সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগে অনিয়মের অভিযোগ
সিলেটপোস্ট ডেস্ক
প্রকাশিত হয়েছে : ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ১১:৪৯ পূর্বাহ্ণ
ইন্টারভিউ বোর্ডে হাজির হওয়ার সময় ২ ডিসেম্বর বেলা ১১টা। প্রার্থী ড. আজিজুল হক থাকেন দক্ষিণ কোরিয়ায়। সেখানে একটি বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক তিনি। সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় সিকৃবি কর্তৃপক্ষ সেই তথ্য অবগতও। তার আবেদনে এসব তথ্য দেওয়া আছে। সব জেনেও সিকৃবি সেই চাকরিপ্রার্থী আজিজুল হককে ইন্টারভিউ বোর্ডে হাজির হওয়ার মেইল পাঠায় আগের রাত ১২টা ৫২ মিনিট ৫৭ সেকেন্ডে। মাত্র ১০ ঘণ্টার নোটিসে তাকে কোরিয়া থেকে সিলেটে এসে ইন্টারভিউ বোর্ডে হাজির হওয়ার কথা বলা হয়। যেখানে ঢাকা থেকে সিলেটে এসে পৌঁছাতেই এখন রাস্তায় গাড়িতে বসে কাটাতে হয় ১৭ থেকে ২০ ঘণ্টা! সেখানে মাত্র ১০ ঘণ্টা আগে গভীর রাতে প্রার্থীকে ইন্টারভিউ কার্ড পাঠিয়ে বোর্ডে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেওয়ার দায় এড়ানোর বাহানা বলে মন্তব্য করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেকেই। তাদের দাবি, প্রার্থী আগেই ঠিক করে রেখেছেন সিকৃবির ইতিহাসে সবচেয়ে বিতর্কিত ভিসি প্রফেসর ড. আলিমুল ইসলাম। তার পছন্দের প্রার্থীকে নিয়োগ দেওয়ার পথ সুগম করতে ইন্টারভিউ বোর্ডে হাজির হওয়ার সকল পথ বন্ধ রেখে মাত্র ১০ ঘণ্টা আগে কোরিয়ায় থাকা প্রার্থীকে বোর্ডে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। ইন্টারভিউ কার্ডটি পাঠানো হয়েছে উপরেজিস্ট্রার মো. আশরাফুজ্জামানের মেইল থেকে। অথচ এই কার্ডটি ইস্যু করা হয় ২৫ নভেম্বর। এতদিন না পাঠিয়ে ইন্টারভিউয়ের আগের রাতে পাঠানোয় নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। ড. মো. আজিজুল হক সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের এনিমেল অ্যান্ড ফিশ বায়োটেকনোলজি বিভাগের ‘সহযোগী অধ্যাপক’ পদের জন্য আবেদন দিয়েছিলেন। সিকৃবি কর্তৃপক্ষের এ নিয়োগ জালিয়াতি জানাজানি হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ব্যাপক সমালোচনা হয়। বিষয়টি আজিজুল হক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার ফেসবুক আইডিতেও শেয়ার করেন। তিনি এ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়েকে মেইল পাঠিয়ে অভিযোগও করেছেন। সেখানে সঠিক জবাব না পেলে এবং ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে এর বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতের আশ্রয় নেওয়ার কথাও জানান তিনি।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র জানায়, বিভিন্ন বিভাগের একাধিক পদের জন্য গত ২০ ডিসেম্বর একটি জাতীয় গণমাধ্যমে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে সিকৃবি। এর মাত্র ৬ কার্যদিবস পরই ইন্টারভিউয়ের তারিখ দেওয়া হয়। এ নিয়েও ব্যাপক সমালোচিত হন ভিসি প্রফেসর ড. আলিমুল ইসলাম। তাকে বিভিন্ন মহল থেকে আবেদনের তারিখ বাড়ানোর কথা বলা হলেও তিনি তাতে রাজি হননি। রেজিস্ট্রার প্রফেসর ড. মো. আসাদ উদ-দৌলার পরামর্শে তিনি এ কাজটি করছেন। ইন্টারভিউয়ের কার্ডটি তার স্বাক্ষরিত। প্রফেসর, সহযোগী অধ্যাপক, সহকারী অধ্যাপক পদ ছাড়াও পিয়ন পদের জন্যও লোক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। সূত্র দাবি করে, দায়সারাভাবে কাজটি করলেও আগে থেকেই বিভিন্ন পদে পছন্দের প্রার্থীকে ঠিক করে রাখা হয়েছে। এমনকি ময়মনসিংহ কৃষি বিশ^বিদ্যালয়ের একাধিক প্রার্থী যারা ভিসি আলিমুল হকের কাছের মানুষ ও প্রিয়জন হিসেবে পরিচিত তাদের ঠিক করে রেখেই ইন্টারভিউ কল করা হয়। এজন্য বোর্ডে প্রার্থীদের ডাকার বিষয়ে অনৈতিক কৌশলের আশ্রয় নিয়েছেন তিনি।
