শিশুদের সামাজিক সুরক্ষায় অন্তবর্তী সরকারের নানামুখী উদ্যোগ

সিলেট পোস্ট ২৪ ডেস্ক
প্রকাশিত হয়েছে : ১১ অক্টোবর ২০২৪, ২:০০ পূর্বাহ্ণ
ছবি অনলাইন
ফারিহা হোসেন::বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির সর্বব্যাপী উন্নতির এই সময়েও বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী ৭৬.১ শতাংশ শিশু সামাজিক সুরক্ষার বাইরে। প্রথমবারের মতো বিশ্বের মোট জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি (৫২.৪ শতাংশ) কোনো না কোনো ধরনের সামাজিক সুরক্ষার আওতায় রয়েছে। তবে জলবায়ু সংকটের কারণে সবচেয়ে ঝুঁকির মুখে থাকা ২০টি দেশে ৯১.৩ শতাংশ মানুষ (৩৬ কোটি ৪০ লাখ) এখনও সামাজিক সুরক্ষার বাইরে। সবচেয়ে জলবায়ু-ঝুঁকিতে থাকা ৫০টি দেশে জনসংখ্যার ৭৫ শতাংশ (২১০ কোটি মানুষ) কোনো ধরনের সামাজিক সুরক্ষার আওতায় নেই। এছাড়া, উল্লেখযোগ্য মাত্রায় লিঙ্গ বৈষম্য বিদ্যমান, যেখানে সামাজিক সুরক্ষার আওতায় থাকার দিক থেকে পুরুষদের চেয়ে নারীরা পিছিয়ে আছে (যথাক্রমে ৫০.১ ও ৫৪.৬ শতাংশ)।“বিশ্ব সামাজিক সুরক্ষা প্রতিবেদন ২০২৪-২৬: জলবায়ু পদক্ষেপ ও একটি ন্যায়সঙ্গত পরিবর্তনের জন্য সর্বজনীন সামাজিক সুরক্ষা” শীর্ষক আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। প্রতিবেদনটি ১২ সেপ্টেম্বর জেনেভায় প্রকাশ করা হয়।
আইএলও প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাবের সঙ্গে মানিয়ে নিতে, প্রভাব প্রশমিত করতে এবং একটি ন্যায়সঙ্গত পরিবর্তনের লক্ষ্য অর্জনে সার্বজনীন সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিতে সরকারকে আরও বেশি উদ্যোগ গ্রহণ করার পরামর্শ দেয়া হয়। অন্যদিকে, জলবায়ু সংকটের প্রভাব মোকাবিলা ও একটি ন্যায়সঙ্গত পরিবর্তনে সমর্থন দিতে সরকারগুলো সামাজিক সুরক্ষার যে জোরালো সম্ভাবনা রয়েছে, তার পূর্ণ ব্যবহার করতে ব্যর্থ হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোতে সামাজিক সুরক্ষার বিষয়টি সর্বনিম্ন পর্যায়ে রয়েছে।
দেশে শিশুদের নিরাপত্তা একটি বহুমুখী সমস্যা। এই সমস্যা মূলত: সামাজিক, অর্থনৈতিক, আইনি এবং সাংস্কৃতিক কারণে হচ্ছে। শিশুদের জন্য সম্পূর্ণ নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে এখনো রয়েছে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ । গ্যারেজ.ওয়েল্ডিং কারখানা, নির্মাণ কাজ,ইট ভাঙ্গা, কৃষি ও গৃহস্থালির কাজে যুক্ত রয়েছে অনেক শিশু। অন্যদিকে শিশু বয়সে অনেক মেয়ে বাল্যবিয়ের শিকার হচ্ছে। ইউনিসেপের সাম্প্রতিক এক জরিপ রিপোর্টে বলা হয়,‘বাংলাদেশে বাল্যবিবাহের হার বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে বেশি। অন্যদিকে দারিদ্রের কারণে অনেক শিশু অপুষ্টিতে ভুগছে এবং যথাযথ স্বাস্থ্যসেবা থেকেও বঞ্চিত রয়েছে তারা , বিশেষ করে শহরের বস্তি এবং দুর্যোগ-প্রবণ এলাকায় সমস্যা প্রকট। তদুপরি জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যা, ঘূর্ণিঝড়,জলোচ্ছ্বাস, বন্যাসহ যে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণেও শিশুরা বাস্তুচ্যুতি এবং স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পতিত হয়। দু:খজনক হলেও সত্য, পরিবারসহ যাদের হাতে শিশুদের সুরক্ষার দায়িত্ব তাদের কাছেও তারা নিরাপদ নয়। দেশের লক্ষ লক্ষ শিশু নিয়মিতভাবে তাদের নিকটজনদের হাতে নির্যাতন, শোষণ এবং সহিংসতার শিকার হতে হয়। পিতামাতা থেকে কেয়ার টেকার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক দ্বারা প্রতি দশজনের মধ্যে নয়জন শিশু শারীরিক ও মানসিকভাবে হয়রানির শিকার হচ্ছে।
