গত ৩০ ডিসেম্বর’১৫ সারাদেশে ২৩৪টি পৌরসভার নির্বাচন হয়ে গেল। এবারের নির্বাচনের বিশেষত্ব ছিল বিরোধীদল বিশেষ করে বিএনপিও নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল। তাদের দাবি ছিল গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতেই মূলত: এ নির্বাচনে অংশ গ্রহণ এবং পাশাপাশি সরকার বিরোধী আন্দোলনকে বেগবান করারও একটি অন্যতম বিষয় হিসেবে দেখেছিল। যদিও আস্থা এবং বিশ্বাসের বিষয়টিকে প্রশ্নবোধক রেখেই সঠিকভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ বিরোধী দলের গণতন্ত্রায়নের পথে একটি অঙ্গিকারও বটে। নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে বিরোধীদলকে আশ্বাস দেয়া হয়ছিল খবাবষ ঢ়ষধুরহম ভরবষফ করেই নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও অবাধ করার প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হবে বলে দৃঢ় প্রত্যয় ও ব্যক্ত করে। এ ব্যাপারে কারো আনুকুল্যে ছাড় দেয়া হবে না বলে সুস্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিলেন নির্বাচন কমিশন প্রধান।
প্রসঙ্গত; ফলাফল যা দাঁড়ালো এতে গোটা জাতি স্তম্ভিত হয়ে গেলো। রাজনীতিবিদদের ভাষায় মেরুদন্ডহীন নির্বাচন কমিশন যা দেখালো তা শুধু মেরুদন্ডহীনতাই নয় নির্বাচন কমিশনের অস্তিত্বকেই ধূলিস্মাৎ করে দিলো। একজন রাজনীতিবিদ বলেছিলেন যে, নির্বাচন কমিশনের ঘাড়ে কয়টা মাথা যে, প্রধানমন্ত্রীর বিপক্ষে গিয়ে নির্বাচনকে অবাধ এবং সুষ্ঠু করে। এ কথাটির হুবহু বাস্তবায়ন করে দেখালো হয়ে যাওয়া পৌর নির্বাচন। অন্য একজন বোদ্ধা রাজনীতিক বললেন, ‘বাংলাদেশের গণতন্ত্র এখন নির্বাসনে। এদিকে নির্বাচন পরবর্তী বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক এবং কলামিষ্ট ফরহাদ মজহার বলেন, কার্যত: ক্ষমতাসীনদের অধীনে অসম নির্বাচনী পরিস্থিতিতে পৌরসভার নির্বাচন চলছে। যার ফলাফল ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতা আরও পোক্ত করবে। নির্বাচনের ফল কী হবে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা দেখে আগাম আন্দাজ করা যায়। ক্ষমতাসীনদের অবৈধতার মাত্রা এতে কমবেনা বরং বাড়বে। (নয়া দিগন্ত, ১ জানুয়ারী) প্রসঙ্গত; এ নির্বাচনের ফলাফলে আমরা কী দেখতে পেলাম। ২৩৪ পৌরসভার নির্বাচনে ফলাফল প্রকাশ পেয়েছে ২১৪টি। এতে আওয়ামীলীগ পেয়েছে ১৬৮টি, বিএনপি ১৯টি, জাতীয় পার্টি ১টি, স্বতন্ত্র ২৬টি। নির্বাচন কমিশন ফলাফল স্থগিত করেছে ২০টি এবং কেন্দ্র স্থগিত করেছে ৩৯টি। (সূত্র: নয়াদিগন্ত)।
শুধু তাই নয় বিভিন্ন সংগঠন এবং নির্বাচনী ওয়াচ রিপোর্টে তুলে ধরা হয়েছে ব্যাপক সহিংস ঘটনা, দুর্নীতি এবং অনিয়ম। জোর জবরদস্তি মূলক ব্যালট ছিনতাই এবং তাতে জাল ভোট দেয়ার বিস্তর অভিযোগ পত্র-পত্রিকা এবং বিভিন্ন গণমাধ্যমে উঠে এসেছে। বিশেষ করে এটিএন চ্যানেলের সাংবাদিককে এরেস্ট করা হয়েছে বাস্তব চিত্র তুলে ধরার অপরাধে।
এ হচ্ছে সরকারের পক্ষ থেকে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের নিদর্শন! ঘোষণা দিতেও তাদের মুখে আটকায়না। প্রধানমন্ত্রীর অন্যতম চাটুকার এইচটি ইমাম তো বলেই ফেললেন এমন সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন ইতোপূর্বে আর হয় নাই! বলতে তো হবেই উচ্ছিষ্ট ভোগের নিমক হালালী তো করতেই হবে!
