সমুদ্র গবেষণা ও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি

সিলেট পোস্ট ২৪ ডেস্ক
প্রকাশিত হয়েছে : ০৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১:৪৫ অপরাহ্ণআবদুল মালেক::বঙ্গোপসাগরের বিপুল সম্পদ অনুসন্ধান, আহরণ এবং সংরক্ষণের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতি সমৃদ্ধ করা ও দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্যে বাংলাদেশ ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউট (বিওআরআই) প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার সমুদ্র অঞ্চল এবং ২০০ নটিক্যাল মাইলের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলসহ চট্টগ্রাম উপকূল থেকে ৩৫৪ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত মহীসোপানে বাংলাদেশের সার্বভৌম অধিকার প্রতিষ্ঠিত। বঙ্গোপসাগরের এই বিশাল অঞ্চলটিতে শুধু যে মৎস্য সম্পদ রয়েছে তা নয়, রয়েছে বিপুল খনিজ ও উদ্ভিজ্জ সম্পদও, যা বাংলাদেশের সমুদ্র ভিত্তিক অর্থনীতির প্রধান ভিত্তি হয়ে উঠতে পারে। বাংলাদেশের সমুদ্র অঞ্চলকে ঘিরে বিশ্বের বহু দেশের আগ্রহ ক্রমশ বাড়ছে। এখানকার সম্পদ আহরণ, পরিবেশ সংরক্ষণ, গভীর সমুদ্রবন্দর স্থাপন এবং পর্যটন শিল্পের উন্নয়নের মাধ্যমে বাংলাদেশের অর্থনীতি আরও শক্তিশালী হবে। সমুদ্রের সম্পদ আহরণ ও ব্যবহারে দক্ষতা বৃদ্ধির পাশাপাশি পরিবেশগত স্থিতিশীলতাও বজায় রাখতে হবে, যা একটি জটিল ও দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। এ প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউট (বিওআরআই) ভূমিকা পালন করছে। এছাড়াও বাংলাদেশ ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউট বর্তমানে ভৌত সমুদ্রবিদ্যা, ভূতাত্ত্বিক সমুদ্রবিদ্যা, রাসায়নিক সমুদ্রবিদ্যা, জৈব সমুদ্রবিদ্যা এবং জলবায়ু পরিবর্তন ও সমুদ্র বিষয়ে ব্যাপক গবেষণা পরিচালনায় প্রধান ভূমিকা পালন করছে।
সমুদ্রের পানির ভৌত বৈশিষ্ট্য যেমন: তাপমাত্রা, ঘনত্ব, চাপ, তরঙ্গ ও সমুদ্রস্রোতের গতি নিয়ে গবেষণা করা হয়। এগুলো সমুদ্রের পরিবেশগত পরিবর্তন নির্ণয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চল প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রবণ হওয়ায় ভৌত সমুদ্রবিদ্যার গবেষণা প্রয়োজনীয়তা আরও বেশি। বিওআরআই এ ক্ষেত্রে ঘূর্ণিঝড়, মৌসুমি বায়ু, সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি, পলল পরিবহণ ও সমুদ্র সৈকতের ক্ষয়-বৃদ্ধি নিয়ে গবেষণা করছে, যা দেশের জন্য পরিবেশগত ঝুঁকি নিরূপণে সহায়ক হবে। ভূতাত্ত্বিক সমুদ্রবিদ্যা সমুদ্রের তলদেশের কাঠামো, গঠন এবং ইতিহাসের ওপর গুরুত্ব দেয়। এই শাখার মাধ্যমে সমুদ্রের তলদেশের পলল, শিলা, খনিজ পদার্থ এবং জীবাশ্মের গঠন ও পরিবর্তন নিয়ে গবেষণা করা হয়। বিওআরআই-এর রাসায়নিক সমুদ্রবিদ্যা শাখা সমুদ্রের অক্সিজেনের ঘনত্ব, পুষ্টি পদার্থ, এবং সমুদ্রের অম্লতা বিষয়ে গবেষণা করে। এটি পরিবেশগত দূষণ এবং জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাব নির্ণয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সমুদ্রের রাসায়নিক গঠনের পরিবর্তন কীভাবে সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রে প্রভাব ফেলে তা বোঝার জন্য এই গবেষণা অপরিহার্য।
