সিলেটপোস্ট২৪রিপোর্ট :এতক্ষণ বড়লোকের কুকুরের মত কাঁইকুঁই করছিলেন, আরামে চোখ বোজা ছিল, এখন নাক দিয়ে গরগর শব্দ হচ্ছে, ঠোঁটও ফাঁক হয়ে আছে অল্প একটু। প্রাণহরি নিশ্চিন্ত, তার হাতের যাদু এখনও কতটা কার্যকর মুনশির নিদ্রামগ্ন চেহারার দিকে তাকিয়ে টের পায় সে। প্রথমে কপালের ওপর হালকা আঙুলের কারিকুরি, ধীরে ধীরে দুই ভুরুর সমান্তরালে রেখে দু আঙুল টেনে আনবে দু চোখের কোনায় নাক বরাবর, তখন চোখ বন্ধ হবে, তারপর দু হাতে মাথার চুল মুঠো মুটো ধরে ঝাঁকিয়ে আবার বিলি কেটে দিলে আয়েশে জড়িয়ে আসবে শরীর, এবার গলার পেছন দিক থেকে দু কাঁধে কখনও শক্ত হাতে কখনও একটু হালকা করে আঙুল দিয়ে টিপতে শুরু করলে প্রাণহরির কাছে প্রায় আত্মসমর্পণ করে বসবে লোকটি, নরসুন্দরের কাছে জীবনের ক্লান্তি তুলে দিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুম, ঘুম না হোক একটু তন্দ্রা বা ঘোরের মধ্যে তো পড়বেই।
এই পেশায় তিরিশ বছরেরও বেশি সময় কেটে গেল প্রাণহরির। উপজেলা সদরে এখন আরও কয়েকটা সেলুন ফ্যাশনের কথা বলে, ‘রূপবান হেয়ার কাটিং সেলুনে’ এতসব ফ্যাশনের বাহার নেই, তবে আসল কাজটা আছে, দাড়ি হোক মাপ ঠিক থাকতে হবে, আর হাতের যাদু, দেখি ইয়াং ম্যান দেখাও তো এ রকম একটা খেলা, সেটা তো পারবে না, তোমাদের যা কসরৎ, কাস্টোমারের চোখে ঘুম লাগবে দূরে থাক, উল্টো গা ব্যথার ট্যাবলেট খেতে হবে বাড়ি গিয়ে।
‘নিজে নিজে কি বিড়বিড় কর হরি, মাথা নাড় দেখি, কথা শোনা যায় না? গল্প বলতেছিলে একটা, বন্ধ করলে কেন?’
‘আপনি ঘুমায় পড়লেন দেখে বন্ধ করলাম, ডিস্টাব হবে…’
‘আরে কিসের ডিস্টাব, এ রকম ঘুমের মধ্যে গল্প শুনতে কোন অসুবিধা হয় না আমার, তুমি বল… কী একটা জাহাজের কথা বলছিলে…’
‘হ্যাঁ কর্তা… বৃটিশ সাহেবদের জাহাজ, বন্দরে এ রকম সব সময় থাকতো, তখন তো কম বয়স এই জাহাজ সেই জাহাজে সাহেবদের দাড়ি-মোচ কাটি, ইনকাম ভাল, সাহেবদের কাছে তো টাকা নাই, তারা ডলার দেয়…’
‘এসব কথা একবার বলেছ, আসল জায়গায় আসো।’
‘আসতেছি কর্তা, তো একবার কেপ্টেন বললো, কাল সামকে ওয়াক্ত মুঝে এক পার্টিমে জানা পরে গা। তুম চার বাজকে আ-কর হামকো শেভ করনেকে লিয়ে জাগা দেনা, ঠিক হ্যায়?
‘আমি বললাম, ঠিক হ্যায় স্যার আপাকা মার্জি…’
‘বৃটিশ সাহেব হিন্দি বলে?’
‘বলবে না কর্তা, তারা কি বাংলা জানে?’
