মো. খালিদ হাসান::ইন্টারনেট এবং ডিজিটাল মাধ্যমে অবাধ তথ্য প্রবাহের যুগে গুজব একটি মারাত্মক সমস্যা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। বিশেষত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বহুল বিস্তারের কারণে তথ্যের সঠিকতা যাচাই না করেই বিভিন্ন মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর তথ্য খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। গুজবের মতো সংকট থেকে মুক্তি পেতে প্রাতিষ্ঠানিক ফ্যাক্ট চেকিংয়ের পাশাপাশি নাগরিকদের সক্রিয় ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। নাগরিক ফ্যাক্ট চেকিং হলো সাধারণ মানুষ কর্তৃক স্বতঃস্ফূর্তভাবে তথ্য যাচাই করে মিথ্যা বা বিভ্রান্তিকর তথ্যের সত্যতা নির্ধারণের ধারাবাহিকতায় তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তুলে ধরার প্রয়াস।
সম্প্রতি বিভিন্ন গণমাধ্যমের সংবাদ ফটোকার্ডের অনুকরণে নানা ধরনের বিভ্রান্তিকর অপতথ্য ও গুজবে ফেসবুকের নিউজফিড সয়লাব হতে দেখা যায়। তাছাড়া সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের প্যাডের অনুকরণে উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে মিথ্যা ও বানোয়াট তথ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার প্রবণতা অন্য সময়ের তুলনায় ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। গুজব ছড়ানোর ঘটনা ডিজিটাল বিপ্লবের সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে। বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় বিষয় নিয়ে প্রচুর গুজব ছড়ানো হয়েছে, যার ফলে কখনো কখনো প্রাণহানির ঘটনাও ঘটেছে। গুজবের প্রভাব শুধু ব্যক্তি বা পরিবারের উপর সীমাবদ্ধ থাকে না, এটি সামাজিক স্থিতিশীলতা এবং রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলাও বিঘ্নিত করে।বাংলাদেশ বহুধর্মীয়, বহু-সাংস্কৃতিক, এবং বহুভাষাভাষী মানুষদের নিয়ে গঠিত একটি রাষ্ট্র। এখানে বহু বছর ধরে ধর্মীয় সহাবস্থান এবং সম্প্রীতির সংস্কৃতি বিরাজ করছে। তবে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে গুজব এবং মিথ্যা তথ্য ছড়ানোর কারণে ধর্মীয় সম্প্রীতি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। গুজব, বিশেষ করে ধর্মীয় বিষয়কে কেন্দ্র করে ছড়ানো মিথ্যা তথ্য, সমাজে অস্থিরতা, সহিংসতা এবং বিদ্বেষ সৃষ্টির অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ধর্মীয় গুজবের কারণে বেশ কয়েকটি সহিংসতার ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো ২০২১ সালে কুমিল্লায় দুর্গাপূজার সময় কোরান অবমাননার গুজব এবং ২০১২ সালের রামুতে বৌদ্ধ মন্দিরে হামলা। এই ধরনের গুজবের ফলে সামাজিক সম্প্রীতির উপর আঘাত আসে এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান বিঘ্নিত হয়। কক্সবাজারের রামুতে ২০১২ সালে ফেসবুকে একটি ভুয়া পোস্টের মাধ্যমে ধর্মীয় গুজব ছড়ানো হয়, যেখানে দাবি করা হয়েছিল যে একজন বৌদ্ধ যুবক ইসলাম ধর্মের অবমাননা করেছে। এই গুজবের প্রেক্ষিতে স্থানীয় জনতা একত্রিত হয়ে বৌদ্ধ মন্দির ও ঘরবাড়িতে হামলা চালায়। এই সহিংস ঘটনার ফলে বহু মন্দির ধ্বংস হয় এবং স্থানীয় বৌদ্ধ সম্প্রদায় আতঙ্কিত হয়। পরে তদন্তে প্রমাণিত হয় যে ওই যুবককে মিথ্যা