সেলিনা আক্তার:;মানুষের জীবন অতি মূল্যবান। সেই মূল্যবান জীবন কারো ভুল বা অবহেলার কারণে চলে যাওয়া কোনো মতে কাম্য নয়। প্রতিবছর কোনো না কোনো অবহেলার কারণে অসংখ্য মানুষ প্রাণ হারায়। হতে পারে ভুল চিকিৎসা, অগ্নিসংযোগ, সড়ক দুর্ঘটনা, কিংবা নির্মাণ শ্রমিকের মৃত্যু। সন্তানহারা হন মা, অকালে বিধবা হন পত্নী, পিতার কাঁধে ওঠে সন্তানের লাশ। মর্মান্তিক মৃত্যু এসব কেবল অসতর্কতার খেসারত, যা দেশ ও জাতির জন্য চরম ক্ষতির কারণ। কোনো ধরনের অপমৃত্যুই সমাজের জন্য সুখকর নয়। আমরা একটু সচেতন হলেই এই ধরনের দুর্ঘটনা এড়িয়ে চলতে পারি।
মানব জীবনে দুর্ঘটনা সম্পূর্ণ রূপে এড়িয়ে চলা সম্ভব নয়। প্রাকৃতিক কিংবা দৈববলেই বিভিন্ন ধরনের দুর্ঘটনার সম্মুখীন হতে হয় আমাদের। সেই উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলাও করতে হয়। কিন্তু যখন কোনো দুর্ঘটনা নিজেদের উদাসীনতার কারণে সংঘটিত হয় এবং এর পুনরাবৃত্তি ঘটতেই থাকে তখন তা একটি জাতির জন্য চরম দুর্ভাগ্যজনকই বটে। জীবনযাপনে কোনো কাজেই সচেতনতার বিকল্প নেই। জেনে বুঝে আমরা যদি অচেতন থাকি তাহলে আমাদের কোনো কাজেই সফলতা আসবে না। সচেতনতা বা সতর্কতাই সব নিরাপত্তা দিতে পারে।
বরগুনার বেতাগীতে একটি নির্মাণাধীন বাড়ির সেপটিক ট্যাংকের বিষাক্ত গ্যাসে এক নির্মাণ শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। সেখানে নির্মাণাধীন ভবনে কাজ করছিলেন দুই জন শ্রমিক। ভবনের সিঁড়ির গোড়ায় সেপটিক ট্যাংকে কাজ করার জন্য প্রথমে একজন শ্রমিক নামেন। ট্যাংকের ভেতরে ঢুকতেই বিষাক্ত গ্যাসে অজ্ঞান হয়ে পড়েন তিনি। এরপর ফায়ার সার্ভিসের একটি দল ঘটনাস্থলে পৌঁছে তাকে উদ্ধার করে অজ্ঞান অবস্থায় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে আসলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
যেকোনো নির্মাণ শ্রমিকের মৃত্যকে ‘দুর্ঘটনা’ বলার চেষ্টা করা হয়। শ্রমিক অধিকার আন্দোলনে যুক্ত ব্যক্তিরা বলছেন, শ্রমিককে কাজে নিয়োগের সময় যেসব নিরাপত্তা দেওয়ার কথা, সেটা না দেওয়ার কারণে যে মৃত্যু ঘটে, সেটাকে কোনোভাবেই ‘দুর্ঘটনা’ বলার সুযোগ নেই। বরং এ ধরনের মৃত্যু হত্যাকাণ্ডের শামিল। এমনকি এসব হত্যাকাণ্ড কোথাও নথিভুক্তও হয় না। বিচ্ছিন্নভাবে মৃত্যুর ঘটনা ঘটায় এদের প্রাপ্য ক্ষতিপূরণ নিয়েও কোনো আলোচনা নেই।
কোনো ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের ইচ্ছাকৃত বা অবহেলাজনিত কারণে কারও মৃত্যু ঘটলে তাকে ‘রংফুল ডেথ’ বা অবৈধ মৃত্যু বলা হয়। মালিকের অবহেলায় কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকের মৃত্যু ঘটলে নিঃসন্দেহে তা অবৈধ মৃত্যু। এ ধরনের মৃত্যুর জন্য দেওয়ানি আদালতের শরণাপন্ন হয়ে ‘টর্ট’ আইনের অধীনে মালিকের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় করা যায়। আহত-নিহত ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণ মূলত ভবন ও কারখানার মালিকদেরই দিতে হবে।