ভিসিআরে ইন্ডিয়ার ফিলিম দেখে মাথাটা একেবারে গেছে, মুনশি মনে মনে গাল পাড়ে। শালা বাংলা আর হিন্দি ছাড়া দুনিয়ায় যেন আর কোন ভাষা নেই। বিলেতি সাহেবের মুখে হিন্দি ডায়ালগ লাগিয়ে দিয়েছে। মুখে কিন্তু বলে না, তাতে গল্পের রসটা নষ্ট হয়ে যেতে পারে, ‘তারপর কি হলো, আগাও হরি…’
‘তারপর কর্তা… পরদিন গেলাম, তখন বারোটা কি একটা বাজে, গিয়ে দেখি ডেকের ওপর একটা ইজিচেয়ারে শুয়ে আছেন ক্যাপ্টেন সাহেব, গভীর ঘুম…, খালাসি দু একজন আছে তারা বললো, এখন কাছে-ধারে যেও না সাহেবের ঘুম ভেঙে গেলে কিন্তু খবর আছে…।’
গল্প স্থগিত রেখে এবার সিদ্দিক মুনশির গায়ে জড়িয়ে দেয়া সাদা কাপড়টা খুলে নেয় হরি, তারপর দরজার ওপার গিয়ে কাপড়টা ঝেড়ে কাটা চুলটুল ছড়িয়ে দিয়ে আসে বাইরে। চুলকাটার কাঁচি, দাড়ি কাটার ক্ষুর, ক্রিম লোশনগুলো এবার গুছিয়ে রাখে একপাশে, ‘বেয়াদবি নেবেন না কর্তা’ বলে একটা বিড়ি ধরিয়ে সুখটান দেয়।
সিদ্দিক মুনশিও উঠে দাঁড়িয়ে গায়ের পাঞ্জাবিটা একটু ঝেড়ে নেয় হাত দিয়ে, কানের পাশে চুল কতটা ছাটা হয়েছে পরখ করার জন্য ধরে রেখে, দাঁড়িতে বুলিয়ে নেয় হাতটা, ‘তোমার গল্পটা শেষ হয়নি হরি…’
‘ও হ্যাঁ, গল্প না কর্তা, গল্প কোথায়, এগুলো হল সব অতীত দিনের স্মৃতি’- প্রাণহরির দীর্ঘশ্বাস ছড়ানো কথার মধ্যে যেন একটু পদ্যও শোনা যায়।
‘ওই হলো, তুমি আগাও হরি।’
‘তো খালাসিরা বললো, সাহেবের ঘুম ভাঙলে খবর আছে, আমি মনে মনে বলি, নাপিতের কাজে ঘুম ভাঙলে কিসের নাপিত সে, ঘুম ভাঙলে এই লাইনেই কাজ করব না আর। সাহেবের ঘুমের মধ্যেই গালে লাগিয়ে দিলাম কিরিম, তারপরও দুইবার করে ক্ষুর যখন টানতেছি, তার নাক ডাকা তখন বেড়ে গেছে আরও। শেভ করা শেষ, সাহেব তো আর জানে না, সে সন্ধ্যায় ঘুম থেকে উঠে রেগে আগুন, আমাকে সামনে দেখে বললেন, অ্যাই উল্লুকা পাট্টে, তু মুঝে কিউ নিদসে জায়গা নেহি। মে আভি-পাটিসে ক্যায়সে যাউঙ্গা?
আমি হাসলাম, হেসে তার সামনে ধরলাম আয়নাটা। আয়নায় মুখ দেখে লাল বাঁদরের মুখে হাসি আর ধরে না, বললো, সাবাশ, বহুৎ আচ্ছা কাম কিয়া তুম নে- বলে একটা নোট গুঁজে দিলো আমার হাতের মধ্যে। পরে দেখি বিশ ডলারের নোট, সেসব দিন আর নাই কর্তা।’
‘আমি তো আর ডলার দিতে পারব না হরি, এই নাও…’ বলে পাঁচ টাকার একটা নোট ধরিয়ে দিয়ে বেরিয়ে পড়ে সিদ্দিক মুনশি। নোটটা হাতে নিয়ে মনে মনে গাল পাড়ে প্রাণহরি, ‘শালা, তোমার হিসাব পাক্কা’।
পথে নেমে সিদ্দিক মুনশিও গাল পাড়ে মনে মনে, ‘শালা, দুনিয়ার আজাইরা গল্প সব তোমার কাছে, সেই আমলে বিশ ডলারের নোট, হুঁ বেকুব পেয়েছ আমাকে।’
বেকুব না হলেও প্রাণহরির গল্প যে তাকে টানে সেটা স্বীকার করতে দ্বিধা নেই সিদ্দিক মুনশির, সত্য হোক কি মিথ্যা, কেমন যেন বিশ্বাস-অবিশ্বাসের মাঝখানে দুলতে থাকেন তিনি। সস্তার জন্য তো বটেই, প্রাণহরির এই গল্পের জন্যও তাকে আসতে হয় রূপবান হেয়ার কাটিং সেলুনে।
