মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান :
‘ভালবাসা দিবস’কে কেন্দ্র করে সারা পৃথিবী উন্মাতাল হয়ে উঠে। বাজার ছেয়ে যায় নানাবিধ উপহারে। পার্ক ও হোটেল- রেস্তোরাঁগুলো সাজানো হয় নতুন সাজে। পৃথিবীর প্রায় সব বড় শহরেই ‘ভ্যালেন্টাইনস ডে’-কে ঘিরে পড়ে যায় সাজ সাজ রব। পশ্চিমা দেশগুলোর পাশাপাশি প্রাচ্যের দেশগুলোতেও এখন ঐ অপসংস্কৃতির মাতাল ঢেউ লেগেছে। হৈ চৈ, উন্মাদনা, ঝলমলে উপহার সামগ্রী, প্রেমিক যুগলের চোখেমুখে থাকে বিরাট উত্তেজনা। হিংসা-হানাহানির যুগে ভালবাসার এই দিনকে! প্রেমিক যুগল তাই উপেক্ষা করে সব চোখ রাঙানি। বছরের এ দিনটিকে তারা বেছে নিয়েছে হৃদয়ের কথকতার কলি ফোটাতে।
ভালোবাসা। একটি অভিব্যক্তির নাম। এই অভিব্যক্তির শক্তি টিকিয়ে রেখেছে বিশ্বসভ্যতা, কাল হতে কালান্তর ধরে। মানব শিশু পৃথিবীর আলোতে আসার আগে যখন মাতৃগর্ভে ধীরে ধীরে বেড়ে উঠে, তখন থেকেই তাকে ঘিরে চলে ভালোবাসার নানান আয়োজন। পৃথিবীর আলোতে চোখ মেলে ওয়া-ও-ওয়া-ও কান্না করার সাথে সাথে তার স্থান হয়, ভালোবাসার শীতলছায়া মায়ের কোলে। এ ভালোবাসার নাম স্নেহ। মা-বাবা, ভাইবোন,আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীর সাথে তার গড়ে ওঠে ভালোবাসার বন্ধন। তার আধো আধো বুলির প্রভাবে তাকে ঘিরে গড়ে ওঠে স্নেহের বলয়। এই শিশু পথ-পরিক্রমায় কিশোর, যুক, প্রবীণ এর সীমা ছাড়িয়ে সামনে এগুতে থাকে। সেও ভালোবাসার আকর্ষণ সৃষ্টি করে তার নিজের মাঝে। মায়ের ভালোবাসা, স্নেহের প্রতিদানে সেও মাকে ভালোবাসে। এ ভালোবাসার নাম শ্রদ্ধা। বুদ্ধি বাড়ার সাথে সাথে তার ভালোবাসার পরিধিও বাড়ে। মা, বাবা, ভাইবোন, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী সবার সাথে গড়ে ওঠে ভালোবাসার বন্ধন। শুধু শ্রেণীমত পরিবর্তন হয় ভালোবাসার প্রকার। কোথাও তার নাম শ্রদ্ধা, কোথাও স্নেহ আর কোথাও বা প্রেম। ভালোবাসার আকর্ষণ হতে সে কখনও বিচ্ছিন্ন হয় না। বিবাহ বন্ধনের মাধ্যমে স্বামী-স্ত্রীরূপী মানব-মানবীর মধ্যে গড়ে ওঠে ভালোবাসা। এ ভালোবাসার নাম প্রেম। প্রেমময় নীড়ই ভালো+বাসা (ভালো বাড়ি)। শুধু ইট পাথরের গড়া কারুকার্যময় বাসাই ভালো বাসা নয়। প্রেম ও প্রীতির বন্ধনে ভরা খড় কুটোয় গড়া বাসাও ভালোবাসা (বাসা/বাড়ি)। এ ভালোবাসা দেখা যায় না। কিন্তু অনুভব করা যায়। পৃথিবীতে এমন অনেক কিছুই আছে যা দেখা যায় না, শুধু অনুভব করা যায়। কিন্তু এ সবের অনুপস্থিতি পৃথিবীতে বিপর্যয় ডেকে আনে। যেমন মহাকর্ম ও মাধ্যকর্ষণ বল আমরা কেউ দেখি না। কিন্তু এই বলের অস্তিত্ব আছে বলেই টিকে আছে মহাবিশ্ব। আল্লাহ-রাব্বুল আলামীন এ বল উঠিয়ে নিলে শুরু হবে মহাপ্রলয় বা কিয়ামত। কিয়ামত সংগঠিত করতে অন্য কোনো বড় আয়োজনের প্রয়োজন নেই।
