বুলেট কেড়ে নিল নাঈমার প্রাণ

সিলেট পোস্ট ২৪ ডেস্ক
প্রকাশিত হয়েছে : ১৯ অক্টোবর ২০২৪, ৭:৪৩ অপরাহ্ণমোহাম্মাদ সায়েম হোসেন::একদিন অফিসে কোনো এক ভদ্র লোক আমার নিজ ঠিকানা জানতে চাইলেন,আমি বললাম চাঁদপুর, মতলব। এবার তিনি বললেন চাকুরি পরীক্ষার বোর্ডে এক প্রশ্নকর্তা প্রশ্ন করলেন, আকার ওকার নেই এমন একটি উপজেলার নাম বলুন। চাকুরি প্রার্থী উত্তর দিলেন, ‘মতলব’। আবার অনেকে প্রশ্ন করেন, আপনার ‘মতলব’ কী? আমি বলি, মতলব একটি উপজেলা। মতলব উপজেলা নিয়ে এমন অনেক হাস্য-রসের গল্প আছে। বাস্তবে মতলব উপজেলা বাংলাদেশের একটি বিখ্যাত উপজেলা। এই উপজেলার মধ্যদিয়ে বয়ে চলছে সর্পিলাকার নদী ধনাগোদা। মতলব আজ ২৫ মাইল দৈর্ঘ্যের এই ধনাগোদা নদী দ্বারা মতলব উত্তর ও মতলব দক্ষিণ দুই উপজেলায় বিভক্ত। প্রশাসনিক কারণে মতলব উপজেলা বিভক্ত হলেও চলনে, বলনে ও মননে মতলববাসী এক ও অভিন্ন। বরং ধনাগোদা দুই পাড়ের মানুষকে এক সুতায় বেঁধেছে। এই নদীর পাড়ে ছোট্ট গ্রাম আমুয়া কান্দা। দক্ষিণা বাতাস, নদীর স্বচ্ছ জলের মাছ আর সবুজ ফসলের মাঠ এই গ্রামের মানুষের অবিচ্ছেদ্যে অংশ।
গোলাম মোস্তফা দেওয়ান এই গ্রামের বাসিন্দা। তিনি পেশায় একজন হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক। মতলব দক্ষিণ উপজেলার নারায়ণপুর বাজারে ছোট্ট একটি হোমিওপ্যাথিক ঔষধের দোকান আর চিকিৎসা কেন্দ্র তার আয়ের একমাত্র অবলম্বন। বাজারের আশেপাশে পাঁচ গ্রামের মানুষ তার কাছে চিকিৎসা ও ঔষধ গ্রহণ করে। মানুষ তাকে দেওয়ার হোমিও বলে চিনে ও জানে। দেওয়ান সাহেব সহজ,সরল,নিরীহ মানুষ। সাদাসিধে জীবনযাপন করেন। তার ছিল তিন সন্তান দুই মেয়ে ও এক ছেলে।
গ্রাম্য হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক গোলাম মোস্তফা দেওয়ান স্বপ্ন দেখতেন, একদিন তার সন্তানরা মানুষের মতো মানুষ হবে। বড়ো ডাক্তার হবে। দেওয়ান সাহেব তার স্বপ্ন পূরণের প্রত্যাশায় ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে ঢাকার উত্তরায় ভাড়া বাসায় সন্তানসহ স্ত্রী আইনুন নাহারকে নিয়ে উঠেন। উওরার ৯ নং সেক্টরের ১৫ নং বাড়ির ৪র্থ তলায় হয়ে যায় অস্থায়ী ঠিকানা। বড়ো মেয়ে তাসফিয়া সুলতানা ঢাকা মাইলস্টোন কলেজের একাদশ শ্রেণিতে পড়ে। ছোটো ছেলে আব্দুর রহমান উত্তরার একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। মেজো সন্তান নাঈমা সুলতানা পড়তেন মাইলস্টোন কলেজে দশম শ্রেণিতে।
আর দেওয়ান সাহেব নারায়ণ পুর বাজারে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা পেশায় কাজ করতেন এবং মাঝে মাঝে ঢাকায় এসে সন্তানের খোঁজ নিতেন। এমনি করে চলছিল মোস্তফা আর আইনুন নাহারের সংসার। দিন যায় মাস আসে সুখে শান্তিতে চলছিল তাদের শহুরে জীবন। গোলাম মোস্তফা দেওয়ান সাহেবের তিন সন্তানের মধ্যে নাঈমা সুলতানা অধিকতর মেধাবী। ২০০৯ সনের ২৫ জুলাই চাঁদপুরের মতলব উত্তর উপজেলার আমুয়া কান্দা গ্রামে মোস্তফা-আইনুন আলয়ে জন্ম গ্রহণ করে। নাঈমা ১৫৫ নারায়ণ পুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ২০০৯ সনে প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায় জিপিএ ৫.০০ অর্জন করে।অতঃপর পুটিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত মতলব উপজেলার প্রত্যান্ত গ্রামে পড়াশোনা করেন। বাবার স্বপ্ন পূরণের জন্য ডাক্তার হবার ইচ্ছায় পরিবারের সাথে ঢাকায় চলে আসেন।