জৈবিক সমুদ্রবিদ্যায় সামুদ্রিক প্রজাতির বণ্টন, প্রাচুর্য ও বৈচিত্র্য, এবং জীববৈচিত্র্যের বিভিন্ন দিক নিয়ে গবেষণা করা হয়। এতে সামুদ্রিক প্রাণীদের অভিযোজন, খাদ্য শৃঙ্খল, বিপাক ও উৎপাদনশীলতা নিয়ে গবেষণা করা হয়। সামুদ্রিক জীবজগৎ কীভাবে বৈশ্বিক কার্বন চক্রে ভূমিকা রাখে তাও বিশ্লেষণ করা হয়। এই গবেষণা সুনীল অর্থনীতির জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ কারণ মাছসহ সামুদ্রিক জীব বৈচিত্র্যের অবস্থা বুঝে আহরণের সুপারিশ করা যায়।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে এবং সমুদ্রের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি ও উষ্ণায়ন এর অন্যতম প্রভাব। বিওআরআই জলবায়ু পরিবর্তন এবং সমুদ্রের বাস্তুতন্ত্রে তার প্রভাব নিয়ে গবেষণা করে, যা ভবিষ্যৎ জলবায়ু পূর্বাভাস নির্ধারণে সহায়ক। সমুদ্রপৃষ্ঠের গরম হয়ে যাওয়ার কারণে ঘূর্ণিঝড় ও মৌসুমি বায়ু প্রবাহের গতিপথে পরিবর্তন আসছে, যা বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে বারবার দুর্যোগ নিয়ে আসছে। বর্তমান জলবায়ু কখন তার স্বাভাবিক সীমার বাইরে থাকে তা নির্ধারণের জন্য জলবায়ু ব্যবস্থার প্রাকৃতিক পরিবর্তনশীলতা বোঝা অপরিহার্য। যেহেতু থার্মোমিটার, রেইনগেজ, ওয়েদার বেলুন, ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ ভেসেল এবং স্যাটেলাইট এক শতাব্দীরও কম সময় ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হয়েছে।
বিওআরআই উপকূলীয় অঞ্চলে যেকোনো সরকারি বা বেসরকারি প্রকল্প গ্রহণের আগে তার পরিবেশগত প্রভাব নির্ণয় ও পরিবেশগত সুরক্ষার জন্য প্রতিবেদন প্রদান করে। এ প্রতিষ্ঠান তৈল দূষণ ঝুঁকি নিরূপণ এবং একটি আধুনিক Oceanographic Data Centre প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করে। এসব তথ্য ভবিষ্যৎ গবেষণার জন্য সহায়ক, যা উপকূলীয় সম্পদ ব্যবস্থাপনায় সহায়ক হবে। বিওআরআই-এর বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মধ্যে রয়েছে উপকূলীয় পরিবেশের ক্ষতি নিরূপণ, পলল কণা স্থানান্তর ও সমন্বিত উপকূল ব্যবস্থাপনা নিয়ে গবেষণা। এসব গবেষণা একত্রিত করে আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে সমুদ্র পরিবেশে দূষণ নির্ণয় ও তা প্রতিরোধে সুপারিশ প্রদান করে বিওআরআই। সমুদ্র তীরবর্তী এলাকায় প্রকল্প গ্রহণের আগে পরিবেশগত প্রভাব বিশ্লেষণ করা ও রিপোর্ট প্রদান, উপকূলবর্তী পরিবেশ পর্যবেক্ষণ এবং দূর অনুধাবন প্রযুক্তির মাধ্যমে সামুদ্রিক পরিবেশ পর্যবেক্ষণ বিওআরআই-এর অন্যতম দায়িত্ব। এ প্রতিষ্ঠানটি তৈল দূষণ ঝুঁকি নিরূপণ এবং সামুদ্রিক ডেটা সেন্টার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সমুদ্র সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ ও বিতরণ করে থাকে। জলজ এবং অজলজ, নবায়নযোগ্য ও অনবায়নযোগ্য সম্পদের টেকসই আহরণের জন্য বিওআরআই নীতি প্রণয়ন করে।
