সিলেটপোস্ট রিপোর্ট : দেশের মোট শ্রমশক্তি বা শ্রমিকের সংখ্যা ৫ কোটি। এর মধ্যে ৪ কোটি শ্রমিকই তার ন্যূনতম অধিকার থেকে বঞ্চিত। যে এক কোটি শ্রমিক নিজের অধিকার আদায় করতে পারছে তাও যৎসামান্য।
আর অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিক বা গৃহশ্রমিক, কৃষিশ্রমিক, দিনমজুর-এদের অনেকেই জানে না কী তার অধিকার। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে কঠোর পরিশ্রম করেও আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) বিধান অনুযায়ী বাংলাদেশের শ্রমিক পাচ্ছে না তার ন্যায্য মজুরি। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) গবেষণা সূত্র থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।
সূত্র জানায়, বিশ্বের সবচেয়ে কম শ্রমমজুরির দেশ বাংলাদেশ। শ্রমিকের ন্যায্য অধিকার বা ন্যায্য মজুরি কাঠামো বাস্তবায়নে দেশের সরকারও সঠিকভাবে ভূমিকা পালন করতে পারেনি। এ ক্ষেত্রে সরকার শ্রমিকের চেয়ে মালিকপক্ষের স্বার্থকেই প্রাধান্য দেয়।
এ ছাড়া বেসরকারি বিভিন্ন খাতের শ্রমিকদের জন্য যে ন্যূনতম মজুরি কাঠামো রয়েছে তার অধিকাংশই ২০ থেকে ৩০ বছর আগে গঠিত। এসব খাতের শ্রমিকের জন্য নতুন করে আর বেতন কাঠামো গঠন করা হয়নি। আর গৃহশ্রমিকরা তো আজ অবধি শ্রমিকের মর্যাদাই আদায় করতে পারেনি।
এ প্রসঙ্গে বিলসের সহকারী নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ বলেন, মহান মে দিবসের সার্বজনীন যে ন্যূনতম অধিকার আছে তা থেকে অনেকটাই বঞ্চিত আমাদের দেশের শ্রমিকরা। শ্রমিকের ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করার জন্য বিশ্বের অন্যান্য দেশে সরকারই মুখ্য ভূমিকা পালন করে। অথচ আমাদের দেশের সরকার মালিকপক্ষের স্বার্থকেই প্রাধান্য দেয়। এটি কখনই কাম্য নয়।
অন্যদিকে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) এবং বিলসের সর্বশেষ তথ্য থেকে জানা যায়, ২০১৪ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর-এই এক বছরে বাংলাদেশে কর্মস্থলে দুর্ঘটনা ঘটেছে ৫৫৫টি। এতে নিহত হয়েছে ৬০৩ শ্রমিক। এর মধ্যে তৈরি পোশাক শিল্পে নিহত শ্রমিকের সংখ্যা ৫০।
কর্মস্থলে দুর্ঘটনা সবচেয়ে বেশি ৫৭ শতাংশ ঘটে রাজধানী ঢাকায়। এরপর চট্টগ্রামে দুর্ঘটনা ঘটে ১৫ শতাংশ। কর্মস্থলে দুর্ঘটনায় মৃত্যুও ঢাকায় বেশি হয়েছে। এ সংখ্যা ৩১৮টি।
অন্যদিকে গত বছর সারা বিশ্বে কর্মস্থলে মৃত্যু হয়েছে ২২ লাখ শ্রমিকের। অর্থনীতির ভাষায় একজন শ্রমিক নির্দিষ্ট সময় কাজ করার পর কাজের বিনিময়ে নিয়োগকর্তার কাছ থেকে যে আর্থিক মূল্য পায় সেটাই শ্রমিকের মজুরি। মজুরি সাধারণত মাসিক ভিত্তিতে হয়। তবে শ্রমিকদের মজুরি সাপ্তাহিক, দৈনিক ও পিস রেটেও হয়। সংবিধানের ১৫নং অনুচ্ছেদে নাগরিকের জন্য যুক্তিসঙ্গত মজুরির বিনিময়ে কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তার বিষয়টিকে রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে।
তা ছাড়া আইএলওর ১৩১নং কনভেনশনে শ্রমিকের মজুরি সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘শ্রমিকের সর্বনিম্ন মজুরি অবশ্যই আইন দ্বারা নিশ্চিত করতে হবে। এটা কারও ইচ্ছাধীন করা যাবে না। এই আইনের বাস্তবায়ন করতে যারা ব্যর্থ হবে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে।’ অথচ দেশের সিংহভাগ শিল্পমালিকই এসব আইন লঙ্ঘন করছে শ্রমিকের মজুরি দেওয়ার ক্ষেত্রে।
দেশের অধিকাংশ শ্রমিক ন্যূনতম যে মজুরি পায় তাতে বর্তমান উচ্চমূল্যের বাজারে জীবনধারণ করা কঠিন। খাদ্যদ্রব্যের মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের কাছে। আর খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতি আরও বেশি। সে অনুপাতে একজন শ্রমিক ন্যূনতম যে মজুরি পায় তাতে পুরো মাস তার সংসার চালানোই দায়।
