ফয়ছল আহমদ
মাতৃদুগ্ধ পান করা একটা শিশুর জন্মগত অধিকার। শিশু ে পটে আসার পর থেকে প্রাকৃতিক নিয়মে একজন মায়ের শশীরে নানা পরিবর্তন আসতে থাকে। আর মা আস্তে আস্তে তৈরী হন বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়ানোর জন্যই। প্রকৃতির এ নিয়মকে আমরা কখনো অস্বীকার করতে পারিনা। যেমন করছে না সমস্ত প্রাণীকুল। বাচ্চা জন্মের পর মায়ের দুধ পান করবে- এটাই প্রাকৃতিক নিয়ম। ধর্মীয় দিক দিয়ে চিন্তা করলে দেখা যায়- প্রত্যেক ধর্মেই প্রসব পরবর্তী মায়েদের বিশ্রামের ও বাচ্চাদের দুধ খাওয়ানোর সময় দেয়া আছে।
প্রথমেই বলতে হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ কথাটি যা সবার জানা দরকার। শিশু জন্মের সাথে সাথে ১ঘন্টার মধ্যেই মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানো আর শিশুর বয়স ৬ মাস পূর্ণ হওয়া পর্যন্ত শুধু মাত্র মায়ের বুকের দুধ খাওয়াতে হবে। এমনকি এক ফোঁটা পানিও খাবে না। ৬ মাস পর বুকের দুধের পাশাপাশি ঘরে তৈরী অন্যান্য বাড়তি খাবারও শিশুকে দিতে হবে। শিশুর বয়স ২ বৎসর পর্যন্ত বুকের দুধ পান করা তার জন্মগত অধিকার। এ অধিকার কেঁড়ে নেয়া উচিৎ নয়।
আমরা যারা স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিত সবারই চেষ্টা একটাই মাতৃমৃত্যু ও শিশু মৃত্যু রোধ করা। সম্পূর্ণ রোধ করতে না পারলে হ্রাস করা। সরকারও এ ব্যাপারে বদ্ধ পরিকর। বিভিন্ন স্বস্থ্য কর্মী দিয়ে ব্যাপক প্রচার প্রচারণার উদ্দেশ্য একটাই সুস্থ মা, সুস্থ শিশু, সুস্থ জাতি। সবাইকে অবশ্যই গর্ভকালীন সেবা, গর্ভপরবর্তী সেবা ও প্রসবোত্তর সেবা দিতে হবে। এক্ষেত্রে আমাদের প্রথম ও প্রধান শর্তই হচ্ছে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সেবাদানকারী দ্বারা ডেলিভারী করানো। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সেবাদানকারী দ্বারা ডেলিভারী করানোর ফলে সংক্রমণ প্রতিরোধ, প্রসবকালীন জটিলতা কমানো, সুস্থ বাচ্চার জন্ম, প্রসব পরবর্তী মা যেন আবার সুস্থ, স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারে। দেখাযায় শিশু মৃত্যু বেশি হয় জন্মের পর ১ম ঘন্টায়, ১ম দিনে, ১ম ৭দিনে, ১ম মাসে, ১ম বৎসরে এবং ৫ম বৎসর বয়স পর্যন্ত। তাই খুব সহজ হিসাব- আমরা যদি একজন মা ও তার পরিবারের লোকজনকে সচেতন করে তুলতে পারি। স্বাস্থ্যবিষয়ক পরামর্শ দিয়ে তাহলে অবশ্যই আমরা পারবো শিশু মৃত্যু রোধ করতে।
মায়ের কথা চিন্তা করি- জন্মের সাথে সাথে নবজাতককে মায়ের বুকের দুধ খাওয়ালে ( অবশ্যই বাচ্চা সুস্থ থাকতে হবে) মায়ের গর্ভফুল তাড়াতাড়ি বের হয়, রক্তপাত বন্ধ হয়। যার ফলে প্রসবজনিত রক্তস্বল্পতা কম হয়। শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানোর ফলে মা ও শিশুর মাঝে জন্মের সাথে সাথে একটা নিবিড় সম্পর্ক তৈরী হয়। শিশু পায় নিরাপত্তা- যেমনটি ছিল সে মাতৃগর্ভে। মায়ের বুকের উষ্ণতা প্রত্যেক শিশুর জন্যই জরুরী। প্রসবকালীন এতো কষ্টের পরও শিশুকে বুকের স্মান্মিধ্যে পেয়ে মায়ের মুখে ফুঁটে উঠে তৃপ্তি ও পরিপূর্ণতার হাঁসি- এ দৃশ্য কত মধুর। মা নিজের সব কষ্ট তখন ভুলে যান, চেষ্টা করেন শিশুকে জড়িয়ে ধরতে, কাছে টেনে নিতে। অবশ্যই এব্যাপারে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন পরিবারের কাছের লোকজন ও স্বাস্থ্য কর্মীরা।
