সংবাদ শিরোনাম
হবিগঞ্জ-৪ আসনের সাবেক এমপি ব্যারিস্টার সুমনকে গ্রেফতার করেছে মিরপুর থানা পুলিশ  » «   ফটো সাংবাদিক আজমলের মাতার মৃত্যুতে সিলেট বিভাগীয় অনলাইন প্রেসক্লাবের শোক  » «   কুলাউড়ায় সাবেক সচিবের বাগান বাড়ি থেকে লাশ উদ্ধার  » «   জনগনের সরকার প্রতিষ্টা হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত বিএনপির আন্দোলন চলবে : জিকে গাউছ  » «   সাবেক মন্ত্রী ইমরান আহমদকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ  » «   কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক চেয়ারম্যান কালা মিয়া গ্রেফতার  » «   সিলেটে পিপি ফয়েজের কক্ষে তালা পিপি মুজিব লাঞ্চিত    » «   বাংলাদেশের নতুন পথচলায় সাংবাদিকরা অগ্রণী ভূমিকা রাখবেন : এসএমপি কমিশনার রেজাউল করিম  » «   পশ্চিম ধরাধরপুর মসজিদকে এক ব্যক্তির কবল থেকে মুক্ত করার দাবি-ধরাধরপুর এলাকাবাসী  » «   ড. ইউনুসকে সময় দিতে চান তারেক রহমান-সিলেটে এম এ মালিক  » «   নিয়োগ প্রাপ্ত পাবলিক প্রসিকিউটর এড. ফয়েজকে প্রত্যাখ্যান করে সিলেট আইনজীবী ফোরামের প্রতিবাদ সমাবেশ  » «   তারেক রহমান আইনী ব্যবস্থার মাধ্যমে অচিরে দেশে ফিরে আসবেন”-এম এ মালেক  » «   আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য বেগম মতিয়া চৌধুরী মারা গেছেন  » «   জাফলংয়ের ইসিএভুক্ত এলাকায় অভিযান চালিয়ে ৭০০ নৌকাসহ বালু ও পাথর জব্দ করেছে ভ্রাম্যমাণ আদালত  » «   সিলেটের দুই হোটেলের বিরুদ্ধে মালপত্র আটকে হয়রানির অভিযোগ যুক্তরাজ্য প্রবাসীর  » «  

পর্যটন শান্তির সোপান

মাহবুবুর রহমান তুহিন::প্রতিবছরের মতো বিশ্বের অন্যান্য দেশের সাথে বাংলাদেশেও  “বিশ্বপর্যটন দিবস-২০২৪” বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে  উদযাপিত হচ্ছে। জাতিসংঘ বিশ্ব পর্যটন সংস্থা ঘোষিত এ বছরের দিবসটির মূল প্রতিপাদ্য-‘Tourism and Peace”-‘পর্যটন শান্তির সোপান’ অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক ও যথাযথ। শান্তি বিনির্মাণের প্রক্রিয়ায় পর্যটন অনুঘটক হিসেবে কাজ করে। পর্যটনের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশ, সংস্কৃতি ও মানুষের মধ্যে ইতিবাচক মনোভাব সৃষ্টি হয়। সৃষ্টি হয় সমঝোতা ও বন্ধুত্ব। যুদ্ধের অনুপস্থিতি শুধু শান্তি নয়; সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয়, অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত সহিংসতার অবসান ঘটিয়ে একটি সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টিতে পর্যটনের ভূমিকা অপার।

অজানাকে জানার, অদেখাকে দেখার কৌতুহল মানুষের চিরন্তন। কৌতুহলের পিপাসা মেটাতে মানুষে পথের পাণে পা বাড়ায়। এভাবেই শুরু হয় পথ চলা। অনেক পথের ভ্রমণ একটি পা ফেলার মধ্য দিয়েই শুরু হয়। যেতে যেতে পথে নানাভাবের নতুন কিছু জানা, দেখা ও শেখা হয়, পৃথিবীর একপ্রান্তের এক গৃহকোন থেকে বিশাল ভূবনে আবিষ্কার করে নিজেকে। মানুষের ভাব-ভাবনা-চিন্তা-চেতনার অসংখ্য দুয়ার খুলে যায়। সেই দুয়ার দিয়ে পৃথিবী হয়ে ওঠে প্রিয় প্রাঙ্গন। সেই প্রাঙ্গনের রূপ-রস-গন্ধ-সৌন্দর্য্য সুধা পান করতে করতে পথিক হয়ে ওঠে পর্যটক। 

