সিলেটপোস্ট ডেস্ক : সিনথিয়া পারভীন কাকলী : শিশুর সুন্দর ভবিষ্যত নিশ্চিত করা সকল নগরিকের কর্তব্য। কথাটি আমরা প্রায় ভূলতেই বসেছি। আমাদের খেয়াল-খুশির শিকার হচ্ছে শিশুরা। প্রবৃত্তির হাতে জিম্মি হচ্ছে বিবেকবান মানুষ। হারাচ্ছে নৈতিকতা। বিসর্জন দিচ্ছে মূল্যবোধ। বর্তমানে অবস্থা এমন হয়ে দাড়িয়েছে যে, যা হয় হোক আগে নিজের পশু-প্রবৃত্তির চাহিদা মেটাতে হবে। জৈবিক চাহিদার উপর যেন আর কোন চাহিদাই হতে পারে না। ছোটদের দিক নির্দেশক হয়ে থাকেন বড়রা। হায়! সেই দিন আর কই! বড়রাই হয়ে পড়ছে বিপথগামী। সহজ-সরল পথকে করে তুলছে আবর্জনাময়, কন্টকাকীর্ন ও বন্ধুর। যেখানে শিশুর পথ সুন্দর করার পরিবর্তে করে তোলা হচ্ছে কুৎসিত। সহজ করার পরিবর্তে দূর্গম। আলোকময় করার পরিবর্তে অন্ধকারাচ্ছন্ন। আজকাল শিশুর জন্মের বিষয়েই থাকছে গলদ। কথায় আছে ‘জন্ম হোক যথা তথা, কর্ম হোক ভাল।’ কথাটিতে আমি অন্তত একমত হতে পারিনা। জন্ম নিয়ে যে শিশুর মনে সংশয় থাকে সে কিভাবে ভাল কর্মে উদ্বুদ্ধ হবে আমার জানা নেই। প্রায়ই পত্র-পত্রিকায় দেখি রেল লাইনে, নদীর পাড়ে, ডাস্টবিনে, হাসপাতালে শিশু জন্মের পর তাকে ফেলে রেখে যাওয়ার সংবাদ। এই শিশু যেখানে আর যেভাবেই বড় হোক না কেন সে কি কখনো স্বাভাবিক হতে পারবে? এই নিস্পাপ শিশুটির কি অপরাধ? কেন তার এই শাস্তি? বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় এগুলো অবৈধ সম্পর্কের ফল। যদিও আমি এই শিশুকে অবৈধ শিশু বলে মানতে রাজী নই। যদি অবৈধ বলতেই হয় তাহলে যারা তাকে পৃথিবীতে এনে নির্মম ভাবে ফেলে যাচ্ছে তাদেরকে বলতে হবে। এইতো সেদিন ঢাকা মেডিকেলের পাশ থেকে কুকুরে খাবলে খাওয়ার সময় এক মানব সন্তানকে উদ্ধার করা হয়। ওই শিশু কন্যাটির দোষটা কোথায়। সে কি ওই তথাকথিত জন্মদাতাদের বলেছিল আমাকে পৃথিবীর আলো-বাতাস দেখাও। প্রায়ই দেখা যায় সড়ক নির্মান-সংস্কার সহ কিছু পেশার শ্রমিকরা পেশাগত কারণে কিছুদিন এখানে কিছুদিন ওখানে থাকে। যেখানে কাজ করতে যায় দু’ছয় মাস থাকতে হলে ওই শ্রমিক ঝটপট ওই এলাকায় একটি বিয়ে করে ফেলে। পেশাগত কাজ শেষ, তো স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কও শেষ। পাড়ি জমায় অন্য ঠিকানায়। মেয়েটিও ভুল করতে রাজী নয়। এই স্বামীকে তার জীবনে শক্ত করে বেঁধে রাখতে নিয়ে নেয় সন্তান। তবুও স্বামী রূপী অমানুষগুলো তার ও সন্তানের বন্ধনে বাঁধা পড়ে না। চোখের জলের স্রোতে ভাসতে ভাসতে দুনিয়ার মুখ দেখে নিস্পাপ শিশু সন্তানটি। এ জনমে বাবাকে দেখাতো দূরের কথা বড় হতে হয় মানুষের অশ্লীল-কুরুচীপূর্ণ বাক্যবাণের শিকার হতে হতে। যেদিকে তাকায় সেদিক থেকেই তার দিকে আঙুল উঠে। আর উঠে তার মায়ের চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন। একবারও