অভিযোগে ফাঁসানো হয়েছিল। কুমিল্লায় একটি পূজামণ্ডপে কোরানের অবমাননার মিথ্যা অভিযোগে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। এতে দেশের বিভিন্ন স্থানে পূজামণ্ডপে হামলা চালানো হয় পরবর্তীতে যা একাধিক প্রাণহানির ঘটনায় পরিণত হয়। পরে পুলিশের তদন্তে দেখা যায় ধর্মীয় অস্থিরতা সৃষ্টি লক্ষ্যে এটি ছিল একটি পরিকল্পিত উসকানি। এছাড়া ২০২০ সালে করোনা মহামারির সময় টিকা নিয়ে বিভ্রান্তিকর অপতথ্য সমাজে আতঙ্ক ও বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছিল।
ফ্যাক্ট চেকিং হলো এমন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে কোনো তথ্যের সঠিকতা যাচাই করা হয়। এটি সংবাদ, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারিত তথ্য বা ব্যক্তিগতভাবে প্রাপ্ত তথ্যের সত্যতা যাচাইয়ের একটি পদ্ধতি। ফ্যাক্ট চেকিং সাধারণত গণমাধ্যমের একটি দায়িত্ব তবে নাগরিক ফ্যাক্ট চেকিং প্রক্রিয়ায় সাধারণ জনগণ সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ফ্যাক্ট চেকিং বিশেষভাবে প্রয়োজনীয়। বাংলাদেশের গণমাধ্যম এবং তথ্য প্রবাহের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের চ্যালেঞ্জ রয়েছে। অনেক সময় রাজনৈতিক প্রভাব বা অন্য কোনো উদ্দেশ্যে কিছু মিডিয়া মিথ্যা বা বিকৃত তথ্য প্রকাশ করে। সাধারণ জনগণ অনেক সময় অজান্তেই মিথ্যা তথ্য শেয়ার করে যা পরবর্তিতে গুজব হিসেবে বিভিন্ন মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। বাংলাদেশের নাগরিকদের একটি বড়ো অংশ এখনো প্রযুক্তি সম্পর্কে সচেতন নয়। তারা তথ্য যাচাই করার পদ্ধতি সম্পর্কে অবগত নয়। এমন পরিস্থিতিতে ফ্যাক্ট চেকিংকে একটি সাধারণ ও গ্রহণযোগ্য প্রক্রিয়া হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা জরুরি, এবং নাগরিকদেরও এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত করা প্রয়োজন। গুজব প্রতিরোধে নাগরিক ফ্যাক্ট চেকিং বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে। বাংলাদেশে নাগরিকদের তথ্য যাচাই করার দক্ষতা বাড়িয়ে তোলার মাধ্যমে সমাজকে মিথ্যা এবং বিভ্রান্তিমূলক তথ্য থেকে সুরক্ষিত রাখা সম্ভব।মানুষ মিথ্যা তথ্য বিশ্বাস করার আগে তথ্যের সঠিকতা যাচাইয়ের দিকে মনোযোগ দেবে। সাধারণ মানুষ গুজব ছড়ানোর সাথে সাথে তা যাচাই করতে পারলে, সেই গুজবটি আর বড় আকারে ছড়াবে না। গুজবের কারণে সৃষ্ট অস্থিরতা এড়িয়ে স্থিতিশীল ও শান্তিপূর্ণ সমাজ গড়ে উঠবে।
নাগরিক ফ্যাক্ট চেকিং মূলত তিনটি ধাপের মাধ্যমে কার্যকর হতে পারে। প্রথম ধাপ হলো তথ্য সংগ্রহ করা এবং সেটি সঠিক কি না যাচাই করা। উদাহরণস্বরূপ, কোনো একটি খবর বা সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়া কোনো বার্তার ক্ষেত্রে সেটির উৎস কোথায়, কোন প্রসঙ্গে তা বলা হয়েছে, এবং সত্যতা যাচাই করতে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের তথ্য বিশ্লেষণ করা। নাগরিকরা যেকোনো তথ্যের সত্যতা যাচাই করার সময় তা বিশ্বাসযোগ্য সূত্র থেকে নিশ্চিত হতে পারে। আন্তর্জাতিক বা জাতীয় গণমাধ্যম, ফ্যাক্ট চেকিং ওয়েবসাইট বা সরকারি সংস্থার তথ্যের ভিত্তিতে সেই খবরের বিশ্লেষণ করা যেতে পারে। তথ্য যাচাইয়ের পর নাগরিকরা সেটি তাদের সোশ্যাল মিডিয়া বা ব্লগ পোস্টের মাধ্যমে জনসাধারণের কাছে তুলে ধরতে পারে। এটি গুজবের বিরুদ্ধে একটি তাৎক্ষণিক প্রতিরোধ হিসেবে কাজ করে।
