনি। আমার শিক্ষক ছাড়প্ত্র নেই। আমি আমার মার ক্লাস নিতাম।

যখন হাই স্কুলে পড়তাম তখন আমাদের একজন আপামনি ছিলেন। তাঁর ছোট্ট একটি বাচ্চা ছিল। বাচ্চাটি দুধ খেতো। আপামনি আমাদের বাঙলা পড়াতেন। ক্লাসের মাঝখানে তাঁর ব্লাউজ ভিজে উঠতো। বুকে পেইন করতো। ব্যথায় আপামনির মুখ বেঁকে যেতো। তাঁর বাচ্চার খাবারের সময় হয়েছে। তিনি ছটফট করছেন। তাঁর ছুটি ছিল না। টিফিনে তিনি দৌড়ুতেন। শুধু বাচ্চাকে স্তন্য দেবার জন্য নয়। রান্না করতেন পরিবারের জন্য। একটি ভাত একটি তরকারি নামিয়ে এক মুঠো গরম ভাত গরম তরকারি মুখে ফেলে মুখ পুড়িয়ে আবার স্কুলে ছুটতেন। শিক্ষক রুমে এসে ঢুলতেন। পরের ক্লাসে এসে আমাদের লিখতে দিতেন। আমরা লিখতে শুরু করেছি, আপামনি নাক ডাকা শুরু করেছেন। সারারাত ঘুমাননি। সংসারের সকল কাজ নিজ হাতে। ছোট বাচ্চাকে স্তন্য দেওয়া। নিজের ঠিকমত খাওয়া না হওয়া। চেয়ারে বসামাত্র তাঁর চোখ বন্ধ হয়ে আসে এমনিতেই।

আমি পাটিগণিত পারতাম না। আমাদের দিদিমনি আমাকে বললেন, তুই আমার বাসায় বিকেলে আসিস, কদিন দেখিয়ে দেবো। দিদিমণি একা একটি বাড়ির চিলেকোঠায় থাকেন। তিনি স্কুলের চাকরি করতে এসেছেন দূর গ্রামে সংসার ফেলে। সেখানে তাঁর সন্তান স্বামী সংসার। সপ্তাহে একদিন বাড়ি যান। এখানে চিলেকোঠায় একটি কেরোসিনের স্টোভে আলু-ভাত সেদ্ধ করে খান। আর ক্লাসে যান। আমি যথারীতি অংক বুঝতে গেলাম। গিয়ে দেখি দরোজাটা ভেজানো কিন্তু সামান্য ফাঁক। ভেতরে উচ্চকণ্ঠে বচসা চলছে।
এখন ভেতরে প্রবেশ করা সম্ভব নয় সেটা ভেতর থেকেই বুঝতে পারলাম। কী করবো বুঝে উঠতে পারছি না। একজন পুরুষ কন্ঠ জোরে জোরে বলছে, ‘এভাবে সম্ভব নয়। ঘর-সংসার ভাসিয়ে তুমি এখানে বসে চাকরি করবা এটা সম্ভব না। যথেষ্ট হয়েছে। হয় চাকরি করো, না হয় আমাদের ছাড়ো’! দিদিমনির আকুল কন্ঠ। ‘এতো ভাল চাকরি আমি আর কোথাও পাবো না। এখানে কিছুদিন করলে আমি কাছাকাছি কোন স্কুলে ঢুকতে পারবো।’ হঠাৎ দুম দুম করে শব্দ শুনলাম। দিদিমণি শিশুর মতো কঁকিয়ে উঠলেন। আমাদের এ দিদিমণি খুব ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন দিদিমণি। তিনি বেশি কথা বলেন না। কথা বলেন গুছিয়ে। হাতের লেখা ঝকঝকে। খুব কম হাসেন। কিন্তু হাসলে তাঁর সমস্ত মুখখানি স্বর্গীয় হয়ে ওঠে। আমি ভূতে পাওয়া মানুষের মত দৌড়ে পালিয়ে এলাম।