ড. আজিজুল হক দৈনিক রূপালী বাংলাদেশকে টেলিফোনে জানান, ১ ডিসেম্বর ২০২৫ রাতে বিশ^বিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার অফিস থেকে একটি ই-মেইল পাই। ই-মেইলের বডি সম্পূর্ণ ফাঁকা, শুধু একটি পিডিএফ ফাইল সংযুক্ত ছিল। ফাইলটি খুলে দেখি সেটি আমার ইন্টারভিউ কার্ড। ইন্টারভিউ কার্ডে আমাকে ২ ডিসেম্বর ২০২৫ বেলা ১১টায় লিখিত পরীক্ষা, ডেমো ক্লাস এবং ভাইভার জন্য সিলেট কৃষি বিশ^বিদ্যালয়ে উপস্থিত থাকার নির্দেশনা দেওয়া হয়। তিনি বলেন, আবেদনপত্রে আমি স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছি আমি বর্তমানে দক্ষিণ কোরিয়ার একটি বিশ^বিদ্যালয়ে সহকারী অধ্যাপক পদে কর্মরত। দেশের বাইরে অবস্থানরত কোনো প্রার্থীকে কি একদিনের নোটিশে লিখিত পরীক্ষা, ডেমো ক্লাস ও ভাইভার জন্য উপস্থিত থাকার নির্দেশ দেওয়া যুক্তিযুক্ত? সিলেট কৃষি বিশ^বিদ্যালয় ঠিক তা-ই করেছে। আর আমি বাংলাদেশে অবস্থান করলেও কি এভাবে কয়েক ঘণ্টার নোটিশে গিয়ে হাজির হতে পারতাম? তারা আমার স্থায়ী ঠিকানায়ও কোনো চিঠি বা নোটিশ পাঠায়নি। রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ড. মো. আসাদ-উদ-দৌলা স্বাক্ষরিত ইন্টারভিউ কার্ডটির ইস্যু তারিখ ২৫ নভেম্বর ২০২৫। যদি ইন্টারভিউ কার্ডটি ২৫ নভেম্বর ২০২৫ ইস্যু হয়ে থাকে, তা হলে এতদিন আমাকে এটি কেন পাঠানো হয়নি? তাই প্রশ্ন জাগতেই পারে, এটি কি কোনো পরিকল্পিত প্রক্রিয়ার অংশ, যার মাধ্যমে আমাকে না নেওয়ার পথ তৈরি করা হয়েছে? আজিজুল হক দাবি করেন, যোগ্যতা বিবেচনায় আমি মনে করি, যে পদের জন্য আবেদন করেছি তার জন্য আমি যথাযথভাবে যোগ্য। আমি দক্ষিণ এশিয়ার কৃষি শিক্ষার সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ বাংলাদেশ কৃষি বিশ^বিদ্যালয় থেকে অনার্স ও এমএস সম্পন্ন করেছি। দক্ষিণ কোরিয়া থেকে পিএইচডি এবং পোস্ট-ডক শেষ করে বর্তমানে দক্ষিণ কোরিয়ার নামি বিশ^বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা ও গবেষণায় সক্রিয়ভাবে নিয়োজিত।
এদিকে এ বিষয়ে কথা বলতে চাইলে সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্রফেসর ড. আলিমুল ইসলাম কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। মেইল প্রেরণকারী উপরেজিস্ট্রার মো. আশরাফুজ্জামানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ব্যস্ত আছেন জানিয়ে এ বিষয়ে রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ড. মো. আসাদ-উদ-দৌলার সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। তবে একাধিকবার টেলিফোনে কথা বলার চেষ্টা করা হলেও ড. মো. আসাদ-উদ-দৌলা ফোন রিসিভ করেননি। এমনকি তাকে টেক্সট দিলেও তিনি তার কোনো উত্তর দেননি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক সিনিয়র শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে দাবি করেছেন, ভিসি বিশ্ববিদ্যালয়েকে নিজের পারিবারিক সম্পত্তিতে পরিণত করেছেন। তার এবং তার আস্থাভাজন শিক্ষক-কর্মকর্তাদের দাপট এখন সর্বত্র। সবখানে তাদের এনে বসাচ্ছেন তারা। চলমান নিয়োগ প্রক্রিয়া তারই অংশ।
এ প্রসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার ড. আসাদ উদ-দৌলা বলেন, তথ্যটি সঠিক নয়। ড. আজিজুলকে কার্ড আগেই ডাকে পাঠানো হলেও ইমেইল করা হয়েছিল ৩০ তারিখ বাংলাদেশ সময় রাত সাড়ে ৯টায়। তার গবেষণার অভিজ্ঞতা অনেক উচ্চ কিন্তু তিনি সহযোগী অধ্যাপক পদের জন্য যোগ্য নন। কারণ সাত বছরের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অথবা ১৪ বছরের গবেষণা চাকরির অভিজ্ঞতা বাধ্যতামূলক এবং সহকারী অধ্যাপক পদের জন্যও যোগ্য নন। কারণ এর জন্য ২ বছরের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার অথবা ৪ বছরের গবেষণার অভিজ্ঞতা প্রয়োজন। যদিও তার কোরিয়াতে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে (ইয়ুংনাম বিশ্ববিদ্যালয়) ২ বছর ৯ মাসের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা রয়েছে। সিকৃবি নিয়ম অনুসারে, তিনি একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত থাকায় তার গণনাযোগ্য চাকরিরকাল অর্ধেক অর্থাৎ ১ বছর ৪-৫ মাস আছে। এছাড়াও, তিনি সহযোগী অধ্যাপক পদের জন্য যথাযথ মাধ্যমে আবেদন করেননি বিধায় যোগ্য প্রার্থী ছিলেন না।
সুত্র:রূপালী বাংলাদেশ