শুধু আল্লাহর আদেশে এই বল নিষ্ক্রিয় হলেই এক মুহূর্তের মধ্যে উলট-পালট হয়ে যাবে সাজানো-গুছানো এই মহাবিশ্ব। মানব-মানবী ও প্রাণিজগতের মধ্যে মহাকর্ষ ও মাধ্যকর্ষণ বলের মতোই ক্রিয়াশীল ভালোবাসার নাম বল বা শক্তি। যদি কোনো নির্দিষ্ট দিনের জন্য মহাকর্ষ ও মাধ্যকর্ষ বলের ক্রিয়াকে নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়, তবে কি এ মহাবিশ্ব টিকে থাকবে না? অবশ্যই থাকবে না, মহাবিশ্বকে টিকিয়ে রাখার জন্য সব সময় এ বলের উপস্থিতি প্রয়োজন। অনুরূপভাবে ভালোবাসাকেও কোনো নির্দিষ্ট দিনের ফ্রেমেবন্দী করলে এ সভ্যতাও হারিয়ে যাবে। তারপরও কেন ১৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব ভালোবাসা দিবস। কেন ভ্যালেন্টাইনস ডে উদযাপন? এ দিনটির সাথে আমাদের সভ্যতা সংস্কৃতিরই বা কি সম্পর্ক। অবশ্যই কোনো সম্পর্ক নেই। তারপরও সাত-পাঁচ না ভেবে এ দেশের মানুষ এ দিনটিকে নিয়ে মাতামাতিতে মেতে উঠে। বাংলাদেশে এই দিবসটি আমদানি করেছে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা। পত্রিকাটিতে ভ্যালেন্টাইনস ডে-এর যে ইতিহাস বর্ণনা করা হয় তা থেকেও জানা যায়, এ দিনের ইতিহাসের সাথে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই। সম্মানিত পাঠকদের উদ্দেশ্যে পত্রিকাটির বর্ণনা তুলে ধরা হলো। “মধ্য আশির দশকে পৃথিবী জুড়ে সেন্ট ভ্যালেনটাইনস ডে ব্যাপকভাবে প্রচলিত হয়। তবে তা শুরু হয়েছে অনেক বছর আগে। এর ইতিহাস খুঁজতে গিয়ে অনেক ধরনের অনেক কাহিনীর কথা জানা যায়। প্রধান যে কাহিনীটি প্রচলিত আছে তা হলো রোমান খ্রিস্টান পাদরি বা সেন্টের কাহিনী অনুসারে তার নাম সেন্ট ভ্যালেনটাইন। তিনি ছিলেন একজন পাদরি এবং একই সঙ্গে চিকিৎসক। কিন্তু সে সময় রোমানদের দেব-দেবী পূজার বিষয়টি ছিল মুখ্য। তারা খ্রিস্টান ধর্মে বিশ্বাসী ছিল না। খ্রিস্টান ধর্ম প্রচারের অভিযোগে ২৭০ খ্রিস্টাব্দে রোমের সম্রাট দ্বিতীয় ক্লডিয়াসের আদেশে ভ্যালেনটাইনের মৃত্যুদ- দেয়া হয়। তিনি যখন জেলে বন্দী ছিলেন তখন ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা তাকে ভালোবাসার কথা জানিয়ে জেলের জানালা দিয়ে চিঠি ছুঁড়ে দিতো। বন্দী অবস্থাতেই সেন্ট ভ্যালেনটাইন জেলারের অন্ধ মেয়ের চিকিৎসা করে দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দেন। মেয়েটির সঙ্গে তার যোগাযোগ ঘটে। মৃত্যুদ-ের আগে মেয়েটিকে লেখা এক চিঠিতে জানান, ফ্রম ইওর ভ্যালেনটাইন। অনেকের মতে, সেন্ট ভ্যালেনটাইনের নাম অনুসারেই পোপ জুলিয়াস ৪৯৬ খ্রিস্টাব্দে ১৪ ফেব্রুয়ারিকে সেন্ট ভ্যালেনটাইন ডে হিসেবে ঘোষণা করেন। আরো একজন ভ্যালেনটাইনের নাম পাওয়া যায় ইতিহাসে। রোমান সম্রাট ক্লডিয়াস যুবকদের বিয়ে করতে নিষেধ করেন যুদ্ধের জন্য ভালো সৈন্য সংগ্রহের উদ্দেশ্যে। কিন্তু এই ভ্যালেনটাইন নিয়ম ভেঙে প্রেম করেন। তারপর আইন ভেঙ্গে বিয়ে করেন। ফলে তার মৃত্যুদ- হয়।
