সিলেটপোস্ট রিপোর্ট::নির্বাচন সামনে রেখে নড়েচড়ে বসেছে সব দল * তিক্ততা কমছে বড় দুই দলে
মনে রেখে সরগরম হয়ে উঠছে রাজনীতির মাঠ। নড়েচড়ে বসছে ছোট-বড় সব রাজনৈতিক দল। নিজ নিজ কৌশলে ঘর গোছানোর পাশাপাশি জোর প্রস্তুতি চলছে ভোটযুদ্ধের। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিএনপিসহ অন্য দলগুলো প্রার্থী বাছাই, ইশতেহার তৈরিসহ নির্বাচনের আনুষঙ্গিক কাজ এরই মধ্যে শুরু করেছে। নির্বাচনের হাওয়া কেন্দ্র থেকে শুরু করে তৃণমূলেও লেগেছে। বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের মধ্যেও আগামী নির্বাচন নিয়ে চলছে নানামুখী আলোচনা।
এছাড়া রোডম্যাপ ঘোষণার মধ্য দিয়ে নির্বাচন কমিশনও (ইসি) জাতীয় নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করেছে। নিরপেক্ষতা প্রমাণে নানা উদ্যোগ নিয়েছে ইসি। এরই অংশ হিসেবে রাজনৈতিক দল ও বিভিন্ন পেশার প্রতিনিধিদের সঙ্গে একাধিক সংলাপ করেছে ইসি। সব মিলিয়ে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে নির্বাচনী ডামাডোল বাজতে শুরু করেছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
তাদের মতে, নির্বাচন ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে কমতে শুরু করেছে বড় দুই দলের রাজনৈতিক তিক্ততাও। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতারা কাদা ছোড়াছুড়ি ছেড়ে ইতিবাচক বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন। সর্বশেষ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিএনপিকে সমাবেশের অনুমতি রাজনৈতিক অঙ্গনে সুবাতাসের ইঙ্গিত।
এছাড়া আদালতে দেয়া বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বক্তব্য খুবই ইতিবাচক। প্রতিহিংসা নয়, দেশের উন্নয়নে একসঙ্গে কাজ করার আহ্বান ও বঙ্গবন্ধুসহ জাতীয় নেতাদের নিয়েও তার (খালেদা জিয়া) ইতিবাচক মন্তব্য প্রশংসাযোগ্য বলেও মন্তব্য করছেন বিশ্লেষকরা।
সরকারও তাদের কঠোর অবস্থান থেকে ধীরে ধীরে সরে আসছে বলেও মন্তব্য করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। কারণ হিসেবে তারা বলেন, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনে কক্সবাজার যান। ফেনীতে বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা ঘটলেও প্রশাসনের পক্ষ থেকে তার সফরে কোনো ধরনের বাধা দেয়া হয়নি। বরং খালেদা জিয়ার নিরাপত্তায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বেশ সতর্ক ও তৎপর দেখা গেছে। শুধু তা-ই নয়, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের অনেক স্থানে বিএনপি নেতাকর্মীরা ব্যাপক শোডাউন করলেও প্রশাসনের পক্ষ থেকে বাধা দেয়া হয়নি।
উল্টো শান্তিপূর্ণভাবে কর্মসূচি পালনে তারা সহায়তা করেছে। সরকারের ইতিবাচক মনোভাবের কারণেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এমন আচরণ করে। সর্বশেষ ৭ নভেম্বর উপলক্ষে সোহরাওয়ার্দীর সমাবেশ নিয়ে শুরু থেকেই ইতিবাচক ছিল সরকার। সিপিএ সম্মেলনের কারণে ৮ নভেম্বর সমাবেশের অনুমতি দেয়া সম্ভব নয়- আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এমন মনোভাব জানার পর বিএনপি সমাবেশের দিনক্ষণ পিছিয়ে দেয়।
১২ নভেম্বর তারা সমাবেশের অনুমতি চাওয়ার পরই ইতিবাচক মনোভাব দেখান পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। সরকারের শীর্ষপর্যায় থেকে ‘সবুজ সংকেত’ পাওয়ার পর বিএনপিকে মৌখিকভাবে অনুমতি দেয়া হয়। আজ চিঠির মাধ্যমে তা জানিয়ে দেয়ার কথা। দীর্ঘদিন পর ঢাকায় বড় ধরনের সমাবেশের অনুমতি দেয়ার বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ। এর মধ্য দিয়ে রাজনীতিতে ইতিবাচক ধারার সৃষ্টি হবে বলে প্রত্যাশা তাদের।
এদিকে ক্ষমতাসীন দলের ইতিবাচক মনোভাবের পাশাপাশি মাঠের বিরোধী দলের কর্মকাণ্ডেও একই মনোভাব লক্ষ করা যাচ্ছে। নিরাপত্তার অজুহাত দেখিয়ে ৭ নভেম্বর শেরেবাংলা নগরে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মাজারে শ্রদ্ধা জানানোর অনুমতি দেয়নি সরকার। কিন্তু তারপরও বিএনপির পক্ষ থেকে কড়া প্রতিবাদ বা কোনো কর্মসূচি দেয়া হয়নি। আপাতত রাজপথে জ্বালাও-পোড়াওসহ কোনো ধরনের সংঘাতে জড়াতে চায় না দলটি।
