সিলেটপোস্ট২৪রিপোর্ট :বিশ্ববাজারে অস্বাভাবিকভাবে কমছে জ্বালানি তেলের দাম। বুধবার প্রতি ব্যারেল অশোধিত তেলের দাম ছিল ৩৬ ডলার। দেশীয় মুদ্রায় যা ২ হাজার ৮৮০ টাকা। এ হিসেবে প্রতি লিটারের দাম পড়ে ১৮ টাকা। জ্বালানি তেলের এ দাম গত ১২ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। এর আগে ২০০৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রতি ব্যারেল তেলের দাম ছিল ৩৫ ডলার।
বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় মার্চেন্ট ব্যাংক গোল্ডম্যান সাক্সের বিশ্লেষকরা বলছেন, তিন কারণে জ্বালানি তেলের এ দরপতন। অর্থনৈতিক মন্দায় লাতিন আমেরিকা, জাপান ও ইউরোপে তেলের চাহিদা কমছে। বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্র ইরানের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ায় তেলের উৎপাদনও বেড়েছে। এছাড়া ইরাক ও সিরিয়ার বড় বড় তেলক্ষেত্রগুলো আইএস জঙ্গিদের নিয়ন্ত্রণে। এ কারণে অবৈধভাবে বাজারে আসছে প্রচুর তেল। প্রতিষ্ঠানটি পূর্বাভাস দিচ্ছে ২০২০ সালের আগে তেলের দাম আর ৫০ ডলারের ওপরে যাবে না। তবে দাম কমলেও উৎপাদন না কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে তেল রফতানিকারক দেশগুলোর সংগঠন ওপেক। সংস্থাটির যুক্তি, উৎপাদন কমালে তেলের বাজার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাতে চলে যেতে পারে।
বিশ্ববাজারে অব্যাহতভাবে কমলেও আপাতত তেলের দাম সমন্বয়ের কথা ভাবছে না সরকার। তবে বিশ্লেষকদের অনেকেই বলছেন, সরকারের উচিত দাম সমন্বয় করা। তা হলে দ্রব্যমূল্য ও উৎপাদন খরচে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। বিনিয়োগ বাড়বে। আন্তর্জাতিক এনার্জি এজেন্সি (আইইএ) রিপোর্টে দেখা গেছে, ২০০৮ সালের জুলাইয়ে প্রতি ব্যারেল জ্বালানি তেলের দাম ছিল ১৪৭ ডলার। এটিই ছিল তেলের দামের সর্বোচ্চ রেকর্ড। তবে পরের বছরের ফেব্রুয়ারিতে তা কমে ৪৩ ডলারে নেমে আসে। এরপর আবারো বাড়তে থাকে তেলের দাম। গত বছরের জুনে তা ১০৮ ডলারে উন্নীত হয়। এরপর শুরু হয় টানা দরপতন। বুধবার তা ৩৬ ডলারে নেমে আসে। এ হিসেবে দেড় বছরে দাম এক-তৃতীয়াংশে নেমে এসেছে।
গোল্ডম্যান সাক্স বলেছে, তেলের দাম অদূর ভবিষ্যতে বাড়লেও তা আগের পর্যায়ে উঠবে না। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র ইরানের ওপর থেকে বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছে। ফলে ইরান এখন জোরেশোরে তেল বিক্রি শুরু করেছে।
বাংলাদেশে বিভিন্ন ধরনের জ্বালানি তেলের চাহিদা ৫৪ লাখ ৮৪ হাজার ৯৬৬ মেট্রিক টন। এর মধ্যে ডিজেল বেশি ব্যবহৃত হয়। ডিজেলের চাহিদা ৩২ লাখ ৪২ হাজার ৫৫৪ মেট্রিক টন। বাংলাদেশের তেলের দাম নিয়ে একটি ফর্মুলা তৈরি করেছে বিশ্বব্যাংক। বুধবারের আন্তর্জাতিক বাজার মূল্য অনুযায়ী এক লিটার অশোধিত তেলের দাম ১৮ টাকা। বাংলাদেশে এর সঙ্গে যোগ হয় আমদানি ভাড়া, শুল্ক, ইন্স্যুরেন্সের প্রিমিয়াম এবং পরিশোধন ব্যয়। আর বিশ্বব্যাংকের ওই ফর্মুলা অনুসারে এসব কিছু যোগ করে প্রতি লিটারের দাম পড়বে ৪০ টাকার মতো। আর সরকার এটা বিক্রি করছে ৬৮ টাকা। অর্থাৎ বর্তমান দামের তেল বাজারে প্রতি লিটার ডিজেলে সরকারের মুনাফা হবে ২৮ টাকার মতো। এদিকে ইরানের সঙ্গেও তেল আমদানি নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গেও সহজ শর্তে চুক্তি হওয়ার কথা আছে। তাতে তেলের দাম শিগগিরই বাড়ার কোনো আশঙ্কা নেই।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. বিরুপাক্ষ পাল বলেন, বিনিয়োগের জন্য অন্যতম উপাদান হল জ্বালানি তেল। আর বর্তমানে বিশ্ববাজারের সঙ্গে জ্বালানি তেলের দামের ব্যবধান অনেক বেশি। এটি সমন্বয় করা উচিত। এতে বিনিয়োগ বাড়বে। তিনি বলেন, জ্বালানি তেলের দাম কমালে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় কমবে। আর নিত্যপণ্যের দাম কমলে মানুষের ভোগও বাড়বে। বিরুপাক্ষ পাল বলেন, বিশ্বের অনেক দেশ আছে, যারা মূল্যস্ফীতি কমিয়ে অভ্যন্তরীণ চাহিদা বৃদ্ধির মাধ্যমে অর্থনীতিকে শক্তিশালী করেছে।
সরকার বলছে, জ্বালানি তেলের দাম কমানোর আপাতত কোনো সম্ভাবনা নেই।
এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিষয়ক উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই ইলাহী চৌধুরী বলেন, জ্বালানি তেলের দাম কমালে জিনিসপত্রের দাম কমবে এই নিশ্চয়তা দরকার। না হলে দাম কমিয়ে ভোক্তার কাছে সুফল পৌঁছানো যাবে না।
তিনি বলেন, বিশ্বের অনেক দেশে জ্বালানির চাহিদা বাড়ছে। তবে সরবরাহও করছে অনেক দেশ। ফলে বিষয়টি ভাবার দরকার আছে। তার মতে, বর্তমানে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম কম। তবে দীর্ঘ মেয়াদে এই কম দাম থাকবে, এটি নিশ্চিত হওয়ার পরই কেবল দাম সমন্বয়ের ব্যাপারে চিন্তা করা যাবে।
জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে তো বটেই অন্য যে কোনো দিক বিচার করলে জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয় করা উচিত। তবে দাম কতটুকু সমন্বয় করা হবে তা নিয়ে আলাপ-আলোচনা হতে পারে। এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক বাজার পরিস্থিতি মাথায় রেখে প্রতি ৩ মাস পরপর জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয় করার একটি পলিসি নিয়ে সরকার চিন্তা-ভাবনা করতে পারে।