এরপরও বহু বছর আগে থেকে রোমানদের দু’টি প্রথা চালু ছিল প্রেম-বিয়ে এবং সন্তান উৎপাদন ক্ষমতা বিষয়ে উৎসবের জন্য। হুপারকালিয়া এসব উৎসবের অন্যতম। এটি অনুষ্ঠিত হতো ১৫ ফেব্রুয়ারিতে। দেবতা হুপারকাস রোম শহরকে রক্ষা করতেন নেকড়ের আক্রমণ থেকে অনুষ্ঠানের দিন তরুণরা প্রায় নগ্ন হয়েই দৌড়াদৌড়ি করতো এবং নববিবাহিতারা তাদের চাবুক দিয়ে পেটাতো। তরুণীরা মনে করতো এতে সন্তান উৎপাদন সহজ হবে। কেননা এটি ছিল সন্তান উৎপাদনের উৎসব। ১৫ ফেব্রুয়ারি এটি হতো। এর আগের দিন ১৪ ফেব্রুয়ারি তরুণ-তরুণীরা নাচের পার্টনার লটারীর মাধ্যমে নির্বাচিত করতো। ৪০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে দু’দিনের উৎসবের সময় কমিয়ে একদিন ১৪ ফেব্রুয়ারি পালন করা হতো। অনেকে মনে করতো ১৪ ফেব্রুয়ারি পাখিরা পার্টনার বেছে নেয়। ফলে এ দিনটি সবচেয়ে উপযুক্ত। এ দিনটি পালনের ক্ষেত্রে দেখা যায়, রোমানরা বক্সের ভিতর নাম লেখে লটারী করে তাদের প্রিয়তম বা প্রিয়তমা নির্বাচন করতো। ১৭০০ সালের দিকে ইংরেজ রমনীরা কাগজে তাদের পরিচিত পুরুষদের নাম লিখে পানিতে ছুঁড়ে মারতো কাঁদা মাটিতে মিশিয়ে। যার নাম প্রথমে ভেসে উঠতো সেই হয় তো প্রকৃতপ্রেমিক। ষোড়শ শতাব্দী থেকে কাগজের কার্ড বিনিময় শুরু হয়। (যায়যায়দিন, ১৩ ফেব্রুয়ারি-২০০১)
উল্লিখিত ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ‘ভ্যালেনটাইনস ডে,’ সার্বজনীন উদযাপনযোগ্য কোনো বিষয় নয়। পশ্চিমা বিশ্বকে অন্ধভাবে অনুসরণ করতে গিয়ে মুসলমানদের মধে অধূনা ‘ভ্যালেনটাইন ডে’ এর হাওয়া লেগেছে। বাংলাদেশের অনেক তরুণ-তরুণীও এ ফাঁদে পা দিয়ে অর্থ, শ্রম সময় নষ্টের সাথে সাথে হারিয়ে যাচ্ছে অপসংস্কৃতির অন্ধকারে। পশ্চিমারা কেন বিশ্বব্যাপী ভ্যালেনটাইনস ডে-এর মহিমা প্রচার করছে? বিষয়টি গভীরভাবে ভেবে দেখলে যে বিষয়টি ধরা পড়ে তা হলোÑ ‘ব্যবসা’। কত কিছুর নাম ভাঙ্গিয়েইতো পৃথিবীতে ব্যবসা চলছে। এমনকি ধর্মের মতো পবিত্র জিনিস নিয়েও কি কম ব্যবসা হয়েছে? ইউরোপের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় মধ্যযুগে খ্রিস্টান পাদরিরা মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাসকে পুঁজি করে প্রতিটি গির্জাকে পরিণত করেছিল ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে। তাদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ মানুষ রেনেসাঁ বা পুনর্জাগরণের নামে গির্জার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল। তাদের অপকর্মের প্রভাবেই ষোড়শ’ শতাব্দীতে সেক্যুলারিজম নামের ধর্মহীন মতবাদের জন্ম হয়েছে। জন্ম হয়েছে পুঁজিবাদী অর্থ ব্যবস্থার। রাষ্ট্র ব্যবস্থা থেকে ধর্মের নির্বাসন বলতে গেলে ঐ সব খ্রিস্টান ধর্ম ব্যবসায়ীদের অপকর্মেরই ফল। ভ্যালেনটাইন ডে উদযাপনের জন্য যেসব উপকরণ অত্যাবশ্যকীয় তার মধ্যে রয়েছে ফুল, কার্ড, চকলেট। হাইফাইভাবে যারা উদযাপন করেন তাদের উপকরণের তালিকায় উল্লিখিত উপকরণছাড়াও মদ, মাংস, নাচ-গান যোগ হয়। তারা ভালোবাসার নামে এক দিনের জন্য ভেসে যান আদিম বর্বরতায়। ভালোবাসাহীন কামনার খেলায় মেতে উঠে তারা। এসব কামনার উপকরণের যোগানদার ব্যবসায়ীরা বিশ্বব্যাপী জমজমাট বাজার গড়ে তুলতেই চোখ ধাঁধানো প্রচারণার ফাঁদ পাতে। আর বোকার হদ্দ কামুকরা ঐ ফাঁদে পা দিয়ে নিজেদের ভাগ্যবান মনে করে।
‘ভ্যালেন্টাইনস ডে’র ইতিহাস প্রাচীন। এর সূচনা প্রায় ১৭শ’ বছর আগের পৌত্তলিক রোমকদের মাঝে প্রচলিত ‘আধ্যাত্মিক ভালবাসা’র মধ্য দিয়ে। এর সাথে কিছু কল্পকাহিনী জড়িত ছিল, যা পরবর্তীতে রোমীয় খৃষ্টানদের মাঝেও প্রচলিত হয়। ভ্যালেনটাইন ডে সম্পর্কে বিভিন্ন বর্ণনা পাওয়া যায়। যেমন- ১. রোমের সম্রাট দ্বিতীয় ক্লডিয়াস-এর আমলের ধর্মযাজক সেন্ট ভ্যালেনটাইন সম্রাটের খৃষ্টধর্ম ত্যাগের আহবান প্রত্যাখ্যান করলে ২৭০ খৃস্টাব্দের ১৪ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রীয় আদেশ লঙ্ঘনের অভিযোগে তাকে মৃত্যুদন্ড প্রদান করা হয়। ২. ১৪ই ফেব্রুয়ারি রোমকদের লেসিয়াস দেবীর পবিত্র দিন। এদিন তিনি দু’টি শিশুকে দুধ পান করিয়েছিলেন। যারা পরবর্তীতে রোম নগরীর প্রতিষ্ঠাতা হয়েছিল। ৩. ১৪ই ফেব্রুয়ারি রোমানদের বিবাহ দেবী ‘ইউনু’-এর বিবাহের পবিত্র দিন। ৪. রোম সম্রাট ক্লডিয়াস তার বিশাল সেনাবাহিনী গঠন করতে গিয়ে যখন এতে বিবাহিত পুরুষদের অনাসক্ত দেখেন, তখন তিনি পুরুষদের জন্য বিবাহ নিষিদ্ধ করে ফরমান জারি করেন। কিন্তু জনৈক রোমান বিশপ সেন্ট ভ্যালেন্টাইন এটাকে প্রত্যাখ্যান করেন ও গোপনে বিয়ে করেন। সম্রাটের কানে এ সংবাদ গেলে তাকে গ্রেফতার করা হয় এবং ২৬৯ খৃষ্টাব্দের ১৪ ফেব্রুয়ারিতে তার মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়। সেদিন থেকে দিনটি ভালবাসা দিবস হিসাবে কিংবা এ ধর্মযাজকের নামানুসারে ‘ভ্যালেন্টাইন ডে’ হিসাবে পালিত হয়ে আসছে।