সোহরাওয়ার্দীতে বিএনপির সমাবেশের মৌখিক অনুমতি পাওয়ার পরই বৃহস্পতিবার আদালতে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বক্তব্য ছিল অনেকটা ইতিবাচক। তিনি (খালেদা জিয়া) বলেছেন, ‘মতবৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য ও সমন্বয়ই হচ্ছে গণতান্ত্রিক সমাজের সৌন্দর্য। ভিন্নমত দলন ও দমন নয়, প্রতিশোধ ও প্রতিহিংসা নয়, বরং ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধা ও সহ-অবস্থানকে উৎসাহিত না করলে গণতন্ত্র টেকানো যায় না। আমি পরিষ্কার ভাষায় ঘোষণা করি যে, আমার এবং শহীদ জিয়াউর রহমানসহ আমার পরিবারের অন্যান্য সদস্যের বিরুদ্ধে শেখ হাসিনার ক্রমাগত অশোভন উক্তি এবং প্রতিহিংসামূলক বৈরী আচরণ সত্ত্বেও আমি ব্যক্তিগতভাবে তাকে ক্ষমা করে দিচ্ছি। আমি তার প্রতি কোনো প্রতিহিংসাপরায়ণ আচরণ করব না।’
খালেদা জিয়ার বক্তব্য ও সোহরাওয়ার্দীতে বিএনপির সমাবেশের অনুমতির বিষয়টি সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদারও ইতিবাচক বলে মনে করছেন। যুগান্তরকে তিনি বলেন, তবে দুই দলের মধ্যে আপাতত সমঝোতার কোনো লক্ষণ নেই। এজন্য আরও অপেক্ষা করতে হবে। দুই দল তিক্ততা ভুলে ইতিবাচক রাজনীতির ধারায় ফিরে আসবে বলে প্রত্যাশা তার।
এক প্রশ্নের জবাবে বদিউল আলম বলেন, কিছুটা অনিশ্চয়তা থাকলেও আগামী নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দল ও সাধারণ মানুষের মধ্যে নির্বাচন নিয়ে ব্যাপক আগ্রহ লক্ষ করা যাচ্ছে। নির্বাচনী মাঠ সরগরম হতে শুরু করছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। কারণ আমাদের দেশের মানুষ নির্বাচনকে একটা উৎসব মনে করে।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আগামী সিটি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনীতির মাঠ সরগরম হবে। তবে ওই নির্বাচন কতটা শান্তিপূর্ণ হবে, তা নির্ভর করবে সরকারের ইচ্ছার ওপর। সিটি নির্বাচন সরকারের জন্য অগ্নিপরীক্ষা। এ নির্বাচনের প্রভাব আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে বলে মনে করেন এ রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
নির্বাচনী তোড়জোড় ও সাম্প্রতিক দুই দলের শীর্ষপর্যায়ের নেতাদের বক্তব্যকে ইতিবাচক বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন। তিনি যুগান্তরকে বলেন, অবশ্যই এটি গণতন্ত্রের জন্য ভালো। এর মধ্য দিয়ে ২০১৪ সালের পর দেশে যে গুমোট পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, তা কিছুটা হালকা হবে। দুই দলের মধ্যে বরফ গলার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। উচ্চবাচ্য না করেও আভাস পাওয়া যাচ্ছে কোথাও কোনো সমঝোতা হচ্ছে বা হতে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, বড় দুই দলের মধ্যে সমঝোতা আগামী নির্বাচনে ব্যাপক প্রভাব পড়বে। নির্বাচনটা উৎসবমুখর হবে। নির্বাচনের এখনও অনেক সময় বাকি। তবুও রাজনৈতিক দল ও সাধারণ মানুষের মধ্যে এ নিয়ে ব্যাপক আগ্রহ লক্ষ করা যাচ্ছে।
সূত্র জানায়, নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনৈতিক দলগুলো নানা সমীকরণ মেলাতে শুরু করেছে। রাজনৈতিক দলের পাশাপাশি সব শ্রেণী-পেশার মানুষ মনে করে, নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে সৃষ্ট সংকটের সমাধানের মধ্য দিয়ে আগামীতে সব দল মিলে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হবে। ক্ষমতাসীন দলের হাইকমান্ডের বক্তব্যেও তেমন ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। আওয়ামী লীগের কাউন্সিলসহ বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠানে দলটির সভাপতি শেখ হাসিনা নেতাকর্মীদের উদ্দেশে বলেছেন, আগামী নির্বাচন হবে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ। দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও বারবার বলছেন, বিএনপি আগামী নির্বাচনে আসবে এবং একটি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন হবে।