প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন নির্মাণ শ্রমিকরা। রাজধানীসহ দেশজুড়ে গড়ে উঠছে বিপুলসংখ্যক বহুতল ভবন। এ সব ভবন নির্মাণে শ্রমিকদের দুর্ঘটনা এড়াতে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকদের কোনো ধরনের জীবন রক্ষাকারী সরঞ্জাম সরবরাহ করা হয় না। এই যে সেপটিক ট্যাংকে শ্রমিক মারা গেলো, কাজ করার সময় তার নিরাপত্তার জন্য যা যা করণীয়, তা করা হয়েছিল কি-না, সেটা তদন্ত হওয়া জরুরি। সেটা হয় না বলেই এটাকে শ্রেফ দুর্ঘটনা বলে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। মালিকদের অবহেলা, শ্রমিকদের সচেতনতার অভাব, শ্রম আইনের সঠিক বাস্তবায়ন না হওয়া এবং এ আইনের দুর্বলতার কারণে এমন অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন। কোনো নিয়মকেই গুরুত্ব না দেওয়ায় নির্মাণ শ্রমিকদের পাশাপাশি আশপাশের মানুষ ও ভবনের নিচে পথচারীরাও নিরাপত্তাহীনতায় থাকেন। জাতীয় বিল্ডিং কোডে কর্মকালীন একজন শ্রমিকের কী কী নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নিতে হবে, তার বিস্তারিত উল্লেখ থাকলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তা মানা হয় না। ২০১৪ সালের ‘জাতীয় ভবন নির্মাণ বিধিমালা’ অনুযায়ী, কাজের সময় শ্রমিকের মাথায় হেলমেট পরা বাধ্যতামূলক করা হয়। যারা কংক্রিটের কাজে যুক্ত, তাদের হাতে গ্লাভস ও চোখের জন্য ক্ষতিকর কাজে চশমা পরিধান করতে হবে। ওয়েল্ডার ও গ্যাস কাটার ব্যবহারের সময় রক্ষামূলক সরঞ্জাম যেমন- গ্লাভস, নিরাপত্তা বুট, অ্যাপ্রন ব্যবহার করতে হবে। ভবনের ওপরে কাজ করার সময় শ্রমিকদের নিরাপত্তায় বেল্ট ব্যবহারও বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
সারা দেশে গত ১০ বছরে কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় প্রায় সাড়ে ৫ হাজার শ্রমিক নিহত হয়েছেন। যাদের মধ্যে শুধু গত ১ বছরেই নিহত হয়েছেন ৮৭৫ জন। এসআরএসের তথ্য অনুযায়ী, গত ১০ বছরে কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনা ঘটেছে ৪ হাজার ৭১টি আর এতে নিহত হয়েছেন ৫ হাজার ২৩৫ জন শ্রমিক। এর মধ্যে গত ১ বছরে (১ জানুয়ারি ৩১ ডিসেম্বর ২০২৩) সারা দেশে ৭১২টি দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৮৭৫ জন শ্রমিক। ২০২২ সালে একই সময়ে সারা দেশে ৫৪৪টি কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় ৭১২ জন শ্রমিক নিহত হন। এসআরএসের তথ্য অনুসারে, ২০২৩ সালে সবচেয়ে বেশি শ্রমিক নিহত হয়েছেন পরিবহণখাতে। যাদের সংখ্যা মোট ৩২৯ জন। এরপরই রয়েছে সেবামূলক প্রতিষ্ঠান (যেমন-ওয়ার্কশপ, গ্যাস, বিদ্যুৎ সরবরাহ প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি) ১৮৫ জন, নির্মাণখাতে নিহত হয়েছে ১৭৩ জন, কলকারখানা ও অন্যান্য উৎপাদনশীল প্রতিষ্ঠানে এই সংখ্যা ৯৬ জন এবং কৃষিখাতে ৮২ জন শ্রমিক নিহত হয়েছেন। মৃত্যুর কারণ পর্যালোচনা করে সংস্থাটি জানায়, সড়ক দুর্ঘটনায় ৪৪৬ জন; বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে ১১৭ জন; আগুন এবং বিভিন্ন বিস্ফোরণে ৭৯ জন; মাঁচা বা ওপর থেকে পড়ে মারা গেছেন ৭০ জন; বজ্রপাতে ৬৩ জন; শক্ত বা ভারী কোনো বস্তুর দ্বারা আঘাত বা তার নিচে চাপা পড়ে ৩৮ জন; পাহাড় বা মাটি, ব্রিজ, ভবন বা ছাদ, দেয়াল ধসে ২৩ জন; রাসায়নিক দ্রব্য বা সেপটিক ট্যাংক বা পানির ট্যাংকের বিষাক্ত গ্যাসে আক্রান্ত হয়ে ২০ জন; পানিতে ডুবে ১০ জন; এবং অন্যান্য কারণে ৯ জনের মৃত্যু হয়েছে।
কর্মক্ষেত্রে শ্রমিক নিহতের কারণগুলোর মধ্যে, রাস্তাঘাটের গঠন, গাড়ির ফিটনেস, অদক্ষ চালক, অনিয়ন্ত্রিত পরিবহণ ব্যবস্থা, আইন প্রয়োগে বাধা, বেপরোয়া যান চলাচল অন্যতম।
নিহতের কারণ হিসেবে ধরে নেয়া যায় যে, কারখানা নির্মাণে সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে অনুমতি না নেওয়া, নিরাপত্তা বিষয়ে শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ না দেওয়া, কোনোরকম নিরাপত্তা ব্যবস্থা না নিয়েই বৈদ্যুতিক লাইন সংযোগ দেওয়া, ভেজা হাতে মোটর চালু করা, বিদ্যুতের লাইনের নিচে কাজ করা, লোহার রড/ভারী জিনিস উত্তোলন, নিরাপত্তাবেষ্টনী ব্যবহার না করে মাঁচার ওপর কাজ করা, রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহারে অদক্ষতা এবং সেপটিক ট্যাংক বা পানির ট্যাংকে কাজ করার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সতর্কতার অভাব। তাছাড়া কাজ করার সময় ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম ব্যবহার না করার কারণেও কিছু দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে জরুরি ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার। কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজরদারি বাড়াতে হবে। তা না হলে দুর্ঘটনা বাড়তেই থাকবে।
মালিকদের অবশ্যই শ্রমিকের কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা নিশ্চিত করাকে দায় মনে না করে বিনিয়োগ মনে করতে হবে। কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরকে শক্তিশালী ও তাদের সক্ষমতা বৃদ্ধিসহ কারখানা ও প্রতিষ্ঠানভিত্তিক নিরাপত্তা নির্দেশনা প্রণয়ন, ঝুঁকি নিরূপণসহ দুর্ঘটনার মূল কারণ চিহ্নিত করে তা কীভাবে কমিয়ে আনা যায় সে ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে শিগগিরই ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। আর এই দায়িত্ব যদি ভালোভাবে পালন করা যায় তাহলেই কর্মক্ষেত্রে অনেকাংশে দুর্ঘটনা এড়িয়ে চলা সম্ভব হবে।
পিআইডি ফিচার