পশ্চিমা দেশগুলোতে প্রেমিক-প্রেমিকাদের মধ্যে এ দিনে বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন, এমনকি পরিবারের সদস্যদের মধ্যেও উপহার বিনিময় হয়। উপহার সামগ্রীর মধ্যে আছে পত্র বিনিময়, খাদ্যদ্রব্য, ফুল, বই, ছবি, ‘ইব সু াধষবহঃরহব’ (আমার ভ্যালেন্টাইন হও), প্রেমের কবিতা, গান, শ্লোক লেখা কার্ড প্রভৃতি। গ্রীটিং কার্ডে, উৎসব স্থলে অথবা অন্য স্থানে প্রেমদেব (ঈঁঢ়রফ)-এর ছবি বা মূর্তি স্থাপিত হয়। সেটা হ’ল একটি ডানাওয়ালা শিশু, তার হাতে ধনুক এবং সে প্রেমিকার হৃদয়ের প্রতি তীর নিশান লাগিয়ে আছে। এ দিন স্কুলের ছাত্ররাও তাদের ক্লাসরুম সাজায় এবং অনুষ্ঠান করে।
এ দিনে পালিত বিচিত্র অনুষ্ঠানাদির মধ্যে একটি হচ্ছে, দু’জন শক্তিশালী পেশীবহুল যুবক গায়ে কুকুর ও ভেড়ার রক্ত মাখত। অতঃপর দুধ দিয়ে তা ধুয়ে ফেলার পর এ দু’জনকে সামনে নিয়ে বের করা হ’ত দীর্ঘ পদযাত্রা। এ দু’যুবকের হাতে চাবুক থাকত, যা দিয়ে তারা পদযাত্রার সামনে দিয়ে অতিক্রমকারীকে আঘাত করত। রোমক রমণীদের মাঝে কুসংস্কার ছিল যে, তারা যদি এ চাবুকের আঘাত গ্রহণ করে, তবে তারা বন্ধ্যাত্ব থেকে মুক্তি পাবে। এ উদ্দেশ্যে তারা এ মিছিলের সামনে দিয়ে যাতায়াত করত। ১৮শ’ শতাব্দী থেকেই শুরু হয়েছে ছাপানো কার্ড প্রেরণ। এ সব কার্ডে ভাল-মন্দ কথা, ভয়-ভীতি আর হতাশার কথাও থাকত। ১৮শ’ শতাব্দীর মধ্য ভাগ থেকে উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে যে সব কার্ড ভ্যালেন্টাইন ডে’তে বিনিময় হ’ত তাতে অপমানজনক কবিতাও থাকত। সবচেয়ে যে জঘন্য কাজ এ দিনে করা হয়, তা হ’ল ১৪ ফেব্রুয়ারি মিলনাকাঙ্ক্ষী অসংখ্য যুগলের সবচেয়ে বেশী সময় চুম্বনাবদ্ধ হয়ে থাকার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হওয়া। আবার কোথাও কোথাও চুম্বনাবদ্ধ হয়ে ৫ মিনিট অতিবাহিত করে ঐ দিনের অন্যান্য অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে থাকে। ভালবাসায় মাতোয়ারা থাকে ভালবাসা দিবসে রাজধানীসহ দেশের বড় বড় শহরগুলো। পার্ক, রেস্তোরাঁ, ভার্সিটির করিডোর, টিএসসি, ওয়াটার ফ্রন্ট, ঢাবির চারুকলার বকুলতলা, আশুলিয়া- সর্বত্র থাকে প্রেমিক-প্রেমিকাদের তুমুল ভিড়। ‘সেন্ট ভ্যালেন্টাইন ডে’ উপলক্ষে অনেক তরুণ দম্পতিও হাযির হয় প্রেমকুঞ্জগুলোতে।
‘ভ্যালেন্টাইনস ডে’ উদ্যাপন উপলক্ষে দেশের নামী-দামী হোটেলের বলরুমে বসে তারুণ্যের মিলন মেলা। ‘ভালবাসা দিবস’-কে স্বাগত জানাতে হোটেল কর্তৃপক্ষ বলরুমকে সাজান বর্ণাঢ্য সাজে। নানা রঙের বেলুন আর অসংখ্য ফুলে স্বপ্নিল করা হয় বলরুমের অভ্যন্তর। জম্পেশ অনুষ্ঠানের সূচিতে থাকে লাইভ ব্যান্ড কনসার্ট, ডেলিশাস ডিনার এবং উদ্দাম নাচ। আগতদের সিংহভাগই অংশ নেয় সে নাচে। ঘড়ির কাটা যখন গিয়ে ঠেকে রাত দু’টার ঘরে তখন শেষ হয় প্যান প্যাসেফিক সোনারগাঁও হোটেলের ‘ভালবাসা দিবস’ বরণের অনুষ্ঠান। ঢাবির টিএসসি এলাকায় প্রতি বছর এ দিবসে বিকেল বেলা অনুষ্ঠিত হয় ভালবাসা র্যালি। এতে বেশ কিছু খ্যাতিমান দম্পতির সাথে প্রচুর সংখ্যক তরুণ-তরুণী, প্রেমিক-প্রেমিকা যোগ দেয়। প্রেমের কবিতা আবৃত্তি, প্রথম প্রেম, দাম্পত্য এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিক বিষয়াদির স্মৃতি চারণে অংশ নেয় তারা।
