এ এইচ এম মাসুম বিল্লাহ::বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে বৈশ্বিক জাহাজ ভাঙা বা পুনঃপ্রক্রিয়াকরণ শিল্পে শক্তিশালী অবস্থান ধরে রেখেছে।
বিশেষত চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড এলাকায় এই শিল্পের বিশাল কর্মযজ্ঞ পরিচালিত হচ্ছে। দেশের অর্থনীতির এই গুরুত্বপূর্ণ খাতে দেড় লক্ষাধিক মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নিয়োজিত। সরকার এই শিল্প হতে প্রতিবছর ১০০-১২০ মিলিয়ন ডলার রাজস্ব আয় করে। তবে, পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব কমিয়ে আনা এই শিল্পের অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ। আশার কথা, এই শিল্পকে পরিবেশবান্ধব করার পথে বাংলাদেশ এখন অনেকটাই এগিয়ে গিয়েছে। জাহাজ ভাঙ্গা প্রক্রিয়াকে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত পরিবেশগত মানদণ্ডের সাথে সামঞ্জস্য আনতে বাংলাদেশ কাজ করছে। এতে পরিবেশ দূষণ হ্রাস ও শ্রমিকদের নিরাপত্তা বৃদ্ধির সাথে সাথে বাংলাদেশের এই শিল্পের সুনাম পৃথিবীতে আরও ছড়িয়ে পড়বে।
জাহাজ পুনঃপ্রক্রিয়াকরণে বিশ্বে প্রথম অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ । ২০২৩ সালে পৃথিবীতে মোট প্রায় ৭৮ লাখ টন জাহাজ রিসাইক্লিং হয় যার প্রায় ৪৬ শতাংশ বাংলাদেশে করা হয়। বাল্ক ক্যারিয়ার জাহাজের ক্ষেত্রে এই হার প্রায় ৭২ শতাংশ। সীতাকুণ্ডের ২০ কিলোমিটার উপকূলজুড়ে বিস্তৃত এই জাহাজ পুনঃপ্রক্রিয়াকরণ শিল্পে প্রায় বারো হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে। শিল্প মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে, প্রায় ১২০টি শিপ রিসাইক্লিং ইয়ার্ডের মধ্যে ৫০টি সম্পূর্ণরূপে চলমান রয়েছে। জাহাজ ভাঙ্গা শিল্প স্টিল শিল্প, রিরোলিং এবং জাহাজ নির্মাণ শিল্পের ব্যাক ওয়ার্ড লিঙ্কেজ শিল্প হিসেব অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
জাহাজ পুনঃপ্রক্রিয়াকরণ শিল্পে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় দেশ হিসেবে এই শিল্পের পরিবেশগত পরিস্থিতি উন্নয়নে বাংলাদেশের বিশাল দায়িত্ব রয়েছে। এই দায়িত্ব পালনের লক্ষ্যে রেগুলেটরি রিফর্ম ও সবুজ সনদ গ্রহণের মাধ্যমে বাংলাদেশ এই শিল্পকে আরও টেকসই করার পথে অগ্রসর হচ্ছে। সরকার এই গুরুত্বপূর্ণ শিল্পের পরিবেশগত প্রভাব কমাতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। বিশেষত আন্তর্জাতিক নীতিমালা যেমন হংকং আন্তর্জাতিক চুক্তি (ইংরেজিতে সংক্ষেপে এইচকেসি বলা হয়) অনুযায়ী পরিবেশগতভাবে নিরাপদ জাহাজ পুনঃপ্রক্রিয়াকরণের মান পূরণের উপর জোর দিচ্ছে।
বাংলাদেশ জাহাজ ভাঙা প্রক্রিয়ার মান নিয়ন্ত্রণ ও আধুনিকায়নে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। জাহাজ পুনঃপ্রক্রিয়াকরণ বিধিমালার মাধ্যমে এই শিল্পকে টেকসই করার জন্য একটি কাঠামো গড়ে তোলা হয়েছে। আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের সাথে সামঞ্জস্য বজায় রাখায় এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের চারটি শিপইয়ার্ড ‘ক্লাস এনকে’ থেকে সবুজ সার্টিফিকেট পেয়েছে। ‘ক্লাস এনকে’ জাপানভিত্তিক একটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সার্টিফাইং বডি। আরও ২০টি শিপইয়ার্ডকে পরিবেশবান্ধব হিসেবে গড়ে তোলার কাজ চলছে। বাংলাদেশ শিপ ব্রেকারস এন্ড রিসাইক্লারস অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুসারে হংকং কনভেনশনের মান অর্জনে এই ২০টি শিপইয়ার্ড প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে। আন্তর্জাতিক ক্রেতারা এখন টেকসই পদ্ধতি অনুসরণকারী শিপ রিসাইক্লিং ইয়ার্ডকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। জাহাজ ভাঙ্গা শিল্পের এই গুণগত পরিবর্তন শুধু পরিবেশ রক্ষাই নয় বরং নতুন বাজার ও অংশীদারিত্বের সুযোগ সৃষ্টি করবে।