যে পুরুষ স্কুল কক্ষে গিয়ে একজন শিক্ষিকার ঘুমন্ত শরীরের ছবি তুলে সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল করলেন, তাঁর কাছে প্রশ্ন, তিনি তাঁর বাড়িতে কি কি দায়িত্ব পালন করেন? সন্তানের জন্য রাত জাগেন? শিশুকে স্তন্য দেন? বাড়িশুদ্ধ মানুষের জন্য রেঁধে বেড়ে কাজে আসেন? ঘর বাড়ি ঝাড় দিয়ে সকলের দুপুরের রান্না ঢাকা দিয়ে অফিসে যান? এ শিক্ষিকা কিন্তু এর সব করেন।

আমাদের সমাজে একজন নারী কিভাবে চাকরি করে খান তা সর্বনিম্ন থেকে সর্ব উচ্চ স্তরের নারীর কাছে জিজ্ঞেস করুন। জানুন তাদের অবস্থা। কতটা মুল্য দিয়ে তাদের কাজ করে খেতে হয়। ঘরে বাইরে ২৪ ঘণ্টা খেতে তাদের অফিসের কাজ করতে হয়। পুরুষেরা পায়ের উপর পা তুলে সেই স্ত্রীর দেওয়া হট পট খুলে আলু পটলের দোলমা আর মুর্গির ঠ্যাং দিয়ে লাঞ্চ সারেন।

দেশ থেকে মাঝে মাঝে বড় সরকারি কর্মকর্তারা এখানে ট্রেইনিং এ আসেন। কারো কারো সাথে আমার দেখা হয়। একবার ফরেন মিনিস্ট্রিতে কাজ করা একজন নারী আমার বাসায় একদিন ছিলেন। অনেক কথা হলো তাঁর সাথে। স্বামীও সরকারি চাকুরিতে। দুজনের র‍্যাংকও কাছাকাছি।

ওই নারী বললেন, অফিস থেকে ফেরার পথে গাড়ি থেকেই টেলিফোনে শুরু হয়। কাজের খালাকে ইন্সট্রাকশন দেওয়া চলতে থাকে সারা পথ। পিঁয়াজ হয়েছে? রসুন? আদা বাটা কমপ্লিট? জিরা? মাছ ধুয়েছো? এভাবে তিনি যখন কড়া নাড়েন তখন সব কমপ্লিট। উনি শাড়িটা নামিয়ে রেখে কিচেনে ঢুকে যান। ঝপাঝপ রান্না বসিয়ে দেন। ‘সাহেব’ চলে আসবেন। তিনি আর সব পারেন ‘বুয়া’র হাতের রান্না খেতে পারেন না।
এ লেখা লিখতে গেলে অনেকগুলো এপিসোড লিখতে হবে। কুলিয়ে উঠতে পারবো না। আর কত হিউমিলিয়েশনের
শিকার করবেন আপনারা একজন নারীকে?

সেই কতকাল ধরে মেয়েদের হাউজহোল্ড কাজের ওয়েজের হিসেবের কথাটি বিশ্ব নারী কনভেনশনগুলো বলে আসছে। এক চিমটি গুরুত্বও দেওয়া হয়েছে সে কথার? একটি মেয়ে আপনাদের রান্নাবান্না করে, হাগুমুতু কাঁথা কম্বল ধুয়ে, না খেয়ে ছুটতে ছুটতে এসে ক্লাসে বসেন।

তাঁর কাজের পরিবেশ তৈরি করার জন্য কোন কাজ আপনারা করেছেন? একটি নারীর মাতৃত্বকালীন ছুটির বিষয়ে কোনো গুরুত্ব দিয়েছেন? একজন প্রসূতির স্বাস্থ্যসেবার কথা ভেবেছেন? না। কিন্তু তাঁর ক্লান্ত শরীরের ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় ছবি দিয়ে সেটি ভাইরাল করতে আপনাদের লজ্জা হয়নি। কী মনে হয় আপনাদের? একবারও ভেবেছেন এই ক্লান্ত শরীরটি কেন টেবিলের উপর নুয়ে পড়েছে? তার পেছনের কারনগুলো কি?

ধিক! ধিক এ বিবেকহীন সমাজকে!

সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়াার করুন

সর্বশেষ সংবাদ

Developed by:

.