আগে নাম ছিল ‘প্রাণহরি সেলুন’, প্রাণহরির বাবা ব্রজহরি বাজারের মধ্যে বেড়ার ঘরের সেলুনটি করেছিল ছেলের নামে দিয়ে। তখন উপজেলা হয়নি, এই বাজারটার অবস্থাও এত রঙচঙা হয়ে ওঠেনি, এখন তো এটা গোলাম রসুল মার্কেট। পাকা দোকান সব, সেলুনের এক পাশে স্টার মাইক সার্ভিস, অন্য পাশে মৌসুমী অডিও সেন্টার। বৃদ্ধ ব্রজহরি যে বছর প্রাণহরির হাতে দোকানের ভার তুলে দিয়ে আমৃত্যু শয্যা নিয়েছিল, সে বছরই ‘রূপবান’ ফিলিমটা হিট করেছিল। দোকানের পয়সা চুরি করে শহরে গিয়ে সিনেমা দেখে আসা তখন তো প্রাণহরির প্রাণের টান। তো রূপবান দেখে ফেরার সময় গলায় তুলে তার গানটাও নিয়ে এসেছিল সে গ্রামে। বাপের অসুস্থতার সূত্রে দোকানের মালিকানা পেয়ে একমাত্র পুত্র প্রাণহরির প্রথম কাজ ছিল সাইনবোর্ড থেকে নিজের নাম সরিয়ে রূপবানের নাম তুলে দেয়া। সিনেমার হিরোদের অনুকরণে চুলের টেরি, আর জায়গামত হিট ফিল্মের গান গেয়ে পাড়ায় নারীমহলেও একটা জনপ্রিয়তা পেয়েছিল প্রাণহরি।
কত কিছু গেল এক জীবেনর ওপর। প্রাণহরি তো তবু বুকে পাথর চাপা দিয়ে মানুষজনের মধ্যে হাজার রকমের সত্য-মিথ্যা গল্প কথার ওপর দিন পার করিয়ে দেয়, সরস্বতী শীল তাও পারে না, এখন দেখলে লাগে সত্তর বছরের বুড়ির মত। সবাই বলে গল্প বলে আসর জমাতে পারে প্রাণহরি, সে নিজেও অবশ্য বুঝতে পারে তার কথার মধ্যে সেই যাদু আছে খানিকটা, গল্প শুরু করলে শেষ না শুনে যাওয়ার উপায় থাকে না শ্রোতার। তবে শুধু গল্প বললে তো হয় না, কাকে কোন গল্পটা বলতে হবে, কোন সময় কোনটা জমবে বেশি এটাও জানতে হবে, না জানলে তোমার গল্প তুমি বলে যাবে, যে শোনার তার কানে যাবে অর্ধেক, বাকি অর্ধেক ভেসে যাবে হাওয়ায় বা কোলাহলে।
এই যেমন কয়েকদিন আগে একবার শহর থেকে এক ভদ্রলোক এলেন রোগামত, শেভ করার জন্য বসে পড়েছিলেন রূপবানের রিভলভিং চেয়ারে, গায়ে সাদা কাপড়টা জড়িয়ে দিয়ে প্রাণহরি জিজ্ঞেস করেছিল, আপনি কি স্যার বুদ্ধিজীবী?
ভদ্রলোক চমকে উঠে পাল্টা প্রশ্ন করেছিলেন, ‘কেন বলেন তো?’
‘না আপনার মাথায় হাত দিয়ে দেখলাম তালুটা বেশ গরম। মনে হলো ব্রেইনের কোন কাজ করেন আপনি।’
ভদ্রলোক হেসে ফেলেছিলেন, ‘বুদ্ধিজীবী বললেও বলা যেতে পারে, আমি সাংবাদিক।’
তার চেহারার দিকে তাকিয়ে প্রাণহরি নিশ্চিত হয়েছিল কিছুটা হলেও বিস্মিত হয়েছেন ভদ্রলোক, তখনই একটা গল্প বলার সময় বলে মনে হয়েছে তার এবং এই লোকটাকেই। মুখে ক্রিমের ব্রাশ ঘষতে ঘষতে প্রাণহরির গল্প শুরু হয়েছিল।
‘শহরেই তো থাকেন স্যার নন্দনকানন রথের পুকুর পাড়ে গেছেন কখনও?’
‘জ্বী, অনেকবার, এখনতো পুকুরটা নেই’
‘তুলসী ধামের পাড়াটার নিচে রাস্তার ঠিক উল্টোদিকে একটা সেলুন আছে লক্ষ্য করেছেন?’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ এখনও আছে।’
‘ওই সেলুনটাতে কিছুদিন কাজ করেছি আমি। তখনকার একটা ঘটনা বলি, একদিন এক ভদ্রলোক এসেছেন দাড়ি কামাতে। আমি তার গালে কিরিম লাগিয়েছি, এই আপনার মত আর কি, টিক তখন দোকানের বেঞ্চিতে বসাছিলেন আরেক ভদ্রলোক, তিনি দাড়ি কামাতে আসা লোকটাকে বললেন, আপনি কি দাদা আশুতোষ বাবুর বাড়িতে এসেছেন? লোকটা বললো জ্বী। আচ্ছা আপনি আশুতোষ চৌধুরী নাম শুনেছেন তো স্যার?
‘না’
‘শোনেননি? খুব নামকরা লোক ছিলেন স্যার, লোকগীতি সংগ্রহ করতেন…’
‘ও আচ্ছা, লেখক সুচরিত চৌধুরী পিতা?’
‘হ্যাঁ স্যার, ঠিক চিনেছেন, ওনার বাড়িও নন্দনকানন রথের পুকুর পাড়ে, ওই সেলুন থেকে দেখা যায় রাস্তার ওপারে…’
‘ঠিক আছে, তারপর কি হলো বলেন?’
‘কি বলছিলাম যেন?’
