সিলেটপোস্ট ডেস্ক::বর্তমান বিশ্বে সর্বত্রই যুদ্ধ যুদ্ধ রব। সবার মধ্যে মহাভারতের সেই উক্তি অনুরণিত হতে শোনা যাচ্ছে।
‘সূচ্যগ্রং নৈব দাস্যামি বিনা যুদ্ধেন কেশব।’
এখন সবাই পত্রপত্রিকা, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এবং অনেকে প্রত্যক্ষ ভুক্তভোগী যুদ্ধ দুর্দশা দেখে । যুদ্ধক্ষেত্র মাত্র চিহ্নিত । প্রায় দুই বছর পার হয়ে তিন বছরে পা দিতে চলেছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ । ছয়মাসেরও বেশী অতিক্রান্ত হামাস ইজরাইল যুদ্ধ, সাথে লেবানন ও ইরান ইত্যাদি বহুমুখী যুদ্ধ। বিক্ষোভরূপী অন্যান্য ধ্বংসাত্মক লীলা সর্বত্রই চলছে।
বৎসরকালাবধি দেশের সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি এমন বিষাক্ত হয়ে উঠেছে যে সংখ্যালঘু (সরহড়ৎরঃু) ও সংখ্যাগুরু (সধলড়ৎরঃু) সম্বন্ধ খাদ্যখাদক সম্বন্ধে পরিণত হয়েছে । ধর্ম, প্রাণ, মান, ইজ্জৎ রক্ষা হচ্ছেনা এবং রক্ষা করবার মত কেউ নেই বললেই চলে। সম্প্রতি ভারত বিভাগে পাকিস্তান (অধুনা বাংলাদেশ) প্রতিষ্ঠায় মিলনের যে সুক্ষ্ম অংশটুকু কারো কারো হৃদয়কোণে লুক্কায়িত ছিল তাও যেন অন্তর্হিত হয়ে গেছে। তত্রত্য সংখ্যালঘিষ্ট (সরহড়ৎরঃু), সম্প্রদায় ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে । আমার বহু গুরুভাই বোন, শিষ্যশিষ্যা এবং ভক্ত প্রতিদিন প্রতিনিয়ত আমাকে বহু চিঠিতে লিখে, বর্তমানে তাদের কি করণীয় জানতে চাইছে – সে সম্পর্কেই দু-চার কথা এখানে বলতে ইচ্ছা করছি।
বাবাজী মহারাজ শাস্ত্র প্রমাণ দিয়ে এক জায়গায় বলেছেন যে-
‘ভগবান মনু বলিয়াছেন, জগৎ অরাজক হইলে সকলেই ভয়ে ভীত হয়, তাই জগৎ রক্ষার নিমিত্তই ভগবান রাজা সৃষ্টি করিয়াছেন। হিন্দুর নিকট রাজা শুধু দন্ডমুন্ডের কর্তাই নহেন, রাজা হইল দেবমানব। কারণ দেবতা তথা অষ্টদিক পালের সারভূত অংশ গ্রহণ করিয়াই ঈশ্বর রাজা সৃষ্টি করেন।’ (মনু সংহিতা ৭/৪)।
অতএব হিন্দুর কাছে রাজদর্শন হল পুণ্যজনক। কিন্তু সেই রাজা যদি স্বীয় কর্তব্য পালন না করে প্রজাপালনে বিরত হয় এবং রক্ষক না হয়ে ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়, তবে যে প্রজাসাধারণের দুঃখদুর্দশার সীমা পরিসীমা থাকবে না, তা বলাই বাহুল্য। বর্তমানে হয়েছেও তাই। এই অবস্থায় যাদের অর্থ ও সামর্থে কুলাচ্ছে তারা নিরাপদ আশ্রয়লাভের জন্য ঘরবাড়ী ত্যাগ করে অন্যত্র চলে যাচ্ছে, আর যাদের অর্থ সামর্থে কুলাচ্ছেনা তারা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ছে।
এখন প্রশ্ন হল, এইরূপভাবে পলায়ন করলেই কি এই সমস্যার সমাধান হবে? না, তা হবে না । পলায়নপর শত্রুকে দুর্বল জেনে আতঙ্ককারী আরও অধিক উৎসাহে পশ্চাদ্ধাবন করবে।
বীরভোগ্যা বসুন্ধরা এই নীতি সর্বত্রই দৃষ্ট হয়ে থাকে। অতএব জগতে বেঁচে থাকতে হলে দুর্বল হলে চলবেনা, বরং হতে হবে বলীয়ান। হতে হবে সাহসী। কিন্তু ধর্মহীন মানুষের সাহস কিংবা বল কোনোটাই থাকেনা। তার শারীরিক বল অধিকতর শারীরিক বলের দ্বারা প্রতিহত হয়। অতএব অবস্থা বিপর্যয়ে একমাত্র শারীরিক তথা পশুবলে বলীয়ান ব্যক্তি ভীরু কাপুরুষরূপে পরিগণিত হতে বাধ্য হয়। কিন্তু ধর্মবলে যিনি বলীয়ান তাঁর অবস্থা-
