মো: আব্দুল মালিক::মাতা, মাতৃভাষা ও মাতৃভূমি প্রত্যেক মানুষের শ্রদ্ধা ও গৌরবের ধন। বাঙালি মায়ের ইতিহাস গৌরবের হলেও বাঙালির মাতৃভাষা ও মাতৃভূমির ইতিহাস একদিকে বেদনাদায়ক, অন্যদিকে গৌরবের। বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন চর্যাপদ। এটি আবিষ্কৃত হয়েছে নেপালের রাজ দরবারের পুঁথিশালা থেকে। এতে অনুমিত হয় তৎকালে বাংলা ভাষীরা মাতৃভূমি থেকে বিতাড়িত হয়েছিলেন এবং কেউ কেউ লুকিয়ে তাদের সাহিত্যকর্ম সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন।
বাংলা নামক এই ব-দ্বীপ বহুবার বিদেশিদের দ্বারা আক্রান্ত, শাসিত ও ক্ষত-বিক্ষত হয়েছে। বাংলাভাষার উপর আক্রমন এসেছে সংস্কৃত, ফারসি, ইংরেজি, উর্দুভাষী থেকে।
বাঙালি জাতির ইতিহাস আড়াই/তিন হাজার বছরের পুরোন। এই সুদীর্ঘ সময় বাঙালিরা শাসক ছিলেন না। বাঙালিরা ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট একবার এবং ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ আরেকবার স্বাধীনতা লাভ করেন। ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের মধ্যদিয়ে বাঙালিরা শাসকের মর্যাদা লাভ করেন। প্রতিবেশি রাষ্ট্র মিয়ানমার থেকে যেভাবে প্রায় ১২ লক্ষ রোহিঙ্গা মুসলমান নির্যাতিত হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন। ঠিক একই ভাবে ১৯৭১ সালে এ অঞ্চলের প্রায় এক কোটি বাঙালি প্রতিবেশি রাষ্ট্র ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন। ত্রিশ লক্ষ শহীদ, কয়েক লক্ষ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে বাঙালির স্বাধীনতা, কারো দানে পাওয়া নয়।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের ৭% মানুষের ভাষা উর্দূর সাথে ৫৬% মানুষের ভাষা বাংলাকে দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষার দাবীতে জীবন দিয়েছেন ০৫ জন বাঙালি। ১৯৬১ সালের ১৯ মে বাংলা ভাষার জন্য জীবন দিয়েছেন ভারতের আসাম রাজ্যের ১১ জন বাঙালি। বিশ্বের ইতিহাসে আর কোন জাতি মায়ের ভাষার জন্য এভাবে জীবন দেয়নি।
মাতৃভাষা ও মাতৃভূমির জন্য বাঙালির আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি। উর্দু পাকিস্তানে আজো রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা পায় নি। পক্ষান্তরে বাংলা আজ তিনটি দেশের রাষ্ট্রভাষা। পাকিস্তান আমলে নিষিদ্ধ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনা আজ ৩টি দেশের জাতীয় সংগীত। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতিসংঘে সর্বপ্রথম বাংলায় ভাষণ দান করেন। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কো ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্র্Íজাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা করে। অনলাইন বিশ্বকোষ খ্যাত উইকিপিডিয়া ২০০৪ সালে এবং ফেইসবুক ২০০৯ সালে বাংলা ভাষা চালু করে। বাংলা ভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখার জন্য বিশ্বের সকল মাতৃভাষার গবেষণা, উন্নয়ন, সংরক্ষণ ও সমন্বয় সাধনের জন্য ঢাকায় “আন্র্Íজাতিক মাতৃভাষা ইন্সটিটিউট” প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। ২০০৮ সালের ৫ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্র্Íজাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। ২০০৯ সালে বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাকে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে অন্তর্ভূক্তির প্রস্তাব করেন, যা জাতিসংঘের