আইএলও মহাপরিচালক গিলবার্ড এফ হাউংবো বলেন,জলবায়ু পরিবর্তন কোনো সীমানা চেনে না। আমরা এই সংকট থেকে দূরে থাকার জন্য কোনো দেয়াল তুলতে পারি না। তাই জলবায়ু সংকট আমাদের সবাইকে প্রভাবিত করে। আজ এটি সামাজিক ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে একক, সবচেয়ে গুরুতর, হুমকি হিসেবে উপস্থিত হয়েছে। এই সংকটের সবচেয়ে নিষ্ঠুর পরিণাম ভোগ করছে, এমন অনেক দেশ, বিশেষ করে তারা এই সংকটের পরিবেশগত ও জীবিকাগত পরিণাম মোকাবিলা করতে প্রস্তুত নয়। আমাদের স্বীকার করতে হবে যে, ক্ষতিগ্রস্ত সম্প্রদায়ের সঙ্গে যা ঘটবে তার প্রভাব আমাদের সবার ওপর পড়বে। এমন অবস্থায় সার্বজনীন সামাজিক সুরক্ষায় তালিকায় থাকা উপকরণগুলো যথাযথভাবে কাজে লাগানো। তাহলে জলবায়ু সংকট ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের শিশুরা বঞ্চনা ও বৈষম্য থেকে পরিত্রাণ পাবে।’ তিনি আরো বলেন, সবুজায়ন ও কম কার্বন নিঃসরিত শক্তি পরিচালনার মাধ্যমে পরিবেশবান্ধব রূপান্তরের চলমান কার্যক্রমে কেউ যাতে পেছনে না পড়ে তা নিশ্চিত করার জন্য সামাজিক সুরক্ষা অপরিহার্য। আর সামাজিক সুরক্ষাকে সর্বজনীন করার বাধ্যবাধকতা কেবল নৈতিক নয়, বাস্তবসম্মতও। আইএলও বলছে, মানুষকে আয়ের নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তির মতো সামাজিক সুরক্ষা সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে জলবায়ু-সম্পর্কিত অভিঘাতের প্রতি সহনশীল হতে এবং তা মানিয়ে নিতে সাহায্য করতে পারে। তাহলে এসব পরিবারের শিশুরা সামাজিক ও অর্থনৈতিক সুরক্ষার আওতায় আসবে। এটি কেবল সম্ভব পরিবেশবান্ধব রূপান্তরের মাধ্যমে পরিবার, শ্রমিক ও প্রতিষ্ঠানগুলোকে সামাজিক সুরক্ষার পাশাপাশি টেকসই অর্থনৈতিক কার্যক্রমকে বেগবান করতে।
বাংলাদেশে আইএলওর কান্ট্রি ডিরেক্টর টুওমো পোটিআইনেন তার বক্তব্যে বলেন, বাংলাদেশে সামাজিক বীমার পক্ষে প্রচারণা এবং ধীরে ধীরে একটি সার্বজনীন সামাজিক সুরক্ষাব্যবস্থার দিকে যাওয়া, প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রতিকূল প্রভাব মোকাবিলায় একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। সমাজের সবচেয়ে দুর্বল ও অরক্ষিত শ্রেণির প্রতি মনোনিবেশ করে একটি সার্বজনীন সামাজিক সুরক্ষাব্যবস্থা তৈরি করতে চাইলে সরকার ও সামাজিক অংশীদারদের সঙ্গে আইএলও কাজ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
অন্যদিকে, ওয়ার্ল্ড ইকনোমিক ফোরাম প্রকাশিত বৈশ্বিক ঝুঁকি সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান দশম। বাংলাদেশ দ্রুতগতি ও ধীরগতি- উভয় ধরনের দুর্যোগে আক্রান্ত হচ্ছে। বাংলাদেশ যেসব দুর্যোগের শিকার হচ্ছে তার বেশিরভাগের জন্য সমষ্টিগতভাবে ঝড় ও বন্যাই দায়ী। বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো ঘরবাড়ি এবং ফসল ও গবাদিপশু, সম্পদ ধ্বংস হয়। এর ফলে উপকূলের মানুষ নি:স্ব হয়। তখন তাদের পরিবারের শিশুরা সুরক্ষার সংকটে পতিত হয়। অবশ্য এ জন্য সরকার ২০১৫ সালের জাতীয় সামাজিক সুরক্ষা কৌশল প্রণয়ন করে। কিন্তু যথাযথভাবে এই কৌশল কাজে লাগানো হয়নি। কারণ যাদের সবচেয়ে বেশি সুরক্ষার প্রয়োজন তাদের সেভাবে এতে অন্তভুক্ত করা হয়নি।