প্রশ্ন ওঠে না মানুষ রূপী নরপশু বাবা পরিচয়ের পুরুষটির দিকে। এই শিশুটি কি করে স্বাভাবিক জীবন পাবে? নগরীগুলোর সড়কে যেসব শিশুরা জন্ম নেয়, বেড়ে ওঠে, আমরা যাদের পথশিশু বলে অবহেলা করি। এরা প্রত্যেকেই আমাদের অবহেলার শিকার। ছলনা করে ওদের পৃথিবীর মুখ দেখানো হলেও করা হয় চরম অবমাননা। উপহার দেয়া হয় নিকৃষ্টতম জীবন। সম্প্রতি চাঞ্চল্যকর একটি মামলার রায় হয়েছে। রায়ে বাবা-মাকে নৃশংসভাবে হত্যার দায়ে ঐশী নামের এক কিশোরীকে ফাঁসির আদেশ হয়েছে। ঐশী যে কাজটি করেছে এটি গর্হিত সন্দেহ নেই। কিন্তু এ অপরাধ কি শুধু ঐশীর। কে তাকে সাধারণ মেয়ে ঐশী থেকে আজকের ঐশীতে পরিণত করলো। ঐশীকে দোষী সাব্যস্ত করে আমরা নিজেদের দায় এড়াতে পারিনা। এজন্য দায়ী আমরা, আমাদের সমাজ, অর্থনৈতিক ও পারিবারিক কাঠামো। একটা স্কুল পড়ুয়া মেয়ে যাকে কিনা হাত খরচের জন্য দেয়া হতো প্রতি মাসে ৫০ হাজার এর অধিক টাকা। এই ছোট্ট মেয়েটি কি করবে এত টাকা। তাকে তো খরচের একটা পথ বে করতে হবে। সে ঠিকই তার পছন্দমতো ভুল রাস্তা বেছে নিয়েছে। শিশু কয়েক দিনেই খারাপ হয় না। খারাপ হতে সময় লাগে। এই সময়ের মধ্যে কি পারা যেত না তাকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে? আসল কথা হচ্ছে এখন বাবা মায়েরা সন্তানকে সময় দেওয়াটাকেই অনর্থক সময় ব্যয় বলে মনে করেন। তাই তাদের পক্ষে সন্তানের চাওয়া পাওয়া বুঝে ওঠা হয় না। মনের ঠিকানা পাওয়া তো নাগলের বাইরে। এমন বাবা মায়ের সন্তান বিপথে যাবে তা আর অসম্ভব কি? ঐশীর একটা ছোট্ট ভাই রয়েছে। কে নেবে তার দায়িত্ব? কি তার ভবিষ্যৎ আমরা কি সে কথা একটুও ভেবেছি? সেও যে অপরাধে জড়িয়ে পড়বে না তার গ্যারান্টিই বা কে দেবে? অপরাধ সংগঠিত হয়ে যাবার পর অপরাধী এমনিতেও অনুুতপ্ত থাকে। ঐশী এখনো শিশুর পর্যায়ে পড়ে। তাকে সংশোধনের সুযোগ দেয়াটাই হয়তো শ্রেয় হতো। ঐশীর ছোট্ট ভাইটিও একটি নীড় পেত।
বর্তমানে হিংস্র রাজনীতির কবলে পড়ছে শিশুরা। এই অপরাজনীতি ছিনিয়ে নিচ্ছে তাদের স্বাভাবিক জীবন। বিষিয়ে তুলছে আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। মিছিল মিটিংয়ে শিশুদের অংশগ্রহণ লক্ষণীয়ভাবে বেড়েছে। এসব শিশুদের সামনে ভিআইপি অতিথিরা ধুমাপানও করে থাকে। তাহলে এখান থেকে শিশুরা কি শিখবে? মিছিল থেকে ইট পাটকেল ছোড়া থেকে বিস্ফোরক দ্রব্যাদি পরিবহন বা বোমা হামলার কাজেও শিশুদের ব্যবহার করছে রাজনীতিকরা। নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধির জন্য কোমলমতি শিশুদের জীবনে অন্ধকার ডেকে আনতেও তাদের কোন দ্বিধা নেই। সম্প্রতি বাগেরহাটের এক মহিলা ভাইস চেয়ারম্যানকে তার ১৪ মাস বয়সী শিশু কন্যা সহ আটক করা হয়েছে। ভাইস চেয়ারম্যান রাজনৈতিক মামলায় গেফতার হয়েছেন। তিনি তো আর চোর-ডাকাত নন। হলেন চোর-ডাকাত। তার
