সিলেটপোস্ট রিপোর্ট::‘আব্বুই আম্মুকে মেরেছে। আম্মু ঘুম থেকে উঠে দাঁড়িয়েছিল। আব্বু দোলনার লাঠি এনে আম্মুর কপালে ঠাস করে বাড়ি মারে। সঙ্গে সঙ্গে আম্মু ফ্লোরে পড়ে যায়।
এভাবেই সোমবার রাজধানীর কমলাপুরে নানার বাসায় বাবার হাতে মায়ের হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা দেয় উদীচীকর্মী লোদমিনা আহমেদ লিজার ছোটসন্তান শাম্যু (৬)।
তবে শাম্যু তখনও জানে না, তার মা লিজা আর বেঁচে নেই। রোববার সকালে স্বামী এসএম সাজ্জাদের পিটুনিতে নির্মমভাবে মৃত্যু হয়েছে লিজার (৪১)। সোমবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) মর্গে তার লাশের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়েছে। লিজার স্বামী এসএম সাজ্জাদকে পুলিশ গ্রেফতারের পর আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠিয়েছে।
লোদমিনা আহমেদ লিজা ও এসএম সাজ্জাদ দু’জনেই ছিলেন উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর সক্রিয় কর্মী। সেখানেই দু’জনের ভালোলাগা, প্রেম; অতঃপর বিয়ে। ১৩ বছরের দাম্পত্য জীবনে তাদের রয়েছে ফুটফুটে দুটি
ছেলেসন্তান। ১২ বছরের ছেলে সাওম মানিকনগর মডেল স্কুল থেকে পিইসি পরীক্ষা দিয়েছে। ছোট ছেলে শাম্যু ক্লাস ওয়ানে পড়ে। সাজানো এমন একটি সংসারে কেন নির্মমভাবে মৃত্যু হল উদীচীকর্মী লিজার। এর কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে বেরিয়ে এসেছে অভাব-অনটন, অবিশ্বাসসহ নানা কারণ। লিজার স্বামী সাজ্জাদ পুলিশ এবং আদালতের কাছে একই স্বীকারোক্তি দিয়েছেন।
লিজার ছোট বোন লিয়া বলেন, এসএম সাজ্জাদ সব সময় লিজাকে সন্দেহের চোখে দেখত। তাকে মানসিক ও শারীরিকভাবে নির্যাতন করত। এ নিয়ে তাদের মধ্যে দীর্ঘদিন দাম্পত্য কলহ চলছিল। লিজাকে কেউ ফোন করলে কে করল? কেন করল? এসব জানতে চেয়ে ঝগড়া বাধাত। লিজা মুখ বুজে সাজ্জাদের এসব নির্যাতন সহ্য করত। রোববার সকালে লিজাকে পিটিয়ে হত্যা করে সাজ্জাদ।
লিজার ফুফু হাসিনা সুলতানা বলেন, সাজ্জাদ লিজাকে এতটাই সন্দেহ করত যে আমিও যদি তাকে ফোন করেছি, তবে কেন ফোন করলাম এ নিয়ে সে লিজার সঙ্গে ঝগড়া করত। তিনি বলেন, লিজার বড় ছেলে সাওমকে আমি জিজ্ঞেস করলাম, কিরে তোদের বাসায় কী হয়েছিল। জবাবে সাওম বলে- ওই যে, জানো না।
আব্বু আম্মুকে খালি খালি সন্দেহ করে। সাওম ঘটনার সময় তার দাদির বাসায় ছিল।
লিজার বাবা ইকবাল আহমেদ বলেন, রোববার সকালে সাজ্জাদ ফোন করে জানাল আপনার মেয়ে আত্মহত্যা করেছে। তাকে মুগদা জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে এসেছি।
এদিকে মুগদা হাসপাতালে গিয়ে সংশ্লিষ্টদের সাজ্জাদ জানিয়েছে, লিজা বাথরুমে পড়ে গিয়ে মাথায় আঘাত পেয়েছে। অপরদিকে সাজ্জাদের ছোট বোন রেশমা জানিয়েছে, তাকে সাজ্জাদ বলেছে- রাগ করে একটা থাপ্পর দিয়েছিলাম।
এ কারণে লিজা অজ্ঞান হয়ে গেছে। তিনি বলেন, পরে সাজ্জাদ পুলিশের কাছে স্বীকার করেছে সেই লিজাকে হত্যা করেছে। তিনি বলেন, সংসারে যাতে অশান্তি না থাকে সেজন্য আমি একটি দোকান ঠিক করে দিয়েছি। লিজা দোকান থেকে চাল-ডালসহ সম্পূর্ণ জিনিসপত্র নিত। আমি খরচ বহন করতাম। এরপরও আমার মেয়ের ওপর নির্যাতন চালাত সাজ্জাদ। আমি আমার মেয়ে হত্যার বিচার চাই।
লিজার ভগ্নিপতি মৃদুল জানান, লিজা, লিয়া এমনকি তাদের বাবা-মা সবাই উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর সঙ্গে জড়িত। সাজ্জাদও উদীচী করতেন।
তিনি একটি বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি করতেন। এরপর সেই চাকরি ছেড়ে বিনিয়োগ করেন ডেসটিনিতে। আত্মীয়-স্বজনদেরও অনেক অর্থকড়ি নেন ডেসটিনির জন্য। এদিকে ডেসটিনি বন্ধ হয়ে গেলে সাজ্জাদ বেকার এবং ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ে। আর তখন থেকেই সংসারে ঝগড়াঝাটি আর অবিশ্বাস বাড়তে থাকে।
এদিকে মুগদা থানার এসআই হাসানুজ্জামান বলেন, লিজা হত্যাকাণ্ডের প্রত্যক্ষ সাক্ষী শিশুপুত্র শাম্যু। তিনি বলেন, শাম্যুর দেখানো মতে সাজ্জাদের মানিকনগরের ভাড়া বাসা থেকে একটি কাঠের লাঠি, রক্তমাখা বালিশ ও বিছানার চাদর জব্দ করা হয়েছে। সোমবার সাজ্জাদ আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
আদালতকে সাজ্জাদ জানিয়েছেন, দাম্পত্য কলহের জেরেই তিনি লিজাকে খুন করেছেন। তাদের মধ্যে অবিশ্বাস এবং সংসারের অনটনই এ খুনের মূল কারণ।
এদিকে সুরতহাল রিপোর্টে পুলিশ উল্লেখ করেছে, লিজার কপালের ডানপাশে চোখের উপরে এক ইঞ্চি লম্বা কাটা জখমের দাগ রয়েছে। রোববার সকাল ৭টায় স্বামী-স্ত্রীর কথাকাটাকাটির একপর্যায়ে কাঠ জাতীয় বস্তু দ্বারা আঘাতে লিজার কপালের ডানপাশে কাটা রক্তাক্ত জখম হয়ে মৃত্যু ঘটে।
সোমবার লিজার মরদেহ আজিমপুর কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে। অপরদিকে উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী মঙ্গলবার লিজা হত্যার প্রতিবাদে এক প্রতিবাদ সভার আয়োজন করেছে।