বঙ্গোপসাগর বিশ্বে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি জলাভূমি। গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, মেঘনা, হিমালয় থেকে হাজার হাজার কিলোমিটার চীন, তিব্বত মালভূমি হয়ে এই বিশাল ভূমি প্লাবিত করে পুষ্টিসমৃদ্ধ হয়েছে বঙ্গোপসাগর। এখানে শুধু মাছ নয়, বিভিন্ন জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদ রয়েছে যা জীববৈচিত্র্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশের জন্য মাছ একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ এবং দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে এর চাহিদা রয়েছে। বঙ্গোপসাগরের ইকোসিস্টেম বজায় রাখতে মেরিন প্রটেক্টেড এরিয়া গঠন এবং দূষণ নিয়ন্ত্রণ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্লাস্টিক বর্জ্য, ট্যাংকারের তেল ফেলা, এবং অবৈধ মৎস্য আহরণ এ অঞ্চলের পরিবেশকে ধ্বংস করছে, যা রোধ করা প্রয়োজন। বঙ্গোপসাগর পৃথিবীর একটি অন্যতম পুষ্টিসমৃদ্ধ জলাভূমি। আমরা যদি পরিবেশ ভালো রাখি, তাহলে বঙ্গোপসাগর হবে মাছের খনি। শুধু মাছ নয়, জলজ প্রাণী, উদ্ভিদ সহ বিভিন্ন জীবের আবাসস্থল এই বঙ্গোপসাগর। এদের সবাইকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। বিশ্বেরপ্রায় তিন বিলিয়ন মানুষ সমুদ্রের ওপর নির্ভরশীল। সমুদ্র ৫০ শতাংশ অক্সিজেন দিচ্ছে। ১০ গিগাটন কার্বন শুষে নিচ্ছে। এই পণ্যের কারখানা হলো সাগর। কারখানা যদি ঠিক না থাকে, তাহলে পণ্য উৎপাদিত হবে না। সমুদ্র আমাদের একটি বিশাল সম্পদের জায়গা। এর ইকোসিস্টেম যেন বজায় থাকে। ইকোসিস্টেম বজায় থাকার একটা মাধ্যম হচ্ছে মেরিন প্রটেক্টেড এরিয়া। কোভিড–১৯-এর জন্য আমরা বুঝতে পেরেছি প্রোটিন, মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট শরীরের জন্য কত গুরুত্বপূর্ণ। যে সব উপাদান থেকে প্রোটিন পাওয়া যায়, তার মধ্যে মাছ অন্যতম। এ ক্ষেত্রে সামুদ্রিক মাছ আরও গুরুত্বপূর্ণ। সামুদ্রিক মাছ খেলে আর জিংক ট্যাবলেট খেতে হবে না। বঙ্গোপসাগর বিশাল এক ইকোসিস্টেম। এই সাগরের ওপর অধিকার রাখে এমন ৮ টি দেশ যত রকমের প্রযুক্তি আছে, সেটা ব্যবহার করে মাছ ধরছে। অন্যান্য জলজ প্রাণীও ধরছে। সব কটি দেশই নদ-নদী ও তাদের শিল্পের মাধ্যমে সাগরকে দূষণ করছে। নানা ভাবে ছোট বড় মাছগুলোকে ধ্বংস করা হচ্ছে। অসংখ্য ট্যাংকার এই সাগরের ওপর দিয়ে প্রতিনিয়ত চলাচল করছে। এসব ট্যাংকারের বর্জ্য সাগরকে দূষিত করছে। যে সময় বঙ্গোপসাগর থেকে অন্যান্য দেশ ৩০–৪০ শতাংশ মাছ কম আহরণ করতে পারছে, সেখানে আমাদের জাটকা ধরা বন্ধের জন্য প্রতিবছর