সিলেটপোষ্ট রিপোর্ট :প্রাচীন চীনে সিমা ছিয়েন নামক এক সাহিত্যিক বলেছিলেন, ‘মানুষের মৃত্যু অনিবার্য কিন্তু তার তাৎপর্য হবে থাই পাহাড়ের চেয়েও ভারী বা বেলে হাঁসের পালকের চেয়েও হালকা।’ মৃত্যু স্বাভাবিক ও অনিবার্য প্রক্রিয়া। কিন্তু এই অনিবার্য প্রক্রিয়া কখনো কখনো মানুষ নিজের হাতে তুলে নেয়। এবং তখনই সেটিকে ‘আত্মহত্যা’ বলা হয়। এ প্রসঙ্গে বিভিন্ন সময় গবেষণা হয়েছে। গবেষণার খসড়াপত্র ঘাটলে দেখা যায় বেশিরভাগ গবেষক এর কারণ হিসেবে কয়েকটি জিনিস ঘুরেফিরে গবেষণায় তুলে ধরেছেন। এগুলোর মধ্যে মানসিক চাপ, বিষণ্নতা এবং ব্যর্থতাকেই বেশি দায়ি করেছেন তারা।বিশ্বসাহিত্যের অনেক সাহিত্যিকই কিন্তু আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছেন। এঁদের মধ্যে কবির সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। ধারণা করা হয়, অতিরিক্ত সংবেদনশীলতাই এর অন্যতম কারণ। এ রচনায় বিশ্বসেরা পাঁচ কবির আত্মহনন নিয়ে আলোচনা করা হলো।
সিলভিয়া প্লাথ (১৯৩২-১৯৬৩) : তিনি আমেরিকান কবি ও ঔপন্যাসিক। পড়াশোনা করেন স্মিথ কলেজ এবং ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে। বাঙালি পাঠকদের কাছে এটি পরিচিত নাম। আমাদের চেনা আরেক কবি টেড হিউজের সঙ্গে তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে। তাঁদের ঘরে দুই সন্তান ফ্রিডা ও নিকোলাস। সিলভিয়া প্লাথের অধিকাংশ কবিতা স্বীকারোক্তিমূলক, যে কারণে তাঁকে ‘কনফেশনাল কবি’ বলা হয়। মৃত্যুর আগে অনেকদিন ধরে তিনি বিষণ্নতায় ভুগেছিলেন। তাঁর ‘ড্যাডি’ শিরোনামের কবিতাটি বহুল পঠিত। বলা হয়, এটা তাঁর অন্যতম সেরা কবিতা।
সিলভিয়া মাত্র ২০ বছর বয়সে একবার আত্মহত্যার ব্যর্থ প্রয়াস চালান। কিন্তু সে যাত্রা তিনি রক্ষা পান। কিন্তু দ্বিতীয়বার তাঁর উদ্দেশ্য সফল হয়। তখন সদ্য ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে স্বামী টেড হিউজের সঙ্গে। এ ঘটনায় প্রচণ্ড মানসিক আঘাত পান তিনি। সন্তানদের প্রতি অগাধ ভালোবাসা ছিল তাঁর। তাই কৌশলে আত্মহত্যার সময় গ্যাসের চুলা ভেজা তোয়ালে দিয়ে ঢেকে রেখেছিলেন, যাতে বাইরে আগুন না যেতে পারে। এভাবে প্রস্তুতি নেয়ার পর তিনি ধীরে ধীরে মাথা এগিয়ে দেন গ্যাসের চুলার দিকে। গ্যাস প্রবাহের গতি বাড়িয়ে দেন নিজ হাতে। দপ করে আগুন জ্বলে উঠলে মুহূর্তেই মাখায় আগুন ধরে যায়। এভাবেই আগুনে পুড়ে মারা যান তিনি। সিলভিয়া প্লাথ ১৯৮২ খ্রিস্টাব্দে মরণোত্তর পুলিৎজার পুরস্কার পান।
কারিন বোয়ে (১৯০০-১৯৪১) : বিষণ্ণ ও বিয়োগান্ত বিষয় নিয়ে লিখে তিনি বিখ্যাত হয়ে আছেন কবি মহলে। তাঁর বেশিরভাগ কবিতা প্রতীকধর্মী। সুইডেনের গোথেনবার্গে জন্মগ্রহণ করা বোয়ে মাত্র ৯ বছর বয়সে চলে যান স্টকহোমে। মূলত এখানেই কাটে তাঁর শৈশব। পড়াশোনা করেন উপশাল ও স্টকহোম বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম কবিতা সংকলন। একটি সাহিত্য পত্রিকাও ছিল তাঁর। এই সাহিত্য পত্রিকার মাধ্যমেই তিনি টি.এস. এলিয়টকে পরিচয় করিয়ে দেন পাঠক সমাজে। শুধু তাই নয়, তিনি পরাবাস্তবতা সম্পর্কেও প্রথম অবহিত করেন। কবিতা গ্রন্থ প্রকাশ করার পর একটি উপন্যাসও লেখেন। সরকারের সমগ্রতাবাদীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদস্বরূপ তিনি এই উপন্যাসটি লেখেন। তিনি বিয়ে করেছিলেন, তবে সে বিয়ে বেশিদিন টেকেনি। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, তিনি ছিলেন সমকামী। জীবনের শেষ ১০ বছর তিনি বান্ধবী মারগেট হ্যানেলের সঙ্গে থাকতেন। জানা যায়, মানসিক চাপের কারণেই তিনি আত্মহত্যা করেন।