শিশু সন্তানটির কি অপরাধ? এই বয়সেই মায়ের অপরাধের বলি হচ্ছে শিশুটি। কিছুদিন আগে ঝিনাইদহের মহেশপুরে চার বছর বয়সী এক শিশুকে পুলিশ আটক করে কয়েদখানায় রাখে। যার ছবি বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। কি অপরাধ ছিল শিশুটির।
শিশুদের নেশাগ্রস্ত হওয়ার জন্যও বড়রা কম দায়ী নন। সিগারেটসহ নেশাজাত নানা দ্রব্য শিশুদের কাছে কিনতে দেয়া হয়। শিশুরা এমনিতেই কৌতুহলী হয়ে থাকে। আস্তে আস্তে ঐ নেশার দ্রব্যের প্রতি তারও আগ্রহ জন্ম নেয়। কৌতুহল নিবৃত্তির জন্য প্রথমদিন একটু, তারপর আরো একটু এভাবে একসময় পুরোপুরি আসক্ত হয়ে পড়ে।
প্রতিটি ধর্মেই সন্তান জন্ম দেয়া তো বটেই বিয়ে করার ব্যাপারেও ঐ ব্যক্তির আর্থিক, শারিরিক ও মানসিক সামর্থের বিষয়ে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। ইসলামের নবী তো এব্যাপারে বলেছেন ‘তোমাদের যুবকদের মধ্যে যারা সামর্থবান তারা বিয়ে কর, আর স্ত্রীকে পর্দায় রাখতে সামর্থবান না হলে রোজা রাখ অর্থাৎ নিজেকে খাসী করে দাও।’ এখানে পর্দা বলতে শুধু নারীর শরীর ঢেকে রাখার কথা বলা হয় নি। তার ভোরণ-পোষণের কথাও বলা হয়েছে। তাহলে সামর্থ না থাকলে বেশী বেশী সন্তান জন্ম দেয়ার প্রশ্নই আসে না। শুধু তাই নয় সন্তানকে উপযুক্ত মানুষ হিসেবে লালন পালনের ব্যাপারেও প্রতিটি ধর্ম গুরুত্ব দিয়েছে। সন্তান পিতা মাতার পরিচয় বহন করে। যে সন্তানকে অপনি জন্ম দিলেন তার সুস্থতা, সুনিশ্চিত ভবিষ্যৎ যদি নিশ্চিত করতে না পারেন তাহলে পিতা বা মাতা হিসেবে আপনার সার্থকতা কোথায়। ‘অধিক বিকালঙ্গ (শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক) সন্তান জন্ম দেয়ার চেয়ে একটি সুস্থ সন্তান জন্ম দেয়া’ই যুক্তিযুক্ত।’
শহরের বস্তিগুলিতে দলিত সম্প্রদায়ের মধ্যে অধিক সন্তান জন্ম দেয়ার প্রবণতা বেশী দেখা যায়। এই শিশুদের স্কুলে পর্যন্ত পাঠানো হয় না। ফলে এরা জীবন সম্পর্কে অনেক বিষয়ে অজ্ঞ। জীবনের একটা বড় অংশ এদের কাছে অজানা থেকে যায়। পরবর্তীতে এরাই পূর্ববর্তীতের পথ অনুসরণ করে থাকে। সুন্দর জীবনের স্বাদ এদের আর পাওয় হয়ে ওঠে না। বাল্য বিবাহের হারও এদের মধ্যে অনেক বেশি।
পৃথিবীতে কোন শিশুই অপরাধী হয়ে জন্ম গ্রহণ করে না। পরিবেশ, পরিবার, সমাজ তাকে অপরাধী হতে উৎসাহী করে। তাই এসব শিশুদের বিপথে যাওয়ার পেছনে আমরা, এই সমাজ দায়ী। আমাদেরকেই এগিয়ে আসতে হবে এদের বিপথগামীতা থেকে বাঁচাতে। আমাদের আন্তরিকতা, একটু সাবধানতাই পারে শিশুকে বিপথগামীতার হাত থেকে ফেরাতে তার জীবনকে নক্ষত্রখচিত করতে। জীবনের প্রকৃত অর্থ বোঝাতে।
সিলেটপোস্ট২৪ডটকম/ফয়ছল আহমদ/২6.১১.২০১৫