সর্বশেষ শুক্রবার রাজধানীতে এক অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘বিএনপিকে আহ্বান করলেও তারা নির্বাচনে আসবে, না করলেও নির্বাচনে আসবে। নির্বাচনে তারা আসবেই। তাদের নেতারাই বলেছেন তারা নির্বাচনে আসবেন। কাজেই এখানে আহ্বানের তো কোনো প্রয়োজন নেই।’ তিনি বলেন, ‘আমরা চাই, প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক একটি নির্বাচন হোক। বিএনপি একটা বড় দল। তারা অংশ নিলে নির্বাচনটা প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হবে। সেজন্য আমরা চাই, বিএনপি নির্বাচনে আসুক।
বিএনপিকে সমাবেশের অনুমতি প্রসঙ্গে ওবায়দুল কাদের বলেন, বিএনপি সমাবেশের অনুমতি চেয়েছে। অনুমতি দেয়ার ব্যাপারে কোনো বাধা কখনও ছিল না। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, অনুমতি নিয়ে এখন পর্যন্ত তাদের এমন একটি জনসভাও হয়নি, যেখানে কোনো বিশৃঙ্খলা হয়নি। এ বিশৃঙ্খলাগুলো ভয় পাই বলেই আমরা বিষয়টা নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত ছিলাম। আমরা সব সময় অনুমতি দিতে চাই। তারা একটি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল, তাদের অবশ্যই সভা-সমাবেশ করার অধিকার রয়েছে। শেখ হাসিনা সরকার কতটা গণতান্ত্রিক, এই অনুমতি দিয়ে আবারও তা প্রমাণিত হল।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর যুগান্তরকে বলেন, আমরা বারবার বলে আসছি, সংঘাত চাই না। গণতান্ত্রিক অধিকারগুলো পালনে সরকারের কাছে দাবি জানিয়ে আসছি। কিন্তু সরকার আমাদের ন্যূনতম সাংবিধানিক অধিকার পালন করতে দিচ্ছে না। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিএনপির সমাবেশের অনুমতির মাধ্যমে তাদের শুভবুদ্ধির উদয় হয়েছে। আশা করি, সমাবেশ সফল ও আগামীতে গণতান্ত্রিক কর্মসূচি পালনে সরকার সার্বিক সহযোগিতা করবে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিএনপি নির্বাচনমুখী দল। আমরা নির্বাচনের মাধ্যমেই ক্ষমতার পালাবদলে বিশ্বাসী। তবে সেই নির্বাচন অবশ্যই গ্রহণযোগ্য ও সব দলের অংশগ্রহণে হতে হবে। আমরা সে দাবিই জানিয়ে আসছি। বিএনপি নির্বাচনের জন্য সব সময় প্রস্তুত আছে।
এদিকে নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনৈতিক দলগুলো নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে। বিএনপি ও আওয়ামী লীগ তাদের মিত্র বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে। ক্ষমতাসীনরা দলীয় ও প্রশাসনিকভাবে প্রার্থী বাছাইয়ের কাজ শুরু করেছে। সারা দেশে সিনিয়র নেতারা তৃণমূলকে চাঙ্গা করতে সফরে যাচ্ছেন। বিএনপিও গোপনে প্রার্থীদের ব্যাপারে খোঁজখবর নিচ্ছে। সংগ্রহ করছে তাদের নানা তথ্য। পাশাপাশি তৃণমূলকে চাঙ্গা ও উজ্জীবিত করতে দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বিভাগীয় সফরে বের হচ্ছেন। রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শনে কক্সবাজার গেলেও পুরো সফরেই ছিল নির্বাচনী আমেজ। সম্ভাব্য প্রার্থীরা তাদের সমর্থকদের নিয়ে ব্যাপক শোডাউন করেন। ভোটের চিন্তা মাথায় রেখে মিত্র বাড়ানোর পথে হাঁটছে সব দলই। জোট ভাঙছে। আবার নতুন জোট হচ্ছে। নানা কারণে দীর্ঘদিন দূরে থাকা নেতাদের দলে টানা হচ্ছে। ধর্মভিত্তিক রাজনীতির দিকেও ঝুঁকতে দেখা যাচ্ছে বড় রাজনৈতিক দলগুলোকে।
বড় দলের পাশাপাশি নির্বাচনকে ঘিরে ছোট ছোট দলও নানা তৎপরতা শুরু করেছে। চলছে তৃতীয় জোট গঠনের তোড়জোড়। জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনুর বক্তব্য ও আওয়ামী লীগ নেতাদের পাল্টা বক্তব্যের নেপথ্যে রয়েছে নির্বাচন প্রসঙ্গ।
শুধু কেন্দ্রে নয়, তৃণমূলও রাজনীতির উত্তাপ ছড়াচ্ছে। রাজনৈতিক দলের তৃণমূল নেতারা আগামী নির্বাচন নিয়ে নানা পরিকল্পনা করছেন। সাধারণ ভোটারদের দলীয় প্রার্থীর পক্ষে কাজ করাতে এখন থেকেই অনেকে মাঠে নেমে পড়েছেন। পাড়া-মহল্লায়ও আলোচনায় স্থান পাচ্ছে আগামী নির্বাচন। চায়ের দোকানেও জমে উঠছে নির্বাচনী আড্ডা।