একজন পর্যটকের আগমনে সেবাখাতে ১১ জন মানুষের সরাসরি কর্মসংস্থান হয়। পরোক্ষভাবে কাজ পান আরও ৩৩ জন। অর্থাৎ ১ লাখ পর্যটকের আগমনের সঙ্গে ১১লাখ কর্মসংস্থান যুক্ত। কোনো স্থানে যদি ১০ লাখ নিয়মিত অভ্যন্তরীণ বা আন্তর্জাতিক পর্যটক থাকে সেখানে স্থায়ী কর্মসংস্থান হয় ১ কোটি ১০ লাখ লোকের। ১৭ কোটি মানুষের বাংলাদেশে তাই পর্যটন শিল্পের বিকাশ অপরিহার্য, কারণ এই জনগোষ্ঠীর ৬০ ভাগ হচ্ছে তরুণ।

  পর্যটন শিল্প পৃথিবীর একক বৃহত্তম শিল্প হিসেবে স্বীকৃত। পৃথিবীর প্রায় সব দেশে পর্যটন এখন অন্যতম প্রধান অগ্রাধিকার খাত। ১৯৫০ সালে পৃথিবীতে পর্যটকের সংখ্যা ছিল মাত্র ২৫ মিলিয়ন; যা ২০২৩ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১২৭০ মিলিয়নে। ধারণা করা হচ্ছে, এ বছর প্রায় ১৩৯ কোটি ৫৬ লাখ ৬০ হাজার পর্যটক সারা পৃথিবী ভ্রমণ করেন। অর্থাৎ বিগত ৬৭ বছরে পর্যটকের সংখ্যা প্রায় ৫০ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। পর্যটকের সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের পরিধি ব্যাপকতা লাভ করেছে। পর্যটনের মধ্যে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন সাধিত হয়ে থাকে। ২০২৩ সালে বিশ্বের জিডিপিতে ট্যুরিজমের অবদান ছিল ১০.৪ শতাংশ, যা ২০২৭ সালে ১১.৭ শতাংশে গিয়ে পৌঁছাবে। এছাড়া ২০২৩ সালে পর্যটকদের ভ্রমণখাতে ব্যয় হয়েছে ২.২ বিলিয়ন ডলার। আর একই বছর পর্যটনে বিনিয়োগ হয়েছে ৮৮২.৪ বিলিয়ন ডলার। পর্যটনের অর্থনৈতিক উন্নয়নের একটি খণ্ডচিত্র আমরা এর থেকে পেতে পারি।

  বাংলাদেশ বিপুল পর্যটন সম্ভাবনাময় একটি দেশ। নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, সমৃদ্ধ ইতিহাস, বৈচিত্র্যপূর্ণ সংস্কৃতি আমাদের দেশকে পরিণত করেছে একটি অনন্য আকর্ষণীয় পর্যটন গন্তব্যে। পৃথিবীর সবচেয়ে বড়ো ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন, পৃথিবীর দীর্ঘতম অবিচ্ছেদ্য সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার, পার্বত্য চট্টগ্রামের অকৃত্রিম সৌন্দর্য, সিলেটের চা-বাগানসহ আরও অনেক প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি আমাদের এই প্রিয়দেশ। বাংলাদেশের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, ঐতিহাসিক এবং প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানসমূহ এবং বাঙালির আতিথেয়তা এই আমাদের পর্যটন সম্পদ। পর্যটন শিল্প বিকাশের সব সম্ভাবনা এ দেশে বিরাজমান। তাই কবির ভাষায় আমরা বলতে পারি- ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি সকল দেশের রানী সেজে আমার জন্মভূমি’। এ সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে  বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পকে এগিয়ে নিয়ে যাবার ব্যাপারে আন্তরিকভাবে কাজ করতে হবে।

বাংলাদেশের হাওর অঞ্চল পর্যটনের আরেক সম্ভাবনার নাম। বাংলাদেশের জেলাগুলোর মধ্যে সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, নেত্রকোনা, সিলেট, কিশোরগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া- এ সাতটি জেলার ৭ লাখ ৮৪ হাজার হেক্টর জলাভূমিতে ৪২৩টি হাওর নিয়ে হাওরাঞ্চল গঠিত। হাওর অঞ্চলের সাগরসদৃশ বিস্তীর্ণ জলরাশির এক অপরূপ মহিমায় মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। হাওরের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পর্যটকরা নৌকায় বসে বিস্তীর্ণ নীল জলরাশির মায়ায় ভেসে বেড়াতে পারেন। হাওরের কোলঘেঁষে থাকা সীমান্ত নদী, পাহাড়, পাহাড়ি ঝরনা, হাওর-বাঁওড়ের হিজল, করচ, নল, খাগড়া বনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, নানা প্রজাতির বনজ, জলজপ্রাণী আর হাওর পারের বসবাসকারী মানুষের জীবন-জীবিকার নৈসর্গিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হওয়ার মতো খোরাক মিলবে পর্যটক ও দর্শনার্থীদের। হাওরাঞ্চলকে ঘিরে পর্যটনের রাজ্য গড়ার কাজ শুরু করতে হবে এখনই।