এমনি অবস্থায় জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ একটি আন্তর্জাতিক সার্বজনীন মানবাধিকার দলিল। এতে স্বাক্ষর দিয়ে শিশুদের কল্যাণে যথাসম্ভব উদ্যোগ ও সহযোগিতা প্রদানে বাংলাদেশ সরকার দেশের জনগণ এবং জাতিসংঘের কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। শিশু অধিকার সনদ বাস্তবায়নে সমাজসেবা অধিদফতর শিশু উন্নয়ন ও শিশু সুরক্ষা বিষয়ক বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করছে। এরই ধারাবাহিকতায় সংস্থাটি ঝুঁকিপূর্ণ শিশুদের সুরক্ষা নিশ্চিতকল্পে তাৎক্ষণিক সহায়তার জন্য সার্ভিসেস ফর চিলড্রেন এট রিস্ক (স্কার) প্রকল্প গ্রহণ করে। বিশ্ব ব্যাংকের ঋণ সহায়তায় দেশের ৭টি বিভাগীয় শহরে স্থাপিত ৭টি ইন্টিগ্রেটেড চাইল্ড প্রটেকশন সার্ভিস সেন্টারের মাধ্যমে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুদের সেবা প্রদান করা হচ্ছে।
অবশ্য শিশুদের আরও বেশি মাত্রায় সুরক্ষা দিতে সামাজিক নিরাপত্তা কৌশল প্রণয়ন করে। যাতে শিশুর সামাজিক নিরাপত্তাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। একই সঙ্গে সরকারের ১৫টি মন্ত্রণালয়/বিভাগ বিভিন্নভাবে শিশু-কেন্দ্রিক বা শিশু-সংবেদনশীল সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বাস্তবায়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হয়ে কাজ করছে। পাশাপাশি পথশিশুদের সামাজিক সুরক্ষা ও পরিবারে পুনঃএকীকরনে ঢাকা, চট্টগ্রাম এবং বরিশাল বিভাগীয় শহরে মোট ছয়টি কেন্দ্র রয়েছে। তাছাড়া সিলেট, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ এবং রংপুর জেলার বিভিন্ন উপজেলা এবং চা-বাগানের মাতৃ-পিতৃহীন ও সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের সুরক্ষায় কাজ করছে।
বাল্যবিবাহ থেকে সুরক্ষা এবং শিশুশ্রম থেকে সুরক্ষা প্রদানে মাসিক অর্থসহায়তা দেয়া হচ্ছে। এছাড়া, দেশব্যাপী এ কার্যক্রম সম্প্রসারণের জন্য সমাজসেবা অধিদফতরে সেন্ট্রালাইজ কল সেন্টার (সিসিসি) স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। অবশ্য বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে দারিদ্র্য একটি সমস্যা। বিদ্যমান এ সমস্যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে দারিদ্র্যের দুষ্ট শ্ঙ্খৃল তৈরি করে। দরিদ্রতার কারণেই শিশুরা শিক্ষা লাভের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়ে অল্প বয়সেই উপার্জনে নেমে পড়ে; ফলে ভবিষ্যতে তাদের পর্যাপ্ত আয়মূলক কাজের সুযোগ কমে যায়। এই শিশুদের ভবিষ্যৎ ‘স্বল্প শিক্ষা স্বল্প আয়’ পরিক্রমায় ঘুরপাক খেয়ে দরিদ্র্যের দুষ্টচক্রের অংশ হয়ে যায় দারিদ্রের দুষ্ঠু চক্র থেকে উত্তরণের পথ হিসেবে দরিদ্র্য হ্রাস বা দূর করার মাধ্যমে শিশুদের স্কুলে অংশগ্রহণ বৃদ্ধি করা এবং ভবিষ্যতে দক্ষকর্মী হিসেবে গড়ে তোলার জন্য শিশুশ্রম বন্ধ করা অত্যাবশ্যক। বর্তমানে নোবেল জয়ী ড.মুহাম্মদ ইউনূসের নের্তৃত্বাধীন অন্তবর্তীকালীন সরকার সকল শিশুকে সামাজিক সুরক্ষার আওতায় আনার পাশাপাশি শিশু শ্রম,বাল্যবিয়েবন্ধসহ শিশুদের উপর সকল নিপীড়ন বন্ধ করার অবস্থান ব্যক্ত করেছেন। আমাদের প্রত্যাশা অন্তবর্তীকালীন সরকার সেই অঙ্গীকার বাস্তবায়ন করবেন।
লেখিকা: ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক এবং নর্থ সাউথ বিশ্বদ্যালয়ে অধ্যায়নরত।
পিআইডি ফিচার