‘বলছিলেন, লোকটা শেভ করতে আসা ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করলেন আপনি কি আশুতোষ বাবুর বাড়িতে এসেছেন?’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, এই প্রশ্ন শুনে ভদ্রলোক বললেন, জ্বী উনার বাড়িতেই এসেছি, কেন বলেন তো? তখন বেঞ্চে বসা ভদ্রলোক জিজ্ঞেস কররেন, আপনি কি কবি জসীমউদ্দীন? তিনি একটু অবাক হয়ে বললেন জ্বী হ্যাঁ আমার নাম জসীমউদ্দীন, ব্যস আর যায় কোথায় ঐ লোকটা বেঞ্চ থেকে লাফ দিয়ে উঠে এক ঝটকায় সরিয়ে দিলেন আমাকে, বললেন, আরে ব্যাটা কবির দাড়ি কাটবি তুই… সর আমাকে দে, এই বলে তিনিই লেগে গেলেন দাড়ি কাটতে…’
‘উনি কি সেলুনের স্টাফ?’
‘আরে না, আমি তো চিনি না তাকে, কতজনই তো আসে দোকানে রেডিওর গান শোনে…’
‘তারপর?’
‘তারপর দাড়ি কাটা হলো, চেয়ার থেকে উঠে জসীমউদ্দীন ওই ভদ্রলোকের কাছে জানতে চাইলেন, আপনার নামটা কি দাদা? বিনয়ের সাথে তিনি জানালেন, আজ্ঞে অধমের নাম রমেশ শীল। শুনে প্রায় চেঁচিয়ে উঠলেন জসীমউদ্দীন, কী নাম বললেন রমেশ শীল!’
‘তারপর স্যার কি বলবো, কবি আর কবিয়ালের সে কী গলাগলি আর কোলাকুলি, এ দৃশ্য নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না।’
ততক্ষণে সাংবাদিক ভদ্রলোকের শেভ করা শেষ, তিনি চিবুকে একবার বুলিযে পকেট থেকে টাকা বের করে দিলেন হরির হাতে। বললেন, ‘আপনার এই গল্প আমার মনে থাকবে অনেকদিন, সত্যি অসাধারণ।’
শহর থেকে আসা সাংবাদিকের চোখে সেদিন যে মুগ্ধতা দেখা গিয়েছিল তার কতটা কাকতালীয় ঘটনাটির জন্য, কতটা কথকের দক্ষতার জন্য, আলাদা করা না গেলেও, নিজের ভূমিকাটা ঠিকই টের পেয়েছিল প্রাণহরি।
এই গল্পটা গ্রামের লোকজনকে শোনালে কোন লাভ হতো না, এর মাজেজা বোঝার মত লোক এ গ্রামে নেই বলেই অনেকদিন সমঝদারের জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে তাকে। তবে কোন কোন গল্প উপযুক্ত পাত্রে পড়েও কেন জানি পাত্তা পায় না, এ নিয়ে দুঃখ বড় কম নেই প্রাণহরির। ইদানিং এই আঘাতটা সবচেয়ে বেশি আসে সরস্বতীর কাছ থেকে। বড় তীব্র ভাষায় তার সবচেয়ে গুণটাকে নিয়েই ঠাট্টা, বিদ্রুপ করতে ছাড়ে না। এই মহিলার চেহারার লাবণ্য হারিয়ে গিয়েছিল অনেকদিন আগে, মুখের কথা ছাদছিরিও গেছে এখন, রেগে গেলে নর্দমার দুর্গন্ধ ছড়ায়। বলা যায় প্রাণহরির কথার যাদুতেই প্রাণ-মন দুইই খুইয়েছিল এক সময়, এখন কথার মধ্যে যাদু ছোঁয়াবে কি, ভাল-মন্দ দু কথা বলারও উপায় নেই, অমনি ফনা তুলে ফোঁস, ‘থাকার মধ্যে তো আছে ঐ চাপাখানা, এসব চাপাবাজি আর যার সাথে খুশি কর, আমাকে ছাড়ো।’
প্রাণহরি সবার সাথে চাপাবাজি করে? দশম শ্রেণী পর্যন্ত বিদ্যা এই শেষ বয়সে স্বামীর প্রতি অশ্রদ্ধা শেখায়? খুবই আঘাত লাগে তার, কিন্তু ছাড়ো বললে স্ত্রীকে তো আর ছাড়তে পারে না, বরং করুণায় মনটা ভিজে ওঠে। অভাব-অনটন তো আছেই, তার ওপর যুদ্ধের সময় জোয়ান ছেলেটার মৃত্যুর শোক এখনও বহন করেই চলেছে সরস্বতী। ঘরে অবিবাহিতা সোমত্থ মেয়ের দুশ্চিন্তার ওপর খড়ার ঘা পড়েছে স্বামী পরিত্যক্তা বড় মেয়েটির বাড়ি ফিরে আসা। এসব দুঃখ কি প্রাণহরিরও নয়, কিন্তু সে তো সব ছেড়ে ঘরে বসে দুর্ভাগ্য কপচাতে পারবে না সারাদিন; বাঁচতে তো হবে, না বেঁচে উপায় আছে?