‘জাতস্য হি ধ্রুবো মৃত্যুধ্রুবং জন্ম মৃতস্য চ।
তস্মাদপরিহার্যেহর্থে ন ত্বং শোচিতুমর্হসি।’ (গীতা: ২/২৭)
– ‘হে অর্জুন, জন্ম হইলেই নিশ্চয় মৃত্যু হইবে, এবং মৃত্যু হইলেই পুনরায় নিশ্চয় জন্ম হইবে, অতএব যাহা অবধারিত সত্য তাহার জন্য শোক করা তোমার উচিত হয়না, অতএব প্রাণভয়ে ভীত হইয়া স্বধর্মপালনে পরাক্সমুখ হইওনা।’
পৃথিবীর সর্বত্র মনুষ্যসমাজ আজ এক চরম নৈতিক বিভ্রমে পতিত হয়েছে। মানুষ নিজেই এমন এক অবস্থার পরিবেশ সৃষ্টি করেছে যা তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে গিয়ে তার শান্তি ও আগ্রগতির সকল প্রয়াসকে মূলতঃ ব্যাহত করছে। আমাদের দেশে সাধারণ মানুষের মনে নৈরাশ্য ও ব্যর্থতা স্থায়ীভাবে বসে তার সকল সুখ হরণ করেছে। এর কারণ আমাদের জীবনের যথার্থ মূল্যবোধ থেকে আমরা বিচ্যুত হয়েছি জাগতিক উন্নতির জন্য প্রচেষ্টা সর্বকালেই প্রয়োজনীয়, কিন্তু সেই প্রচেষ্টার ফল আমাদের পক্ষে অকিঞ্চিৎকর হবে যদি তাকে ধারণ করার মত উপযুক্ত মানসিক প্রস্তুতি আমাদের না থাকে। এই মানসিক প্রস্তুতি জন্য আবশ্যক হল জীবনের উদ্দেশ্য কি এবং সত্য, শান্তি ও আনন্দলাভের জন্য তা কি প্রণালীতে যাপন করতে হয় সেই সম্বন্ধে সম্যক জ্ঞান। তৎসম্বন্ধে জগতের মনস্বীব্যক্তিগণ ও ধর্মগুরুগণ যা বলেছেন তা অনুসন্ধান করে তার মর্ম উপলব্ধি ও ধারণ করে তদনুসারে চলবার চেষ্টা করা। এই উদ্দেশ্য নিয়েই সাধারণ মানুষের সম্মুখে শান্তি, সত্য ও আত্মচরিতার্থতার পথ প্রদর্শক শাশ্বত দর্শনের বানী প্রচার করবার জন্য শ্রীগুরুদেব এই সন্তদাস নিম্বার্কদর্শন সমিতি স্থাপন করেছেন।
নিম্বার্কদর্শন বহুত্বের মধ্যে একত্ব স্থাপনের দর্শন। বিশ্ব ও বিশ্বাত্মার মধ্যে যুগপৎ ভেদ ও অভেদ সম্বন্ধ, যাকে দ্বৈতাদ্বৈত সিদ্ধান্ত বলে- তার ওপরে এর প্রতিষ্ঠা। এই দর্শনের ভিত্তিতে বিভিন্ন বৈদান্তিক মতবাদ, এমনকি পৃথিবীর বিভিন্ন ধর্মমত মিলিত হতে পারে শান্তি ও আনন্দের পথে জীবন চালনা করার প্রণালী তা সুষ্পষ্টভাবে নির্দেশ করে। এই সমস্ত বিষয় আমাদের বাবাজী মহারাজ তাঁর ‘শ্রীনিম্বার্ক দার্শনিক মতবাদ ও সাধনপ্রণালী’ গ্রন্থে বিস্তৃতরূপে বর্ণনা করেছেন। উক্ত গ্রন্থ পাঠে তৎ সমস্ত উত্তমরূপে জানতে পারবেন।
ধর্মহীন মনুষ্য ধর্মহীন জাতি নির্ভীক হতে পারেনা- কি ইহকালে কি পরকালে ! কোনোকালেই উন্নতি লাভ করতে পারে না, অতএব আজ সর্বতোভাবে ধর্মকেই আমাদের আশ্রয় করতে হবে। তাহলেই আমাদের মৃত্যুভয় ঘুচে যাবে। দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে আমাদের কর্তব্য কি তা আমরা দেখতে পাবো । ধর্মবলে বলীয়ান হয়ে আমরা অভীঃ হয়ে উঠব । ভক্তরাজ প্রহ্লাদের ভাষায় বলতে পারব –
‘ভয়ং ভয়ানামপহারিনি স্থিতে
মনসানন্তে মম কুত্র তিষ্ঠতি।
যস্মিন স্মৃতে জন্ম জরান্তকাদি
ভয়ানি সর্বান্যপযান্তি ত্রাত।’ (বি.পু ১ম অংশ ১০ অ:)