সক্রিয় বিবেচনাধীন আছে। বাংলাদেশের কক্সবাজার, সুন্দরবন, ষাট গম্বুজ মসজিদ, টাঙ্গুয়ার হাওর ইত্যাদি ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের অন্র্Íভূক্ত। ৩০ অক্টোবর ২০১৭ ইউনেস্কো বঙ্গঁবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণকে ২৪৭তম বিশ্ব ঐতিহ্যের দলিল হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশ জাতিসংঘ সহ আন্র্Íজাতিক ও আঞ্চালিক অনেক সংস্থার গুরুত্বপূর্ণ পদে আছে। ১৯১৩ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা সাহিত্যে নোবেল পুরুষ্কার লাভ করে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে প্রথম বিশ্বের দরবারে পরিচিত করেন। পরে আরো ৪ জন বাঙালি অন্য বিষয়ে নোবেল পুরুষ্কারে ভূষিত হয়েছেন।
২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ি বিশ্বের প্রায় ২৮ কোটি মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলেন। জনসংখ্যার এই হিসেবে বাংলা বর্তমান বিশ্বের ৪র্থ বা ৬ষ্ঠ স্থানীয় ভাষা। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে। অদুর ভবিষ্যতে উন্নত বিশ্বের মর্যাদা পাবে। এসব আমাদের অর্জন। এসব অর্জনকে ধরে রেখে বিশ্বে মর্যাদাশীল জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে হলে আমাদের ভাষাকে সঠিক ও শুদ্ধভাবে বিশ্ব সভায় উপস্থাপন করতে হবে।
ভাষা হচ্ছে নদীর স্রোতের মত বহমান। পৃথিবীর যেকোনো ভাষা প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হচ্ছে। আমাদের বাংলা ভাষা ও তার ব্যতিক্রম নয়। বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন চর্যাপদের ভাষা আর আজকের আধুনিক কবিতার ভাষার মধ্যে যে বিস্তর ব্যবধান তা অত্যন্ত স্পষ্ট।
ভাষা সমাজের দান এবং সমাজ পরিবর্তনের সাথে সাথে ভাষার পরিবর্তন হয়। তাই সামাজিক শৃঙ্খলার মতো ভাষার শৃঙ্খলাও বজায় রাখা প্রয়োজন। তা না হলে বিশৃঙ্খলা আর বিভ্রান্তির ব্যাপকতায় একটি ভাষার অধঃপতন অনিবার্য। তুলনামূলক ভাবে বাংলা ভাষার যে জায়গায় সবচেয়ে বেশি বিশৃঙ্খলা বিরাজমান তা হলো বানান। বানান হলো ভাষার একটি প্রায়োগিক দিক। ভাষার চেহারা নির্ভর করে বানানের উপর। বাংলা বানানকে শৃঙ্খলাবদ্ধ বা সরলীকরণের প্রচেষ্টা দীর্ঘদিনের হলেও ভাষার এই জায়গায় বিশৃঙ্খলার অবসান হয়নি। অনেকটা অজ্ঞতায় এবং অনেকটা অহমিকায় বাঙালির লেখায় বানান ভুলের সংখ্যা সত্যি লজ্জাজনক। আজকাল ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে বানান ভুল যেন এক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। শুধু ছাত্র-ছাত্রী কেন? প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, তথা বাংলা ভাষার সাথে সংশ্লিষ্ট অনেকেরই সর্বশেষ বানানরীতি সম্পর্কে সম্যক ধারণা নেই। তাই দেশ ও জাতির স্বার্থে সকলের শুদ্ধ ও সর্বশেষ বানানরীতি সম্পর্কে ধারণা থাকা একান্ত প্রয়োজন।
প্রাচীন ও মধ্যযুগে বাংলা বানানের কোন নির্দিষ্ট নিয়ম ছিল না। তখনকার লেখকরা নিজস্ব বানান রীতি অনুসরণ করতেন। ফলে বানানের ক্ষেত্রে সর্বত্র সমতা বিরাজ করত না। ১৯২৫ সালে সর্বপ্রথম বিশ্ব ভারতী চলিত ভাষার বানানের একটি নিয়ম করে। পরে ১৯৩৬ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রায় সর্বজন গ্রাহ্য একটি বানানরীতি প্রণয়ন করে। ১৯৪৯ সালের ৯ই মার্চ তদানীন্তন পূর্ববাংলা সরকার বাংলাভাষা সংস্কারের জন্য একটি কমিটি করেন। উক্ত কমিটির রির্পোট ব্যাপক সমালোচিত ও প্রত্যাখাত হয়। ১৯৬৩ সালে বাংলা বানান সংস্কারের জন্য আরেকটি কমিটি গঠিত হয়। উক্ত কমিটির রির্পোটও গৃহীত হয় নি। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্য পুস্তক বোর্ড-পাঠ্য পুস্তকে বাংলা বানানের সমতা বিধানের জন্য ১৯৮৪ সালে একটি কমিটি গঠন করেন। উক্ত কমিটির সুপারিশ অনুযায়ি ১৯৯২ সাল থেকে প্রাথমিকের পাঠ্যপুস্তক রচিত হতে থাকে। ১৯৯২ সালের এপ্রিল মাসে বাংলা একাডেমি সর্বক্ষেত্রে একই বানানরীতি প্রচলনের লক্ষ্যে একটি উদ্যেগ নেয়। এই উদ্যেগের ধারাবাহিকতায় ২০১২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ‘প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম’ সর্বশেষ পরিমার্জিত সংস্করণ প্রকাশিত হয়। বর্তমানে বাংলা একাডেমি প্রণীত ‘প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম’ই হচ্ছে বাংলা বানানের সর্বশেষ মানদন্ড।
বাংলা একাডেমি প্রণীত প্রমিত বাংলা বানানে বহুক্ষেত্রে সংস্কার করা স্বত্বেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে আরো সংস্কার প্রয়োজন বলে অনুভূত হতে থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় সরকার একটি কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে ২০১৮ সালে কয়েকটি জেলার বাংলা ও ইংরেজি বানানে সংস্কার সাধন করেন। ইতোপূর্বে সেনা শাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ ঢাকা বানানের ইংরেজি রূপে সংস্কার সাধন করেন।
আরো কয়েকটি ক্ষেত্রে বানানে সংস্কার জরুরী বলে মনে হয়। যেমন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বাংলার ‘ঠাকুর’ ইংরেজিতে ‘টেগর’ চট্টোপাধ্যায় চ্যাটার্জি হয়ে যান। বৃটিশরা উচ্চারণ করতে পারত না বলে ঠাকুরকে- টেগর, চট্টোপাধ্যায়কে- চ্যাটার্জি, বন্দ্যোপাদ্যায়কে- ব্যানার্জি, পালকে- পাউল উচ্চারণ করত। বৃটিশ চলে গেছে সেই ১৯৪৭ সালে। তারপর ১৯৫২ পূর্ব পাকিস্থান ও ১৯৬১ সালে ভারতের আসামে বাঙালিরা জীবন দিয়ে বাংলা ভাষাকে রক্ষা করেছেন। কোন যুক্তিতে বৃটিশের ভুল উচ্চারণ বাঙালিরা এখনো নামের সাথে স্বগৌরবে বহণ করছেন। জেলার বৃটিশ প্রদত্ত বানানের সংস্কার করা হলে নামের ক্ষেত্রে কেন নয় ?
এই উপমহাদেশে বাঙ্গালি মুসলমান পুরুষের নামের পূর্বে মোহাম্মদ এবং মহিলাদের নামের পূর্বে মোছাম্মত শব্দটি যেন অপরিহার্য। অথচ ‘মোহাম্মদ’ শব্দটি একাধিক রুপে লেখা হয়। যেমন- মোহাম্মদ, মোহাম্মেদ, মুহাম্মদ, মুহম্মদ, মহম্মদ, মোঃ, মো., মুহা. মু. ইত্যাদি। এর একই রুপ কি কাম্য নয়? আর ‘মোছাম্মত’, মোছাঃ শব্দকে মনে করা হয় মুহাম্মদের স্ত্রী লিঙ্গ। আসলে স্ত্রী লিঙ্গও নয় সঠিক প্রয়োগও নয়। মোছাম্মত আরবি শব্দ এর বাংলা অর্থ “নাম রাখা হলো”। তেমনি ভাবে আল্লাহর গুণবাচক নামের ক্ষেত্রে একই বানানরীতি থাকা বাঞ্চনীয়। যেহেতু আমরা বাঙ্গালি মুসলমান সেহেতু আমাদেরকে আরবি বা ইসলাম ধর্মীয় উৎস থেকে আগত শব্দের প্রতি খেয়াল রাখা জরুরী, অন্যতায় অর্থের পার্থক্য হওয়া স্বাভাবিক, যা কোন মুসলমানের কাম্য নয়। এরকম আরো কয়েকটি ক্ষেত্রে বানান সংস্কার জরুরী।
বাংলা একাডেমি, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের উন্নয়নে কাজ করে, এটি তাদের দায়িত্ব। একজন অভিভাবক বা ব্যক্তি তার সন্তানের নাম কী রাখবেন, বানান কীভাবে লেখবেন সেটা তার একান্ত নিজস্ব ব্যাপার। বলা হয় নামের ক্ষেত্রে ভুল বলে কিছু নেই। তথাপিও যতটুকু সম্ভব সঠিক ও বিভ্রান্তিমুক্ত নাম রাখা জরুরী। বাংলা একাডেমি জাতীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে এ বিষয়ে একটি দিক নির্দেশনা দিতে পারেন। যাতে সর্বসাধারণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি হয়।