বাঁচার জন্যও কিছু গল্প লাগে। অনেকে বলে প্রাণহরির গল্পে সত্য-মিথ্যা বোঝা দায়। সে নিজেও কি ছাই জানে কোনটা কতটা বাস্তব আর তার মধ্যে কতটুকু মিশে যায় কল্পনার রং? তবে এটা ঠিক শোনা কথা, দেখা জীবন, বা ভাবনার গল্প অন্যকে বলতে পারলে ভাল লাগে। যাকে যে গল্পটা বলা দরকার, তাকেই সেটা বলতে পাররে কী যে সুখ, আবার সেই মানুষটার কাছে গল্পটার মূল্য না হলে মনে বড় লাগে প্রাণহরির। যেমন গোলাম রসুল মার্কেটের মালিক ইলিয়াস হাজী একবার দু মাসের দোকান ভাড়া বাকি পড়ায় খুব ক্ষেপেছিলেন, প্রাণহরি তাকে ডেকে যত্নআত্তি করে চেয়ারে বসিয়ে গা-মাথার ফ্রি মালিশ দিতে দিতে একটা গল্প শুনিয়েছিল।
‘আনোয়ারার ফেচু মিয়ার নাম শুনেছেন কর্তা?
‘না।’
‘তার এক ছেলে পরে আওয়ামী লীগের এমপি হয়েছিল, নামটা এখন মনে আসছে না।’
‘নাম বাদ দাও, তুমি আসল ঘটনাটা বল।’
‘হ্যাঁ, আসল ঘটনাটাই বলি, আর এই ঘটনায় ছেলের নামের দরকারও নাই। তো ফেচু মিয়া তখন বিরাট জমিদার, আনোয়ারার বলতে গেলে অর্ধেক জমিই তার। খুব মেজাজ গরম মানুষ, ভালর মধ্যে ভাল, খারাপ হলে আর ভাল করার উপায় নাই…।’
‘আসল ঘটনাটা বল।’
‘মন-মেজাজ সম্পর্কে একটু পরিচয় দেওয়ার দরকার আছে, কর্তা।’
‘ঠিক আছে, বল।’
‘তো এই ফেচু মিয়ার দাড়ি কামানোর জন্য প্রতিদিন তার বাড়িতে আসতো এক নাপিত, মনে করেন তার নাম হরেন্দ্র, হরেন্দ্র শীল।’
‘মনে করব কেন, তার আসল নাম কি?’
‘আসল নামটা মনে আসছে না, অনেকদিন আগের কথা তো, তা ছাড়া আমার বয়সটাও কি কম কিছু হয়েছে কর্তা?’
‘আচ্ছা ঠিক আছে, বল।’
‘সেই হরেন্দ্র একদিন চুলে কলপ লাগানোর সময় মনে মনে অনেক সাহস জমা করে ভযে ভয়ে বললো, হুজুর একটা কথা বলবো?’
‘ফেচু মিয়া এমনিতে কথা বলেন কম, বললে মনে হয় বাজ পড়তেছে, বাজখাই গলা, বললেন, কি কথা?’
‘হরেন্দ্র আরও মিনমিনে গলায় বলে, সামনে তো আমাদের পূজা হুজুর, বখশিস দিবেন না?’
‘কী! বলে হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন ফেচু মিয়া সওদাগর, শালা মালাউন পূজার বখশিস চাস আমার কাছে… এত বড় সাহস…!’
‘চিৎকার শুনে আর ফেচু মিয়াকে উঠে দাঁড়াতে দেখে, কি বলবো কর্তা, ভয়ে হরেন্দ্রর পিলা গেছে চমকাইয়া, সে হাতের জিনিস মাটিতে থুয়ে মারছে চোঁ চোঁ দৌড়।’
‘হাঃ হাঃ হাঃ’- গল্পের পাকচক্করে পড়ে এতক্ষণে স্বতঃস্ফূর্ত হাসি বেরিয়ে এল ইলিয়াস হাজীর মুখ থেকে, বললেন, ‘তারপর, তারপর?’
‘দৌড় মানে দৌড়, পাঁচশ গজ দূরে গিয়ে একটা তালগাছের নিচে দাঁড়িয়ে পেছন ফিরে তাকাল হরেন্দ্র, তখনও তার পা দুটো কাঁপছে ভয়ে। ফেচু মিয়া তখন ডাক দিলেন তার নায়েবকে, ধরেন গিয়ে তার নাম রহমত, ডেকে বললেন, রহমত এইখান থেকে ঐ তালগাছ পর্যন্ত জমি হরেন্দ্রর নামে রেজিস্ট্রি করে দিয়ে দাও, এইবার পূজায় তাকে আমি এটা বখশিস দিলাম। যে কথা সেই কাজ, আনোয়ারায় কর্তা এখনও যে শীলপাড়া আছে সেটা সেই হরেন্দ্রকে দেয়া ফেচু মিয়ার জমি। জমিদারের দিল কর্তা দরিয়ার মত…।’
গল্পটার কী অর্থ করলো কে জানে, শেষ হওয়ার সাথে সাথে মুখ গম্ভীর করে ফেলেছিল গোলাম রসুল মার্কেটের মালিক ইলিয়াস হাজী, এক সপ্তাহের মধ্যে দু মাসের দোকান ভাড়া না দিলে যে তিনি আর মায়া দয়া করবেন না একথা জানিযে দিয়ে চলে গিয়েছিলেন বেজার মুখে।