দেশের মোট জিডিপির শতকরা ৪.৪ শতাংশ আসে এই শিল্প থেকে। জাতীয় শিল্পনীতি ২০২২ এ পর্যটনশিল্পের ১২ টি উপখাতের উল্লেখ রয়েছে যেখানে অসংখ্য মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়েছে। নানা ধরনের চ্যালেঞ্জ ও সংকট কাটিয়ে পর্যটন শিল্পে নতুন উদ্যোগ ও ভাবনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে নতুন আঙ্গিকে কাজ শুরু করেছে সরকার। ধীর গতিতে হলেও বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের অগ্রগতি হচ্ছে। পর্যটন শিল্পের সঠিক উন্নয়নের জন্য নীতিমালা হালনাগাদকরণসহ বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে। ট্যুরিজম মাস্টার প্ল্যান চুড়ান্তকরণের প্রক্রিয়ায় রয়েছে। অনুমোদন এবং তার আলোকে অগ্রাধিকার নির্ণয় করে বিনিয়োগের মাধ্যমে পর্যটন খাতে দৃশ্যমান উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব।

পর্যটন শুধু এককভাবে সরকারের কাজ নয়। জনসাধারণ এর মূল অংশীদার। আমরা  দেশে দায়িত্বশীল (Responsible Tourism) এবং টেকসই  (Sustainable Tourism) পর্যটন প্রতিষ্ঠার কাজ করছি। দেশের তরুণ প্রজন্মসহ পর্যটন শিল্পের নিবিড় এবং টেকসই উন্নয়নে দেশের ব্যাপক জনগোষ্ঠীকে সম্পৃক্ত করার লক্ষ্যে  পর্যায়ক্রমে ‘পর্যটন সপ্তাহ’ ও ‘পর্যটন মাস’ উদযাপনের উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে পর্যটন শিল্পের বিপুল সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে তরুণ ও যুবকদের এ সেক্টরে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে একদিকে যেমন বেকারত্ব দূর করার উদ্যোগ নেয়া  উচিৎ অন্যদিকে এর মাধ্যমে নবীনরা দেশের উন্নয়ন-অগ্রগতিতে অবদান রাখার সুযোগ পাবে। জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের অকুতোভয় বীর শহিদদের গৌরব গাথাকে অমলিন করার লক্ষ্যে শহিদ পরিবারের সদস্যকে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে পর্যটন শিল্পে সম্পৃক্ত করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এর মাধ্যমে এ বিপ্লব এক ভিন্ন মহিমায় উদ্ভাসিত হবে।

বাংলাদেশে পর্যটন শিল্পের অপার সম্ভাবনা বিরাজমান। কিন্তু এ বিশাল সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও সঠিক পরিকল্পনার অভাবে আমরা পর্যটন শিল্পে পিছিয়ে আছি। এ শিল্পের উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন সমন্বিত পরিকল্পনা। পর্যটন শিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত সবপক্ষকে নিয়ে একসঙ্গে কাজ করে যেতে হবে। দেশীয় পর্যটন বিকাশের পাশাপাশি বিদেশি পর্যটক আকর্ষণে প্রচার-প্রচারণার ওপর গুরুত্বারোপ করতে হবে। পাশাপাশি এ শিল্পের উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। সঠিক কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা গেলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে পর্যটন শিল্প অন্যতম ভূমিকা পালন করতে পারবে।

চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাং বাংলাদেশ ভ্রমণে এসে উচ্ছ্বাসিত হয়ে বলেছিলেন : এ স্লিপিং বিউটি এমার্জিং ফ্রম মিস্টস অ্যান্ড ওয়াটার। এই উচ্ছ্বাসিত প্রশংসাকে সর্বদা ধরে রাখার মাধ্যমে পর্যটন শিল্পের বিকাশের দায়িত্ব আমাদেরই।

লেখক:  সিনিয়র তথ্য অফিসার, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়(পিআইডি ফিচার)

 

সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়াার করুন

সর্বশেষ সংবাদ

Developed by:

.