সকল সরকারি চাকুরিতে বিশেষ করে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির চাকুরিতে বিদ্যমান কোটা প্রথা সংস্কার নিয়ে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ এর ব্যানারে পহেলা জুলাই থেকে বিক্ষোভ করে আসছিল। তাদের দাবি প্রথম এবং দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকুরিতে কোটা প্রথা বাতিল। সারাদেশে অহিংস এই আন্দোলন সহিংসতায় রূপ নেয় ১৫ জুলাই থেকে। দেশে সব ধরনের সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে কোটার ভিত্তিতে নিয়োগের প্রচলিত ব্যবস্থা সংস্কারের দাবিতে সংগঠিত সাম্প্রতিক আন্দোলনই হলো কোটাবিরোধী আন্দোলন। প্রকৃতপক্ষে কোটাবিরোধী মূল আন্দোলন শুরু হয়েছিল ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে। ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্রেক্ষিতে একটি পরিপত্র জারি করা হয়েছিল। ২০২৪ সালের ৫ জুন সেই পরিপত্রটি হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ অবৈধ ঘোষণার পর কোটা পদ্ধতির সংস্কার আন্দোলন নতুন মাত্রা পায়। কোটাবিরোধী আন্দোলন প্রথমে সভা সমাবেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও ১৪ জুলাইয়ের পর তীব্র আকার ধারণ করে। এতে দেশ জুড়ে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। এই আন্দোলনের ফলে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী, পুলিশ, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। শতাধিক মানুষের মৃত্যু এবং বহু মানুষের আহত হওয়া রাষ্ট্রীয় গাড়ি, ভবন, অগ্নিসংযোগ, জেল ভেঙ্গে কয়েদি পালানো এবং ক্ষয়ক্ষতির ঘটনা ঘটে। এছাড়া আন্দোলনে নিহত হয় শিশু, শিক্ষার্থীসহ আরও অনেকে।
এমন কী ক্ষতির আগ্রাসনে ঘরের ভিতরেও প্রাণহানির মতো মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে। আন্দোলনে না থেকেও একেবারে সাধারণ গৃহস্থ বাড়ির কেউ কেউ প্রাণ হারান। তাদের মধ্যে একজন দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী নাঈমা সুলতানা।
১৯ জুলাই ২০২৪ শুক্রবার কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের কমপ্লিট সাটডাউন বা সর্বাত্বক অবরোধ কর্মসূচি চলছিল। কর্মসূচি ঘিরে রাজধানী ঢাকায় ব্যাপক সংঘর্ষ, হামলা, ভাংচুর, গুলি, অগ্নিসংযোগ ও প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। রাজধানী ঢাকা ছিল কার্যত অচল। পরিস্থিতি ছিল থমথমে। দেশের বিভিন্ন জেলাতেও ব্যাপক বিক্ষোভ, সংঘর্ষ ও সহিংসতা হয়। এদিন রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় গুলি ও সংঘর্ষে অন্তত ৪৪ জন নিহত হয়। সারাদেশে নিহতের সংখ্যা ৫৬ জন। আহত হন শিক্ষার্থী, রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী, পুলিশ, সাংবাদিক, পথচারীসহ কয়েকশ। শুরুতে আন্দোলনে শিক্ষার্থীরা যুক্ত থাকলেও ১৭ জুলাইয়ের পর থেকে সাধারণ মানুষ আন্দোলনে অংশ নেয়। এ আন্দোলন দমাতে ফ্যাসিবাদী সরকার সারাদেশে কারফিউ জারি, সেনাবাহিনী মোতায়েন করে। ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করে দিয়ে কার্যত গণমাধ্যমে তথ্য প্রচার বন্ধ করে দেয়।