উপজেলা সদরে নতুন কয়েকটা সেলুন হয়েছে। সেখানে চুলের কাটের নতুন নতুন নাম শোনা যায়, চুল কাটার ইলেকট্রিক মেশিনও আছে, সারাদিন গান বাজে ক্যাসেটে, শেভের আগেও ক্রিম, পরেও ক্রিম এতসব ব্যবস্থার সঙ্গে বিগত-যৌবন রূপবান আর কুলিয়ে উঠতে পারে না। ব্রজহরির দোকানে চাকচিক্য এনেছিল প্রাণহরি, আজ বৃদ্ধ প্রাণহরির দোকানে নতুন প্রাণ দেবে কে, ভাল করে গোঁফ গজাবার আগে ছেলেটা দেশ উদ্ধার করে গেল। ‘দেশ উদ্ধার না তোর গুষ্টি উদ্ধার ব্যাটা, এখন দেশ স্বাধীন হয়ে লাভটা হয়েছে কার?’- বুকের ভিতর জমে থাকা দীর্ঘশ্বাস বুক ঠেলে বেরিয়ে আসে।
বড় মেয়েটার বিয়ে হয়েছিল গাজাখোর এক গাড়লের সাথে, ভাদাম্যার গুষ্টি, বিয়ের সময়ের সে টেলিভিশন দিয়েছিল একটা, আর একটা স্টিলের আলামিরা, সেই মেয়েটা যে ফিরে এসেছে হাতে একটা পুটলিও ছিল না। ছোট মেয়েটার মনে হয় আর বিয়ে হবে না, তিরিশের উপর বয়স, আই এ পাস করে প্রাইমারি স্কুলের মাস্টার হয়েছে, মাসের বেতনটা প্রতি মাসে ঠিকমত পায় না, আবার গণ্ডমূর্খ ছেলেকে বিয়েও করতে পারে না, নাপিতের মেয়ের সাথে কি চক্রবর্তী বামুনের বিযে হবে মা, শীলপাড়ায় তুমি মেট্রিক পাসও পাবে না তোমার বিয়েও হবে না।
সস্তার কাস্টমার দিয়ে দোকানটা চলছিল কোন মতে, চলছিল না আসলে, প্রাণহরি টানছিল। কিন্তু এর মধ্যে একদিন হঠাৎ করে কঠিন রোগে পড়ে গেল সে, তাতে চাকাও প্রায় বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল ঘর সংসারের। প্রায় ১৭-১৮ দিন একনাগাড়ে জন্ডিসে ভুগে, ওষুধ পত্তর আর ঘর খরচ চালিয়ে হাতে তো কিছু নেই-ই বাকি-বকেয়ার দোকানেও গিয়ে দাঁড়াবার উপায় নেই। সেই কঠিন সময়ে ডাক্তার বললেন, ‘আরো এক সপ্তাহ ঝাড়া বিশ্রাম লাগবে হরি। ডাক্তারের কথা ডাক্তার বলেছেন, হরি তো জানে বিশ্রামের কথা দূরে, এখন তার মরবার জন্য সময় বের করাও অসম্ভব, সোজা গিয়ে তালা খুলেছিল রূপবানের। দোকানটা একটু ঝাড় দিয়ে, আয়না দুটো ভেজা ন্যাকড়া দিয়ে মুছে, সবে একটা আগরবাতি জ্বেলেছে হরি, অমনি দরজা দিয়ে গলা বাড়ালেন সিদ্দিক মুনশি, ‘বেঁচে আছো তাহলে হরি, আমি তো ভাবলাম খোদা হাফেজ বাংলাদেশ জিন্দাবাদ হয়ে গেছ।’
‘না বেঁচে উপায় আছে কর্তা, চার পাঁচটা পেটের জোগার না দিয়ে মরার উপায়ও তো নেই।’
‘ভাল, ভালই হলো, এত তাড়াতাড়ি তুমি মরলে আমাদের কি হবে, দোকান কি আর নেই, তবে তোমার মত হাতের যাদু আর গল্প কথার রসতো সেখানে পাব না, ছেলে-ছোকরারা সব…।’
অন্য সময় এসব পিঠ চাপড়ানো কথায় পিঠে বড় আনন্দ পায় হরি, আজ ভাল লাগছে না। শরীরটা ভাল নেই বলে সবকিছু তেতো লাগে, আর এ কারণেই হয়তো মুনশির মিঠা কথায় আড়ালের আসল তেতোটা টের পায়, হরি মরলে তো সস্তার চুল দাড়িকাটা আর মিলবে না। তবে কাস্টমারকে চিরকাল ভগবান জেনে এসেছে, মনের কথা চাপা দিয়ে সেবা করেছে সাধ্যমত, আজও তার ব্যতিক্রম করে না সে, ঢোক গিলে তেতোটা চালান করে দেয় ভিতরে, চেয়ারটা মুছে দিয়ে বলে, ‘বসেন কর্তা।’
সাদা কাপড়টা গায়ে জড়িয়ে দিতেই মুনশির শরীর মন যেন আরামের একটা বোধের জন্য প্রস্তুত হয়ে ওঠে, খোশমেজাজে বলে, ‘আজ জবরদস্ত্ একটা গল্প আড়ো হরি, অনেকদিন শুনি না…’