১৯৪১ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিলে একদিন তিনি গাড়ি নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে আর ফিরে আসেন নি। কিছুদিন পর তাঁর মৃতদেহ আবিষ্কার করা হয় পাহাড়ের ওপর এক পাথর খণ্ডের কাছে। চিকিৎসকরা জানান, অতিরিক্ত ঘুমের বড়ি খেয়ে আত্মহত্যা করেছেন তিনি।
অ্যানি সেক্সটন (১৯২৮-১৯৭৪) : আধুনিক স্বীকারোক্তিমূলক কবিতা লিখে তিনি বিখ্যাত হয়ে আছেন। তাঁর সময়ে অন্য কবিরা যে বিষয়গুলো এড়িয়ে গেছেন, তিনি সেই বিষয়গুলো নিয়েই কবিতা লিখেছেন। হস্তমৈথুন, রজঃস্রাব, গর্ভপাত ইত্যাদি বিষয়ও তাঁর লেখায় চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে। মানসিক চাপ ও বিষাদগ্রস্ত ছিল তাঁর পুরো জীবন। মানসিক চাপ কমাতে তিনি মদ্যপানের দিকে ঝুঁকে পড়েন। তাঁর ব্যক্তিগত থেরাপিস্ট কবিতা লিখতে পরামর্শ দেন। কারণ তিনি বলেন, কবিতাই হতে পারে তার চাপ কাটিয়ে ওঠার একমাত্র অবলম্বন। তাঁর কবিতা একের পর এক বিখ্যাত সব পত্রিকায় ছাপা হতে শুরু করে। স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দে পুলিৎজার পুরস্কার লাভ করেন।
অতিরিক্ত মদ্যপান কখনো তাঁর সৃষ্টিশীলতার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পাড়ে নি। তিনি কয়েকবার আত্মহত্যার চেষ্টা করে বিফল হন। তাঁর সর্বশেষ পাণ্ডুলিপি একজন রিপোর্টারকে দিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘তাঁর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এটা যেন প্রকাশিত না হয়।’ যদিও সেই পাণ্ডুলিপিটি তিনি পরবর্তীতে রিপোর্টারের কাছ থেকে ফেরত এনেছিলেন। দিনটি ছিল ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দের ৪ অক্টোবর। জানা যায়, বাড়ি ফিরে ওই দিনই তিনি মায়ের উলের কোট পরে এক বোতল ভোদকা খেয়ে গ্যারেজ খুলে গাড়ির মধ্যে গিয়ে বসেন। তারপর গাড়ির কার্বন মনো-অক্সাইড গ্যাস ছেড়ে দেন। এই গ্যাসের বিষক্রিয়াই তিনি মারা যান। আমেরিকান এই কবি ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দে নোবেল পুরস্কার পান।
জন ব্যারিম্যান (১৯১৪-১৯৭২) : বাবার পথে হেঁটেছিলেন জন ব্যারিম্যান। বাবার আত্মহত্যার পর মা আবার বিয়ে করেন। ব্যারিম্যান পড়াশোনা করেন কলম্বিয়া কলেজ ও ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে। পড়াশোনা শেষে ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি অধ্যাপকের দায়িত্ব পালন করেন মিনেসোটা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সনেট কাব্য সংকলনের জন্য ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি পুলিৎজার পুরস্কার পান। ৩৮৫টি কবিতা ছিল বইটিতে। প্রকাশের পর সেটি ওই সময়ের অন্যতম সেরা কাব্যগ্রন্থের স্বীকৃতি পায়। জন ব্যারিম্যান ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে ওয়াশিংটন অ্যাভিনিউ ব্রিজ থেকে প্রায় নব্বই ফুট নিচে মিসিসিপি নদীতে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেন।
হার্ট ক্রেন (১৮৯৯-১৯৩২) : কাজী নজরুল ইসলামের সমসাময়িক কবি হার্ট ক্রেন। পৃথিবী সম্পর্কে তাঁর বীতশ্রদ্ধ হবার খবর সর্বপ্রথম জানান দেন একটি কবিতার মাধ্যমে। আধুনিক সময়ের অন্যতম আলোচিত আমেরিকান কবি তিনি। ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে তিনি বেশ কিছুদিন ছিলেন মেক্সিকোতে। সে সময় তিনি অতিরিক্ত মদ্যপানে আসক্ত হয়ে পড়েন। বিষণœতার কালো ছায়া তাঁকে ঘিরে নৃত্য করতে থাকে তখন। মরে যেতে সাধ হয়। নিউইয়র্ক ফেরার পথে মেক্সিকো উপসাগরে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেন তিনি।