সেদিন তপ্ত দুপুরে চারদিকে শুধু আন্দোলন-সংগ্রাম-সহিংসতা। রাজধানীজুড়ে আতঙ্ক। শহরটা যেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী চাদরে ঢাকা। সারা দেশের মত উওরার ৯ নং সেক্টরের ১৫ নং বাড়ির সামনের রাস্তায় কোটাবিরোধী আন্দোলন চলছিল। সেখানেই পরে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, গুলাগুলি শুরু হয়। আর তা দেখতেই বারান্দায় যান প্রাণোচ্ছল নাঈমা ও তার মা। ঠিক কোথায় থেকে হঠাৎ একটি গুলি এসে লাগলো নাঈমার মাথায়। মাথা ছেদ করে বের হয়ে গেল। সাথে সাথে নাঈমা মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। রক্তে রঞ্জিত হয়ে বাসার বারান্দা – ফ্লোর। নাঈমাকে তার মা উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে, কর্তব্যরত চিকিৎক জানান, নাঈমা নেই। চির বিদায় নিয়ে নাঈমা চলে গেল ওপারে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র জনতার আন্দোলনে শহিদ নাঈমা সুলতানা।
পরিবার নিয়ে রাজধানীর উত্তরায় থাকতেন, সেখানকার একটি ভবনের চারতলার বারান্দায় বাড়ির সামনের রাস্তায় কোটাবিরোধী আন্দোলন দেখতে গিয়ে গুলিতে নিহত হয় আদরের মেয়ে নাঈমা সুলতানা। বাড়িতে সে একদিন আমাকে বলেছিল, বাবা তোমার মত ডাক্তার হয়ে আমিও মানুষের সেবা করব। কান্নাজড়িত এসব কথা বলছিলেন, ১৯ জুলাই কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে গুলিতে নিহত নাঈমার বাবা গোলাম মোস্তাফা দেওয়ান।
তিনি আরও জানান, সেদিন উত্তরায় ৫ নং সড়কে শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলন চলছিল। সেখানে পুলিশের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও সংঘর্ষ হয়েছিল। উত্তরার সড়কের পাশেই একটি ভবনের চারতলায় আমার পরিবার বাস করে। সেখানকার মাইলস্টোন স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্রী ছিল নাঈমা। কে জানত বারান্দায় আনতে গিয়ে মাথায় গুলি লাগবে তার। সেখানেই লুটিয়ে পড়ে সে। তার মা ও পরিবারের লোকজন হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত বলে জানায়। ২০ জুলাই নাঈমার লাশ গ্রামের বাড়ি চাঁদপুরের মতলব উত্তর উপজেলায় আমুয়াকান্দি দেওয়ান বাড়িতে দাফন করা হয়।
নাঈমার মা আইনুন নাহার বলেন, বাসার সামনে ঝামেলা হচ্ছিল, তা দেখতে তারা বাসার বারান্দায় দাঁড়িয়েছিল। কিছু বুঝে ওঠার আগেই তার মেয়ের মাথায় গুলি লাগে। সেখানেই রক্তাক্ত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। আর কোনো স্কুল ছাত্রী নিহত হোক তা চাননা নাঈমা সুলতানার মা-বাবা।
নাঈমা দাদী কান্নাজড়িত কন্ঠে বলছেন, নাঈমা অনেক ভদ্র, অনেক শান্ত. অনেক ভালো সভ্য, ভালো মেয়ে ছিল। বারান্দায় উকি দিয়েছিল, গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর শুধু ‘মা’ বলছিল। নিজ পরিবারে প্রাণ হারানোয় কান্না যেন আর থামছেই না নাঈমার পরিবারের। এমন নির্মম হত্যার বিচার দাবি করেন তার পরিবার।
ঘাতকের বুলেট কেড়ে নিল নাঈমার প্রাণ। নিভে গেল দেওয়ান সাহেবর স্বপ্ন। একটি স্বপ্নের অকাল মৃত্যু হলো। আর মাত্র ছয় দিন পরই তার পনেরো বছর পূর্ণ হতো। ছোট্ট কিশোরী মেয়ে নাঈমা সুলতানা আজ পৃথিবীতে নেই। শূন্য ঘরে শুধুই আর্তনাদ। চির নিদ্রায় শায়িত আমুয়া কান্দা গ্রামের পারিবারিক কবরস্থানে। ভালো থাকো নাঈমা তুমি।
রক্ত ভেজা পোশাক ও ব্যবহার্য জিনিসপত্র আজ শুধুই জুলাই স্মৃতি চিহ্ন। স্বপ্ন নিয়ে এসেছিল ইট পাথরের এই শহরে ফিরতে হলো লাশ হয়ে।
প্রিয় পাঠকগণ প্রশ্ন একটাই, কী অপরাধ ছিলো নাঈমার?
পিআইডি ফিচার