মানবজাতি আজ এক মহান সঙ্কটের সম্মুখীন। সকলেই অনুভব করছে যে, মানব সমাজ এখন যে অবস্থায় রয়েছে তার একটা আমুল পরিবর্তন প্রয়োজন । কিন্তু কোন পথে তা আসবে ? এই প্রশ্নের কি উত্তর, মানুষ এখন দেবে তার ওপর তার ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে । আমাদের প্রধানমন্ত্রী শান্তিবার্তায় তথা ঝঈঙ তথা এ২০ এবং ইজওঈঝ আদি সম্মেলনে বলেছেন “যুদ্ধ নয়।” সংবাদ ও কূটনৈতিক আলোচনায় এর সমাধান। আমাদের বিশিষ্ট নেতারা বলছেন যে, চাই বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে জগৎকে দেখে, বৈজ্ঞানিক বুদ্ধি ও যুক্তি গ্রহণ করে মানবের সকল সমস্যার প্রকৃত সমাধান করতে হবে । আর সমাধান বলতে তারা বোঝেন জনসাধারণ যেন অন্নবস্ত্রের অভাব থেকে মুক্ত হয় । যুদ্ধবিগ্রহ থেকে রক্ষিত হয়ে যেন আপন আপনভাবে জীবনযাত্রা নির্বাহের সুযোগ পায় । এই হচ্ছে প্রকৃত আধনিক গণতান্ত্রিক আদর্শ। ডেমোক্রেসি ।
শ্রীঅরবিন্দ বলেছিলেন, এই আদর্শের মধ্যে সত্য রয়েছে, মানুষের এই সকল সুবিধা সুযোগ করে দিতেই হবে। কিন্তু এই কেবলমাত্র যথেষ্ট নয় । মানুষের জীবনের লক্ষ্য হচ্ছে ক্রমবিকাশের দ্বারা তার চৈতন্যের রূপান্তর সাধন করা । মানস চৈতন্য অতিক্রম করে অতিমানস চৈতন্যের ওপর ওঠা, মানবত্ব ছাড়িয়ে অতিমানবত্ব, দেবত্বে উপনীত হওয়া, দেবত্বের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হওয়া। মানুষ যদি এইভাবে নিজেকে ছাড়িয়ে উঠতে না পারে, অন্তত সেইদিকে অনেকখানি অগ্রসর হতে না পারে তাহলে মানবসমাজের মানবজীবনের অতি জটিল সমস্যাসমূহের কদাচ প্রকৃত সমাধান হবে না ।
এরজন্য যা প্রয়োজন তাহল অন্তর্মুখী হওয়া। আমাদের দেহ, প্রাণ, মন, বুদ্ধি এইসব আমাদের প্রকৃত সত্তা নয়। এমনই আমাদের বাহ্য উপাধি বহিরঙ্গ। এদের পশ্চাতে রয়েছে আত্মা যা আমাদের প্রকৃত সত্তা, তাতে আমরা ভগবানের সাথে এবং অন্যসকল মানবের সঙ্গে এক । আমাদের মধ্যে এই আত্মাকে আবিষ্কার করতে হবে । তাতে সুপ্রতিষ্ঠিত হতে হবে। আত্মার আলোকশক্তিতে আমাদের বাইরের জীবনকে, আমাদের মন প্রাণ দেহ ইন্দ্রিয়সকলকে আমাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক জীবনধারাকে পরিচালিত ও রূপান্তরিত করতে হবে। কিন্তু বৈজ্ঞানিক বুদ্ধি দ্বারা সমাজকে গঠন করতে হবে তা দেহ, মন, প্রাণকে বাহ্য আইনকানুন বিধিনিষেধের দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত করতে চাইবে, মানুষ আর বিকাশের সুযোগ পাবে না। বস্তুতঃ এটাই হয়েছে পাশ্চাত্য সভ্যতার মূলরোগ। এরই চরমরূপ হল ফ্যাসিবাদ, নাৎসিবাদ ও বলশেভিকবাদ
সমাজকে প্রাণময় করতে হলে, সমাজের অন্তর্গত ব্যক্তিমাত্রকেই পূর্ণতম স্বাধীনতা দিতে হবে, যেন তারা আপন আপন দেহ- প্রাণ- মন আপন আপন ভাবে বিকশিত করবার সুযোগ পায় ।
এই সুযোগ একমাত্র নিম্বার্কদর্শনে স্বাভাবিক ভেদাভেদবাদ, দ্বৈতাদ্বৈত দর্শনই দিতে পারবে- এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। এই শান্তির স্বতন্ত্রতার সন্দেশের বার্তা শ্রীনিম্বার্ক ভগবান যুগযুগান্তর ধরে বহন করে আসছেন, আজও করে চলেছেন।