তবে বিরোধী দলকে এ শিক্ষা নিতেই হবে। কেননা হেলায় যদি সময় হারায় তবে অসময়ে হায় হায় করে কোন লাভ নেই। রাজনীতি কাহাকে বলে, বিরোধী দলকে অবশ্যই এ থেকে শিক্ষা নিতে হবে। আমরা একথা বলিনা যে দেশের কোন প্রকার ক্ষতি করে বা জনগণের দুর্ভোগ বাড়িয়ে রাজনীতি করতে হবে। রাজনীতি অবশ্যই জনগণের স্বার্থে হতে হবে। দেশের অবকাঠামোর কোনো ক্ষতি সাধন করে জনকল্যাণের রাজনীতি করা যায়না, এ উপলব্ধি অন্তত বিরোধী দলের থাকা উচিত। এ নির্বাচনের পরপরই দেশের বিশিষ্ট জনেরা ইসির পদত্যাগ দাবী করেছেন। পাশাপাশি প্রহসনের নির্বাচনকে প্রত্যাখ্যান করে ইসি ও সরকারের পদত্যাগ দাবী করেছে বিএনপি। এ নির্বাচনের সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে সারাদেশে নিগৃহীত এবং হামলার শিকার হয়েছেন ২৬ সাংবাদিক। (দৈনিক দিনকাল)
এ বিষয়গুলো ছাড়াও জনগণ ভীতসন্তস্ত্র হয়ে নির্বাচনী সেন্টার থেকে ফিরে গিয়েছেন অনেক। তবে সরকারের পক্ষে ব্যাপক প্রশংসা কুড়িয়েছে নির্বাচন কমিশন এ অর্থে যে, একটি সুষ্ঠু অবাধ এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দিয়ে।
অতএব বিরোধী দলের অভিযোগ অনুযায়ী নির্বাচন কমিশনের মেরুদন্ডহীনতার কথা যতই প্রচার করুক না কেন, ডিজিটাল মেরুদন্ড নিয়ে এ সরকারের পক্ষে নির্বাচনী জয়রথ এগিয়ে নিতে এ কমিশন যে সবিশেষ পারঙ্গম এতে কোন সন্দেহ নেই।
বর্তমান দেশের জনগণ অপেক্ষা করছে এ নির্বাচন কমিশনের হায়া-শরম কবে জাগবে। এ আশাও জনগণ দেখছেনা। সত্যকে মিথ্যা, মিথ্যাকে সত্য করতে এদের বিবেকবোধ এতটুকু নড়েনা। ক্ষণস্থায়ী এ জীবনটাই শেষ কথা! এ বোধটুকু কী এদের জাগবেনা? একটি দেশের জনগণকে দিকভ্রান্ত করতে এদর অপকীর্তি আর কতদিন ধরে এদেশের মানুষ প্রত্যক্ষ করবে। ২০১৬ সালের শুরুতেই যদি দেশ জাতির কল্যানার্থে শুভবুদ্ধি না জাগাতে পারি তবে তো ভবিষ্যতের ন্যূনতম প্রত্যাশার দুয়ারটিও বন্ধ হয়ে যাবে। এ জাতি আর সহিংসতার রাজনীতি চায়না। তারা চায় একটু প্রত্যাশার আলো। সুস্থ এবং স্বাভাবিক জীবন ফিরে পেতে চায়। মানুষ হিসেবে মানুষের ভালবাসা নিয়ে বেঁচে থাকতে চায়। সরকার এবং বিরোধীদলের সহিষ্ণুতা এবং সহমর্মিতা চায়। হিংসা হানাহানি দূরীভূত করে কল্যাণ রাষ্ট্র চায়। জাতির ক্রান্তি লগ্নে সরকার এবং বিরোধী দল ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হোক এ প্রত্যাশা দেশের সকলের।
আর এর যদি ব্যতিক্রম হয় অর্থাৎ সরকারের মনোভাবের কোন পরিবর্তন না হয় বা বিরোধীদল কোন সমঝোতার পথ অবলম্বন না করে তবে এমন উৎকন্ঠা থেকে আমরা মুক্ত হতে পারবো না। জনসমর্থনহীন এ পৌর নির্বাচন সরকারের অবৈধ ক্ষমতাকেই আরও পাকাপোক্ত করবে এবং গণতন্ত্র মুখ থুবড়ে পড়বে। তাতে করে সরকারের বেপরোয়া মনোভাব আরও দৃঢ় হবে। পাশাপাশি জনদুর্ভোগের ক্ষতিয়ান আরও প্রলম্বিত হবে। আর এভাবে বিরোধী আন্দোলন থিতে হয়ে পড়ার সম্ভাবনাই বেশী থাকবে। কিন্তু বর্তমান রাজনীতির পরিবেশ নিয়ে যেভাবে অনীহা প্রকাশ করছে জনগণ তাতে করে এদেশের সকল প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠান সরকারের একক নির্দেশনায় নব্য বকশালীয় ভয়ঙ্কর ডিক্টেটরশীপ বাস্তবায়নের ইঙ্গিত বহন করছে বলে জনগণের আশংকা। আর এরই আলামত প্রকাশ পেয়েছে বিগত পৌর নির্বাচনের সকল কর্মকান্ডে। তাই পৌর নির্বাচনকে ভিত্তি করে সরকার যেন জাতিকে আর দিকভ্রান্ত না করে বা দেশ যেন আর অনিশ্চতায় না পড়ে। গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পাক এ প্রত্যাশা আমাদের।
লেখকঃ সাংবাদিক ও কলামিষ্ট ও সভাপতি সিলেট কেন্দ্রিয় লেখক ফোরাম।