মুনশির মাথায় হাত দিয়ে চুলের দৈর্ঘ্য মেপে নেয় প্রাণহরি, বুঝতে পারে চুলকাটা নয়, আজ হবে শেভ আর গা-মালিশ। চুলের অধিকাংশ ছাই রঙের হয়ে আছে, কিন্তু মুনশি পুরোপুরি সাদা না হলে আর চুল কাটার সময় না হলে কলপ করায় না। তার মানে আজ মাল ছাড়বে কম, তার ওপর আবার খোশগল্পের খায়েশ, অসুস্থ শরীরে কাস্টমারের আজাইরা আব্দার ভাল লাগে না, ‘শরীরটা আজ ভাল না কর্তা।’
‘আরে মিয়া হাসিখুশি থাকলে মন ভাল হবে, মন ভাল হলে শরীরও দেখবে ভাল হয়ে যাবে নিজে নিজেই।’
লেকচার শুনে গা জ্বলে যায় হরির, জন্ডিসটা এখনও পুরোপুরি সারে নি, মাঝে মাঝে চক্কর দিয়ে উঠছে মাথাটা, কথা বলার সময় কানের মধ্যেও কেমন যেন ঝাঁ ঝাঁ শব্দ টের পাচ্ছে, মনে মনে সে শালা সম্বোধন করে মুনশিকে, চেহারায় কিন্তু বিনয় থাকে অক্ষুণ্ন, ‘আজকে না হয় আপনিই একটা গল্প বলেন কর্তা।’
‘আমি? আমার এসব হয়টয় না মিয়া, রসকষ নাই।’
‘চুল তো একেবারে ছাইমাখা হয়ে আছে, কলপ দিবে?’- দু পয়সা বাড়তি উপার্জনের চেষ্টা করে দেখে হরি।
‘না, না আর একটু সাদা হোক।’
মনে মনে আবারও শালা সম্বোধন না করে পারে না সে, তবে অভিব্যক্তি সেই একই বিনয়, ‘হ্যাঁ আপনি তো আবার ছাইমাখা হলে দেন না, আটা মাখা হলে কলপ দেন।’
ঠাট্টায় একটু ঝাঁজ ছিল, সেটা টের পেয়ে বা না পেয়ে হা-হা করে হাসে মুনশি, ‘গল্প বলবে না?’
‘আমি বরং জিজ্ঞাসা করি, আপনি শুধু উত্তর দিয়ে যান, তাহলে হবে…’
গালে ক্রিমের ব্রাশ ঘষতে ঘষতে প্রাণহরি ভাবতে থাকে কি প্রশ্ন দিয়ে শুরু করবে এই গল্প-প্রশ্নের খেলা। তার ভাবনার কূল-কিনারা হওয়ার আগে নিজেই কথা বলে ওঠে মুনশি, ‘আসলে আমার পূর্ব-পুরুষের ইতিহাস বলতে গেলে তা গল্পের চেয়ে বাড়া, আরব থেকে আসছিলেন তেনারা…।’
জমিয়ে গল্প বলা সকলের কাজ নয়, এটা হরি বুঝতে পারে মুনশির বলার ভঙ্গি দেখে, বুঝে ভাল লাগে, নিজের প্রতি কিছুটা শ্রদ্ধাও বাড়ে; ক্রিম লাগানো পুরোপুরি শেষ হওয়ার আগেই মুনশি তার পূর্বপুরুষেরা এসে এই অঞ্চলের জন্য কত সৌভাগ্য বয়ে এনেছে, বংশ পরম্পরায় তাদের পরিবারের দান-ধর্ম জনহিতকর নানা কর্ম যে এখানকার মানুষের কাছে সত্যিকার মূল্য পেল না ইত্যাদি গরগর করে বলে শেষ করে ফেললো, তাতে গল্প তো পাকেই না বরং অপক্ক ফলে কামড় দিয়ে মুখ বিকৃত করার মত কথকের ওপর বিরক্ত হয়ে পড়ে শ্রোতা।
‘যুদ্ধের সময় তো আপনি পিস-কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন, না কর্তা?’
সবে গালের ক্রিমের ওপর ক্ষুর টেনে আনছিল হরি, হঠাৎ অপ্রত্যাশিত প্রশ্ন শুনে মুনশি চমকে কেঁপে উঠলে যা প্রায়ই হয় না হরির হাতে তাই হয়, মুনশির গালে ক্ষুরের আঁচড় থেকে রক্ত বেরিয়ে আসে চিড়িক করে এবং সাদা ক্রিমেও তা লেগে যায় অল্প।
‘উহুঁ হু… সাবধানে, একটু সাবধানে চালাও হরি।’
‘পিস কমিটির চেয়ারম্যান তো ছিলেন আপনি?’
‘জ্বী, আমি ছিলাম বলেই তো পাঞ্জাবিরা এই এলাকায় বড় কোন ক্ষতি করে নাই, অন্যান্য অঞ্চলে…’
‘আপনার বাড়িতে বলে তেনারা ক্যাম্প করছিল একটা…’
‘ক্যাম্প না, ক্যাম্প কি, তারা আসতো মাঝে মাঝে খানাপিনা খেয়ে চলে যেতো, এই এলাকায় কোন ক্ষতি করছে তারা?’