বিলসের এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বিভিন্ন খাতে একজন শ্রমিকের মাসে যে খরচ হয় তার মধ্যে ৪০ ভাগ বা ২ হাজার ৫০৯ টাকা ব্যয় হয় বাসস্থানে। এ ছাড়া খাদ্যে ১ হাজার ৬০০ টাকা, যাতায়াত ৮০০, শিক্ষা ৫০০, চিকিত্সা ৭০০, বিনোদন ২০০, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও প্রসাধনে ২০০, বস্ত্র বাবদ খরচ ৩৫০ এবং অন্যান্য খাতে ৬৫০ টাকা। এভাবে একজন শ্রমিকের মাসে সর্বনিম্ন খরচ পড়ে ৭ হাজার ৫০৯ টাকা। অথচ পোশাক শিল্পসহ বিভিন্ন খাতের শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি গড়ে ৩ হাজার থেকে ৫ হাজার ৩০০ টাকা।
সরকারের ন্যূনতম মজুরি বোর্ড ৪৪টি বেসরকারি খাতের শ্রমিকের জন্য ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করে। কিন্তু এর মধ্যে ২৫টি খাতের শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি ৩০ বছর আগে নির্ধারিত। বেসরকারি এসব খাতের মধ্যে কেবল পোশাক শিল্পের শ্রমিকদের জন্য সর্বশেষ ২০১৩ সালে ন্যূনতম মজুরি ঘোষণা করা হয়। এতে সর্বনিম্ন মজুরি ধরা হয় ৫ হাজার ৩০০ টাকা।
পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ম্যাচ ইন্ডাস্ট্রিজের শ্রমিকদের জন্য সর্বশেষ ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করা হয় ১৯৮৬ সালে (৭৫১ টাকা), রাবার শিল্পের ১৯৮৩ সালে (৫২১ টাকা), হোশিয়ারি শিল্পের ১৯৯৪ সালে (১৩২০ টাকা), রিরোলিং মিলসের ১৯৯৪ সালে (১৩২০ টাকা), ট্যানারি শিল্পের ১৯৯৪ সালে (১৪৪০ টাকা), প্রিন্টিং প্রেসের ১৯৯০ সালে (১৩২০ টাকা), লবণ শিল্পের ১৯৭৮ সালে (৬০০ টাকা), রাইস মিল শিল্পের ১৯৮৪ সালে (৪৯৫ টাকা), প্লাস্টিক শিল্পের ১৯৮৩ সালে (৫২০ টাকা), চা শিল্পের ১৯৮৭ সালে (৪০২ টাকা)। এরপর আর এসব খাতের শ্রমিকদের বেতন বৃদ্ধির জন্য নতুন করে মজুরি বোর্ড গঠন করা হয়নি।
এ প্রসঙ্গে শ্রমিক নেতা রায় রমেশ চন্দ বলেন, যুগের পর যুগ পার হয়ে গেলেও এসব খাতে নতুন করে ন্যূনতম মজুরি আর নির্ধারণ করেনি মজুরি বোর্ড। ফলে এসব খাতে শ্রমিকদের মজুরি নিয়ে চলছে চরম স্বেচ্ছাচারিতা।
তিনি বলেন, এত বছর পর হয়তো অনেক শিল্পমালিকই পুরনো এ মজুরি কাঠামো অনুযায়ী বেতন দিচ্ছে না। অনেকেই বাড়িয়েছে। তবে তা মালিকের ইচ্ছা অনুযায়ী। এসব শিল্পপ্রতিষ্ঠানের শ্রমিকরা তাদের সব রকম অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
কৃষিশ্রমিকরা জানে না কী তাদের অধিকার : সবচেয়ে অসংগঠিত খাত হচ্ছে কৃষি খাত। অথচ দেশের শ্রমশক্তির সবচেয়ে বেশি অংশ কাজ করে এ খাতে। কৃষি খাতের শ্রমিকরা সাধারণত বেশিরভাগ দিনচুক্তিতে কাজ করে। তাদের পারিশ্রমিক এবং কাজ অঞ্চলভেদে একেক রকম রয়েছে।
তবে গড়ে প্রতিদিন একজন কৃষিশ্রমিক ১৫০ থেকে ২০০ টাকা মজুরি পেয়ে থাকে। আর ১৯৮৪ সালের এক অধ্যাদেশে বলা হয়েছে, একজন কৃষিশ্রমিকের দৈনিক মজুরি হবে ৩.২৭ কেজি চাল বা এর সমান মূল্য। এরপর আর কৃষি খাতের শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির জন্য নতুন কোনো নির্দেশনা আসেনি সরকারের পক্ষ থেকে। কিন্তু কোনো কৃষিশ্রমিকই জানে না এ ধরনের একটি আইন আছে। বেসরকারি সংস্থা কর্মজীবী নারী সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
আজও শ্রমিকের মর্যাদা পায়নি গৃহকর্মীরা : অসংখ্য মানুষ দেশে এবং দেশের বাইরে গৃহকর্মী হিসেবে কর্মরত রয়েছে। দেশের অর্থনীতিতে তারাও রাখছে গুরুত্বপূর্ণ অবদান। লেবার ফোর্স সার্ভের তথ্য থেকে জানা গেছে, বর্তমানে সারা দেশে গৃহকর্মীর সংখ্যা ২০ লাখের ওপরে। এর মধ্যে ৮০ শতাংশই নারী। অথচ এই বড় অংশের শ্রমিকরা আজ পর্যন্ত শ্রমিক হিসেবেই স্বীকৃতি পায়নি। এসব গৃহকর্মীর অনেকেই দিন, সপ্তাহ এবং মাস চুক্তিতে শ্রম দেয়।
আবার অনেক শিশু শ্রমিক রয়েছে যারা থাকা-খাওয়ার মৌখিক চুক্তিতেই কাজ করে। এ খাতের শ্রমিকরা সংগঠিত না হওয়ায় নিজেদের অধিকার থেকে তারা বঞ্চিত হচ্ছে।