মৎস্য উৎপাদন ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বিওআরআই ২০২৫ সালে সমুদ্রবিদ্যা বিষয়ে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজন করতে যাচ্ছে, যার নাম ICO (International Conference on Oceanographic)। এর লক্ষ্য শীর্ষস্থানীয় বিজ্ঞানী, গবেষক ও শিক্ষাবিদদের একত্রিত করা এবং তাদের অভিজ্ঞতা ও গবেষণার ফলাফল বিনিময় করা। এ সম্মেলনটি ভৌত ও মহাকাশ সমুদ্রবিদ্যা, রাসায়নিক সমুদ্রবিদ্যা, জৈবিক সমুদ্রবিদ্যা, ভূতাত্ত্বিক সমুদ্রবিদ্যা, পরিবেশগত সমুদ্রবিদ্যা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ওপর বিশেষভাবে ফোকাস করবে। ICO 2025 সম্মেলনে সামুদ্রিক সম্পদ সংরক্ষণ ও আহরণ, জীববৈচিত্র্যের সুরক্ষা, এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলার বিষয়ে আলোচনা হবে। গবেষক, অনুশীলনকারী ও শিক্ষাবিদরা সমুদ্রসম্পদ ব্যবস্থাপনায় উদ্ভাবনী প্রযুক্তি এবং কৌশল শেয়ার করতে পারবেন। বঙ্গোপসাগরকে ঘিরে এত দেশের আগ্রহ, তবুও স্থানীয়ভাবে বাংলাদেশ এ বিষয়ে যথেষ্ট গুরুত্ব দিতে পারেনি। ICO 2025 সম্মেলন দেশের জনগণকে সচেতন করতে এবং আন্তর্জাতিকভাবে দেশী ও বিদেশি বিজ্ঞানী ও গবেষকদের সম্মানিত করতে এবং নতুন নতুন গবেষণায় উদ্বুদ্ধ করতে সহায়ক হবে।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিবেশগত স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে বঙ্গোপসাগরের সম্পদ ব্যবস্থাপনা ও সুরক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সঠিকভাবে বঙ্গোপসাগরের সম্পদ ব্যবস্থাপনা ও আহরণ করা হলে এটি দেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে পারে। সঠিক ব্যবস্থাপনা ও গবেষণা অব্যাহত থাকলে মৎস্য আহরণ, পর্যটন এবং জ্বালানি খাতেও বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। এর জন্য জনসচেতনতা বৃদ্ধি, গবেষণায় বিনিয়োগ এবং প্রযুক্তি ব্যবহার বৃদ্ধি প্রয়োজন। আমাদের এত বড় সমুদ্র, সেখানে যে সম্পদ আমরা পেয়েছি, তা রক্ষা করতে হবে। পৃথিবীর অন্য অনেক দেশের মতো বাংলাদেশের সমুদ্র জীববৈচিত্র্যে ভরপুর। এই সম্পদকে আমরা যদি সুষ্ঠুভাবে রক্ষা না করতে পারি, আমাদের সমুদ্রও জীববৈচিত্রশূন্য হয়ে যাবে। বড় বড় প্রাণী ও মাছ শূন্য হয়ে যাবে। আমরা সমুদ্রকে রক্ষা করতে চাই। সেজন্য এটার একটা ভালো ব্যবস্থাপনা চাই। প্লাস্টিকের বর্জ্যের বিষয়ে সচেতন হতে হবে। শুধু মাছ নয়, মাছের পাশাপাশি অনেক সম্পদ রয়েছে সমুদ্রে। সামুদ্রিক সম্পদকে যদি রক্ষা করতে হয়, আমাদের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। সাগরের সম্পদ ব্যবস্থাপনায় প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অবৈধ মৎস্য আহরণ ও পরিবেশ দূষণ মোকাবিলায় যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। এ ক্ষেত্রে জনগণকে সমুদ্র সম্পদ সংরক্ষণে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে।
পিআইডি ফিচার