‘আবু মেম্বারের বউরে যে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গেল?
‘সেটা অন্য কেইস, সেটা তুমি বুঝবে না।’
‘তাহলে আমার ছেলেটার কথা বলেন, মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়েছিল ছেলেটা, চিনেন তো আপনি, শশাঙ্ক, সে আগরতলা থেকে এসে একবার আপনার কাছে গিয়েছিল মনে আছে? একটা কার্ডের জন্য, আইডেন্টি কার্ড…’
‘হ্যাঁ দিয়েছিলাম তো, তাকে কার্ড দিয়েছিলাম‒’ কেমন ভীত কিংবা ফ্যাসফ্যাসে শোনায় মুনশির গলা।
‘কিন্তু সে তো ধরা পড়লো পরের দিন, সবাই যে বলে আপনি নাকি ধরিয়ে দিয়েছেন…’
‘মিথ্যা কথা’ ‒ বলে চেঁচিয়ে উঠতে চেয়েছিলেন মুনশি, কিন্তু কেন জানি তার কথাগুলো শব্দ হয়ে বেরিয়ে আসে না মুখ দিয়ে, আর তখনই তার চোখে পড়ে আয়নার দিকে। সেখানে তার গলার কাছে কণ্ঠার ঠিক ওপরটায় ধরা হরির ক্ষুরটা দেখতে পেয়ে মুহূর্তে বিবর্ণ হয়ে পড়ে সে। তাহলে এইভাবে সময়টাকে তৈরি করেছে সে, যুদ্ধে ছেলে হারানোর শোক চিরকালের জন্য ভুলে যাওয়ার জন্য এই ব্যবস্থা তার! চোখের সামনে সব কিছু যেন হঠাৎ ঝাপসা হয়ে যেতে থাকে, নিজেকে সাদা কাফনে জড়ানো একটা মুর্দা বলে মনে হয়। আজরাইলের চেহারা এত নিরীহ হতে পারে আগে তো কখনও মনে হয়নি তার। শুধু মনে পড়ে যুদ্ধের সময় অনেক মৃত্যু দেখেছে সে, তার ইশারায় কত কিছু হয়েছে, ছিটেফোটা রক্তও কিন্তু লাগেনি গায়ে। অবশ্য দেশ স্বাধীনের পর ভয়াবহ দুর্দিন গেছে, ভয়-আতঙ্কের দিন গেছে, কী রকম নির্ঘুম রাত, মৃত্যুর জন্য অপেক্ষার মত রাত…। জীবন-মৃত্যুর এত টানাটানির মধ্যে টিকে থেকেছে তখন… দুঃস্বপ্নের তাড়া খেয়ে খেয়ে বেঁচে এসেছে এতদূর…। এখন সবকিছুই যখন স্বাভাবিক, শুধু স্বাভাবিক কেন বলা যায় সচ্ছন্দ ও নিজের পছন্দমত, তখন সামান্য এক লোকের হাতে… আহ্ এই লোকটা একটা মাত্র পোঁচে শেষ করবে সব, কাটা মুরগির মাটিতে ছটফট করবে মুনশীর দেহ, … আহ্ কী বিভৎস, এই নিরীহ চেহারার লোকটা…
চেয়ারে বসে মৃগীরোগীর মত সিদ্দিক মুনশিকে কাঁপতে দেখে অবাক হয়ে যায় প্রাণহরি, ‘কী হলো কর্তা, শরীর খারাপ লাগছে? পানি খাবেন কর্তা?
হঠাৎ শরীরের সমস্ত শক্তি জড়ো করে এক ধাক্কায় হরির হাতটা সরিয়ে লাফ দিয়ে চেয়ার থেকে নেমে দরজার দিকে ছুটে যান মুনশি। ক্ষুর হাতে হতবিহ্বল হয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকে হরি। ‘কি হলো কর্তা’ ‒ বলে একটু সামনে এগোতেই প্রাণপণে ছুটতে থাকেন মুনশি। বেশ অনেকটা দূরে গিয়ে পিছন ফিরে তাকিয়ে চিৎকার কর বলে, ‘তুই আমার গলা কাটতে চাস হরি?’
প্রাণহরি অবাক, হঠৎ মুনশির এই আচরণের অর্থ বুঝতে পারে না সে। সে চুল-দাড়ি কাটে, এতদিন পর হঠাৎ সিদ্দিক মুনশির গলা কাটতে যাবে কেন? ঘটনার আকস্মিকতা তার অসুস্থ শরীরকে আরও দুর্বল করে দেয়, মাথাটা চক্কর দিযে ওঠে, কানের মধ্যে ঝাঁ ঝাঁ একটা শব্দ টের পায়, ধপ্ করে সে বসে পড়ে বেঞ্চির ওপর, নিজেকে শুনিয়েই যেন বিড় বিড় করে তারপর, ‘গলা কাটবো কেন, গলা কাটতে পারলে কী এতদিন রূপবান সেলুন নিয়ে পড়ে আছি কর্তা?’