এখন আসি বাচ্চা জন্মের পরপরই প্রথম দুধ বা শালদুধ প্রসঙ্গে। এটা হালকা হলুদ বর্ণের, আঠালো এবং পরিমাণে খুব কম। এখন হয়তোবা আপনি চিন্তা করতে পারেন এটুকু দুধ দিয়ে বাচ্চাকে কিভাবে বাঁচাবো? কিন্তু জেনে রাখা ভাল, জন্মের পর থেকে প্রথম ২দিন পর্যন্ত শিশুর পাকস্থলির আকার থাকে একটা ছোট মার্বেলের মতো। এজন্য প্রথম ২দিন ১চা চামচ বা ৫/৭ এমএল শালদুধ হলেই যথেষ্ট। পরবর্তীতে ভালভাবে দুধ আসার জন্য শিশুর জন্মের প্রথম দিন অন্তত ৮/১২ বার অবস্থান ও সংস্থাপন ঠিক রেখে মায়ের দুধ খাওয়াতে হবে। এখন নিশ্চয়ই প্রশ্ন জাগতে পারে অবস্থান ও সংস্থাপন কি? এটা হচ্ছে বাচ্চাকে কিভাবে কোন অবস্থানে ধরে রেখে কি করে বুকের দুধ খাওয়াতে হবে । মনে রাখবেন আপনার শিশুর জীবনের প্রথম ঠিকা হচ্ছে শালদুধ যা আপনার শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।
অনেক কুসংস্কার আমাদের মধ্যে আছে- যেমন বাচ্চা জন্মের সাথে সাথে মুখে মধু দেয়া, যাতে বাচ্চা ভবিষ্যতে হাসি মুখে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে, মিছরির পানি, চিনির পানি, গ্লুকোজ ইত্যাদি। এগুলো একেবারের দেয়া যাবে না। এতেকরে আপনি নিজেই আপনার বাচ্চার ভবিষ্যতকে হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছেন। বাজারে বিভিন্ন ধরনের গুড়ো দুধ আছে এসব কিছুই বাচ্চার জন্য ক্ষতিকর। বাচ্চাকে ঠিকভাবে ধরে ঠিকমতো বুকের দুধ খাওয়ালে বাচ্চার অন্য কিছুর দরকার নেই। তবে এ ক্ষেত্রে মায়ের ধৈর্য্য অবশ্যই থাকতে হবে- যাতে করে অনেক্ষণ ধরে চেষ্টা করে মা বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়ান। মাকে অবশ্যই পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে ও প্রচুর পরিমাণে পানি পান করতে হবে। একজন মা-ই পারেন তার বাচ্চাকে সুস্থ রাখতে। পরিবারের সবাইকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। শালদুধ-ই হচ্ছে শিশুর জীবনের প্রথম ঠিকা, শালদুধ শিশু জন্মের পর মেকোনিয়মে বা নবজাতকের কালো রংয়ের প্রথম মল বের করে আনতে সাহায্য করে। শিশুদের জন্ডিস প্রতিরোধ করে। শিশুর বিকাশমান মস্তিষ্ক, চক্ষুগঠন ও রক্তনালীর জন্য অত্যাবশ্যকীয় ফ্যাটি এসিড শুধুমাত্র মায়ের দুধেই আছে। অন্যান্য প্রাণীর যেমন- গরু, ছাগলের দুধ কোন অবস্থাতেই দেয়া যাবেনা। এগুলোর ক্ষতিকারক দিকই বেশি। আপনি নিশ্চয়ই চান আপনার বাচ্চার বুদ্ধির বিকাশ ঘটুক, সুস্থ থাকুক, সুন্দরভাবে বেড়ে উঠুক, রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়–ক- তাহলে অবশ্যই বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়ান।
লেখক: ক্লিনিক ম্যানেজার, সূর্যের হাসি ক্লিনিক, সীমান্তিক, দক্ষিণ সুরমা।