আন্তর্জাতিক সমুদ্র চলাচল সংস্থা (আইএমও) এর সদস্য রাষ্ট্রসমূহ এবং এনজিও ও আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) এর উদ্যোগে ২০০৯ সালে হংকং কনভেনশন স্বাক্ষরিত হয়। বাংলাদেশ ইতিমধ্যে হংকং কনভেনশন অনুসমর্থন করেছে। এই চুক্তি অনুসারে জাহাজ পুনঃপ্রক্রিয়াকরণের সময় মানব স্বাস্থ্য এবং পরিবেশগত সুরক্ষা নিশ্চিত করে নিরাপদে সম্পন্ন করতে হবে। বিশ্বের অনেক দেশ এখনও এই চুক্তি অনুমোদন করেনি। তবে বাংলাদেশ এই মানদণ্ডের আলোকে জাহাজ ভাঙ্গার প্রক্রিয়া দাঁড় করাতে কাজ করছে।
বাংলাদেশে জাহাজ ভাঙা শিল্পের পরিবেশগত চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে বায়ু ও পানি দূষণ অন্যতম। সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অভাবে এই সমস্যা সৃষ্টি হয়। শ্রমিকদের স্বাস্থ্যঝুঁকিও এই শিল্পের একটি বড় সমস্যা। হংকং কনভেনশন অনুসারে ইয়ার্ডগুলোতে দূষণ নিয়ন্ত্রণ ও হ্রাস এবং ক্ষতিকর পদার্থগুলোকে পরিবেশসম্মত পদ্ধতিতে নিরাপদ প্রক্রিয়াজাতকরণের ব্যবস্থা থাকা বাধ্যতামূলক। অ্যাসবেস্টস, জ্বালানি তেলের অবশেষ ও ভারী ধাতুর মতো ক্ষতিকারক উপকরণগুলো পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। জাহাজ ভাঙার সময় প্রচুর পরিমাণে স্ক্র্যাপ ও অন্যান্য বর্জ্য তৈরি হয়। পরিবেশবান্ধব সার্টিফিকেট পেতে হলে শিপইয়ার্ডে এগুলোর সঠিক নিষ্পত্তি ও পুনর্ব্যবহারের ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন। এসকল অবকাঠামো তৈরির মাধ্যমে বাংলাদেশ পরিবেশসম্মত দায়িত্বশীল জাহাজ পুনঃপ্রক্রিয়াকরণে নেতৃত্ব দেওয়ার পথে এগিয়ে যাচ্ছে। সবুজ মানদণ্ডের প্রবর্তনের মাধ্যমে দেশের এই শিল্পে ইতিবাচক পরিবর্তন আসতে শুরু করেছে। বাংলাদেশ ২০২৫ সালের মধ্য হংকং কনভেনশনের মান অর্জন করতে চায়।
জাহাজ ভাঙ্গা শিল্পের ফরোয়ার্ড ও ব্যাকওয়ার্ড লিঙ্কেজে ইস্পাত শিল্প, রি-রোলিং শিল্প, জাহাজ নির্মাণ শিল্প, অক্সিজেন শিল্পসহ বিভিন্ন শিল্প জড়িত আছে। জাহাজ পুনঃপ্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে প্রচুর পরিমাণে ইস্পাত উৎপাদন করা সম্ভব হচ্ছে। এতে ইস্পাত উৎপাদনে কাঁচামাল আমদানির প্রয়োজনীয়তা হ্রাস পাচ্ছে। ইস্পাত শিল্প ও রি-অক্সিজেন শিল্পের মতো ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ শিল্পগুলো শক্তিশালী হয়েছে। ইয়ার্ডগুলো সবুজ সার্টিফিকেট পেলে বাংলাদেশের এই শিল্পের আন্তর্জাতিক বাজার বৃদ্ধি পাবে এবং বাংলাদেশের প্রতি পরিবেশ-সচেতন বিনিয়োগকারীরা আরও আগ্রহী হবে। এজন্য সবুজ মানদণ্ড অর্জনে মনিটরিং অব্যাহত রাখা প্রয়োজন।
জাহাজ ভাঙা শিল্পে সবুজ মানদণ্ড বাস্তবায়নের পথে অন্যতম বাধা প্রয়োজনীয় অর্থের জোগান। এ রূপান্তরের জন্য প্রচুর বিনিয়োগ প্রয়োজন। বিশেষ করে, ছোট ও মাঝারি আকারের ইয়ার্ডগুলোর জন্য এ সমস্যা আরও প্রকট। এছাড়া, হংকং কনভেনশনের জন্য প্রয়োজন সার্বক্ষণিক মনিটরিং, যথাযথ বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মী। জাহাজ পুনঃপ্রক্রিয়াকরণ করতে যেসকল ক্ষতিকারক পদার্থগুলো সৃষ্টি হয় সেগুলোর সুরক্ষিত ও নিরাপদ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে এসকল ব্যবস্থা অপরিহার্য।