আমাদের দেশের এক শ্রেণীর তরুণ-তরুণী, যুবক-যুবতী এমনকি বুড়া-বুড়িরা পর্যন্ত নাচতে শুরু করে! তারা পাঁচতারা হোটেলে, পার্কে, উদ্যানে, লেকপাড়ে, বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় আসে ভালবাসা বিলাতে, অথচ তাদের নিজেদের ঘর-সংসারে ভালবাসা নেই! আমাদের বাংলাদেশী ভ্যালেন্টাইনরা যাদের অনুকরণে এ দিবস পালন করে, তাদের ভালবাসা জীবনজ্বালা আর জীবন জটিলতার নাম; মা-বাবা, ভাই-বোন হারাবার নাম; নৈতিকতার বন্ধন মুক্ত হওয়ার নাম। তাদের ভালবাসার পরিণতি ‘ধর ছাড়’ আর ‘ছাড় ধর’ নতুন নতুন সঙ্গী। তাদের এ ধরা-ছাড়ার বেলেল্লাপনা চলতে থাকে জীবনব্যাপী। বর্তমান অবাধ তথ্য প্রবাহের যুগে স্যাটেলাইটের কল্যাণে মুসলিম সমাজ পশ্চিমা সংস্কৃতির অনুসরণ করছে। নিজেদের স্বকীয়তা-স্বাতন্ত্র্যকে ভুলে গিয়ে, ধর্মীয় অনুশাসনকে উপেক্ষা করে তারা আজকে প্রগতিশীল হওয়ার চেষ্টা করছে। ফলে তাদের কর্মকান্ডে মুসলিম জাতির উঁচু শির নত হচ্ছে। অথচ এটা বহুপূর্বে রাসূল (ছাঃ) নিষেধ করে গেছেন।
ছাহাবী আবু অকেদ (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) খায়বার যাত্রায় মূর্তিপূজকদের একটি গাছ অতিক্রম করলেন। তাদের নিকট যে গাছটির নাম ছিল ‘জাতু আনওয়াত’। এর উপর তীর টানিয়ে রাখা হ’ত। এ দেখে কতক ছাহাবী রাসূল (ছাঃ)-কে বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের জন্যও এমন একটি ‘জাতু আনওয়াত’ নির্ধারণ করে দিন। রাসূল (ছাঃ) ক্ষোভ প্রকাশ করলেন, ‘সুবহানাল্লাহ, এ তো মূসা (আঃ)-এর জাতির মত কথা। আমাদের জন্য একজন প্রভু তৈরি করে দিন, তাদের প্রভুর ন্যায়। আমি নিশ্চিত, আমি আল্লাহর শপথ করে বলছি, তোমরা পূর্ববর্তীদের আচার-অনুষ্ঠানের অন্ধানুকরণ করবে’ (মিশকাত হা/৫৪০৮)। অন্য হাদীছে রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি যে জাতির অনুকরণ করবে, সে ব্যক্তি সেই জাতিরই একজন বলে গণ্য হবে’ (আবূ দাঊদ হা/৪০৩১)।
মানুষের অন্তর যদিও অনুকরণপ্রিয়, তবুও মনে রাখতে হবে ইসলামী দৃষ্টিকোণ বিচারে এটি গর্হিত, নিন্দিত। বিশেষ করে অনুকরণীয় বিষয় যদি হয় আক্বীদা, ইবাদত, ধর্মীয় আলামত বিরোধী, আর অনুকরণীয় ব্যক্তি যদি হয় বিধর্মী, বিজাতী। দুর্ভাগ্য যে, মুসলমানরা ক্রমশ ধর্মীয় আচার, অনুষ্ঠান ও বিশ্বাসে দুর্বল হয়ে আসছে এবং বিজাতীদের অনুকরণ ক্রমান্বয়ে বেশি বেশি