এছাড়া, হংকং কনভেনশন বাস্তবায়নে শ্রমিকদের স্বাস্থ্যঝুঁকি কমাতে ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম (পিপিই) যেমনঃ হেলমেট, গ্লাভস, এবং মাস্ক পরতে হয়। বাংলাদেশের জাহাজ ভাঙ্গা শিল্প কয়েক দশক ধরে বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী সীতাকুণ্ড উপজেলায় গড়ে উঠেছে। তাই, পরিবেশগত মান বজায় রাখা ও উপকূলীয় বাস্তুতন্ত্রের উপর এই শিল্পের প্রভাব কমাতে হবে।
সরকার জাহাজ ভাঙ্গা শিল্পের সবুজ রূপান্তরে সক্রিয়ভাবে কাজ করছে। এই লক্ষে জাহাজ পুনঃপ্রক্রিয়াকরণ আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। ক্ষতিকর পদার্থের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ এবং জাহাজ পুনঃপ্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সরকার টেকসই পদ্ধতিতে জাহাজ ভাঙ্গার ভিত্তি স্থাপন করেছে। বর্তমানে জাপান সরকারের অর্থায়নে সীতাকুণ্ডে ট্রিটমেন্ট স্টোরেজ এন্ড ডিসপোজাল ফ্যাসিলিটি নির্মাণ কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। আন্তর্জাতিক সমুদ্র চলাচল সংস্থা (আইএমও) সহযোগিতায় এই শিল্পের সবুজ রূপান্তর প্রকল্পগুলোর জন্য প্রযুক্তিগত দিকনির্দেশনা এবং অর্থায়ন পেতে সহায়তা করছে সরকার। শিপ রিসাইক্লিং ইয়ার্ডগুলোর জন্য নরওয়ে, জাপানসহ অন্যান্য উন্নয়ন অংশীদার হতে সফট লোন পেলে সেটি আরও অধিক সংখ্যক ইয়ার্ডকে সবুজ সার্টিফিকেশন অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ সহায়তা দিবে। এছাড়া জাহাজ ভাঙ্গা শিল্পের সবুজ রূপান্তর সংক্রান্ত একটি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট চালুর পরিকল্পনা সরকারের রয়েছে। বাংলাদেশ শিপ ব্রেকার্স এন্ড রিসাইক্লার্স অ্যাসোসিয়েশনের সহযোগিতায় এই শিল্পের স্টেকহোল্ডার মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি ও টেকসই চর্চার সংস্কৃতি গড়ে তুলতেও সরকার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
পরিবেশবান্ধব সবুজ রূপান্তরের মাধ্যমে বাংলাদেশ পরিবেশগতভাবে দায়িত্বশীল জাহাজ রিসাইক্লিং শিল্পে বৈশ্বিক নেতৃত্বের আসনে আসীন হবে। গত এক দশকে বাংলাদেশ প্রায় ৬২ দশমিক ৪ মিলিয়ন গ্রস টনের জাহাজ পুনঃপ্রক্রিয়াকরণ করেছে, যা বিশ্বের মোট গ্রস টনের প্রায় ৩৫ দশমিক ৬ শতাংশ। আরও শিপ রিসাইক্লিং ইয়ার্ড সবুজ সার্টিফিকেট পেলে এবং আন্তর্জাতিক মানদণ্ড মেনে চললে বিশ্ব বাজারে বাংলাদেশের অবদান আগামীতে নিঃসন্দেহে আরও বৃদ্ধি পাবে। বিশেষত উচ্চমূল্যের দেশসমূহে যারা পরিবেশবান্ধব পদ্ধতিকে অগ্রাধিকার দেয়, সেখানে বাংলাদেশ তার অবস্থান আরও শক্তিশালী করতে সক্ষম হবে।
বাংলাদেশের শিপ রিসাইক্লিং শিল্পের সবুজ মানদণ্ড অর্জনের অগ্রগতি পরিবেশ ও অর্থনীতির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। আন্তর্জাতিক নীতিমালা অনুসরণ এবং হংকং কনভেনশন মানদণ্ড বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশ পরিবেশবান্ধব দায়িত্বশীল জাহাজ পুনঃপ্রক্রিয়াকরণের একটি উদাহরণ স্থাপন করছে। সরকারের অব্যাহত সহায়তা ও টেকসই উন্নয়নের প্রতি অঙ্গীকার বাংলাদেশের জাহাজ পুনঃপ্রক্রিয়াকরণ শিল্পকে একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
লেখক: পরিচালক (মিডিয়া), জনকূটনীতি অনুবিভাগ, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়(পিআইডি ফিচার)