আরম্ভ করছে। যার অন্যতম ১৪ ফেব্রুয়ারি বা ভালবাসা দিবস। মুসলমানদের জন্য এসব বিদস পালন জঘন্য অপরাধ। অনেক লোক অবচেতনভাবেই এ সকল অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে, অথচ তারা জানেও না, কত বড় অপরাধ তারা করে যাচ্ছে। শিরক ও কুফরে লিপ্ত ব্যক্তিদের শুভেচ্ছা জানাচ্ছে, ধন্যবাদ দিচ্ছে। এভাবে আল্লাহর শাস্তিতে নিপতিত হচ্ছে। মুসলমানদের সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন ও কাফিরদের সাথে সম্পর্ক ছেদন হচ্ছে মুসলমানদের একটি বৈশিষ্ট্য। সুতরাং আমাদের উচিত ও কর্তব্য, মুসলমানদের মুহাববত করা, কাফিরদের ঘৃণা করা, তাদের সাথে বৈরিভাব পোষণ করা, তাদের আচার-অনুষ্ঠান প্রত্যাখ্যান করা। এতেই আমরা নিরাপদ, এখানেই আমাদের কল্যাণ, অন্যথা সমূহ ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে।
কেউ কেউ হয়তো বলবে, আমরা তাদের আক্বীদা বিশ্বাস গ্রহণ করি না, শুধু আপোষে মুহাববত, ভালবাসা তৈরি করার নিমিত্তে এ দিনটি পালন করি। অথচ এর মাধ্যমে সমাজে অশ্লীলতা ছড়ায়, ব্যভিচার প্রসার লাভ করে। একজন সতী-সাধ্বী পবিত্র মুসলিম নারী বা পুরুষ এ ধরনের নোংরামির সাথে কখনো জড়িত হ’তে পারে না। এ দিনটি উদ্যাপন কোন স্বভাব সিদ্ধ ব্যাপার নয়। বরং একজন ছেলেকে একজন মেয়ের সাথে সম্পর্ক জুড়ে দেয়ার পাশ্চাত্য কালচার আমদানিকরণ। আমরা জানি, তারা সমাজকে চারিত্রিক পদস্খলন ও বিপর্যয় হ’তে রক্ষা করার জন্য কোন নিয়ম-নীতির ধার ধারে না। যার কুৎসিত চেহারা আজ আমাদের সামনে স্পষ্ট। তাদের অশালীন কালচারের বিপরীতে আমাদের অনেক সুষ্ঠু-শালীন আচার-অনুষ্ঠান রয়েছে। মুসলিম সমাজে এক সময় নীতি-নৈতিকতার মূল্য ছিল সীমাহীন। লজ্জাশীলতা ও শুদ্ধতা ছিল এ সমাজের অলংকার। কোন অপরিচিত মেয়ের সাথে রাস্তায় বের হবার চেয়ে পিঠে বিশাল ভার বহন করা একটা ছেলের জন্য ছিল অধিকতর সহজ। আর মেয়েদের ক্ষেত্রে তা চিন্তা করারও অবকাশ ছিল না। অথচ সেই অবস্থা থেকে আজ আমরা কোথায় এসে পৌঁছেছি! এটা হচ্ছে ‘ভ্যালেন্টাইনস ডে’-র মত বেলেল্লাপনার কুফল। এসবের দ্বারা সরল, পুণ্যবান, নিষ্কলঙ্ক মানুষ বিপথগামী হচ্ছে। সাধারণ স্বতঃসিদ্ধ হলো ভালোবাসা কোনো নির্দিষ্ট স্থান কাল সময়ে বন্দী নয়। ভালোবাসা সব সময়ের। অর্থাৎ প্রতিদিন প্রতিক্ষণ ভালোবাসাকে যারা ধরে রাখতে পারেন তারাই সত্যিকার ভালো প্রেমিক। তাদের জীবনে বাসা বাঁধে সুখ। অতএব আসুন সেøাগান তুলি “ভালোবাসা প্রতিদিন প্রতিক্ষণ, তবে কেন ভ্যালেনটাইনস দিন উদযাপন।” আসুন এ বিশ্বকে সুন্দর করতে ভালোবাসাকে নির্দিষ্ট দিনের জন্য না রেখে প্রতিদিন ভালোবাসি।
লেখক ঃ শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক ও কলামিষ্ট