যদিও নাগরিক ফ্যাক্ট চেকিং গুজব প্রতিরোধে অত্যন্ত কার্যকর তবে এর কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। বাংলাদেশে অনেক নাগরিকই ফ্যাক্ট চেকিং সম্পর্কে সচেতন নয়। তারা কীভাবে তথ্য যাচাই করতে হবে বা মিথ্যা তথ্যকে কীভাবে চিহ্নিত করতে হবে, তা জানে না।দেশের একটি বড় অংশ এখনও ইন্টারনেট এবং ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহারের সুযোগ থেকে বঞ্চিত। ফলে তারা তথ্য যাচাইয়ের প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে পারে না।কখনো কখনো গুজবের পরিমাণ এত বেশি হয় যে সব গুজব যাচাই করা নাগরিকদের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে।অনেক সময় রাজনৈতিক বা সাংস্কৃতিক কারণে কিছু গুজবকে সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়, যা নাগরিক ফ্যাক্ট চেকিংয়ের জন্য চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করে।
ফ্যাক্ট চেকিংকে আরও সহজ ও কার্যকর করতে প্রযুক্তির ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিভিন্ন ফ্যাক্ট চেকিং টুল এবং অ্যাপ্লিকেশন যেমন গুগল রিভার্স ইমেজ সার্চ, টিনআই, এবং অন্যান্য অনলাইন ফ্যাক্ট চেকিং প্ল্যাটফর্ম নাগরিকদের তথ্য যাচাই করতে সাহায্য করতে পারে। এছাড়াও বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম প্ল্যাটফর্ম যেমন ফেসবুক এবং টুইটার তাদের ব্যবহারকারীদের জন্য গুজব চিহ্নিত করার টুল তৈরি করেছে যা বাংলাদেশেও কার্যকরভাবে ব্যবহার করা যেতে পারে।
বাংলাদেশে নাগরিক ফ্যাক্ট চেকিংয়ের কিছু সফল উদাহরণও রয়েছে। ২০১৮ সালে নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময় সাধারণ শিক্ষার্থীরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়ানো গুজবের বিরুদ্ধে তথ্য যাচাই করে তাদের সহপাঠীদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করেছিল। এর ফলে আন্দোলনকারীদের মধ্যে সঠিক তথ্য ছড়িয়ে পড়েছিল এবং গুজবের মাধ্যমে সৃষ্ট বিভ্রান্তি কমেছিল। করোনা মহামারির সময়েও অনেক নাগরিক ফ্যাক্ট চেকার এবং স্থানীয় গণমাধ্যম স্বাস্থ্য সম্পর্কিত বিভিন্ন গুজবের বিরুদ্ধে কাজ করেছিল। এ ধরনের ফ্যাক্ট চেকিং প্রচারাভিযান মানুষকে সঠিক তথ্য পেতে সাহায্য করেছে এবং স্বাস্থ্য সংকট মোকাবিলায় সাহায্য করেছে। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের সম্প্রসারণ এবং গুজব ছড়ানোর নতুন নতুন কৌশল আবিষ্কারের কারণে সমাজে নাগরিক ফ্যাক্ট চেকিংয়ের গুরুত্ব বাড়ছে। ভবিষ্যতে, প্রযুক্তির আরও উন্নতি এবং জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে নাগরিক ফ্যাক্ট চেকিং আরও কার্যকর হতে পারে।
নাগরিকদের জন্য ফ্যাক্ট চেকিং সম্পর্কিত প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালু করা অত্যন্ত জরুরি যাতে তারা সহজে মিথ্যা তথ্য চিহ্নিত করতে পারে। পাশাপাশি ইন্টারনেট এবং ডিজিটাল মাধ্যমের সুযোগ সম্প্রসারণ করতে হবে যেন সবাই তথ্য যাচাই প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে পারে। সেইসাথে গণমাধ্যমকে স্বাধীন ও নির্ভরযোগ্য তথ্য সরবরাহে মনোযোগী হতে হলে নাগরিকদের তথ্য যাচাইয়ে সহযোগিতা করতে হবে। সাধারণ মানুষকে গুজব সম্পর্কে সচেতন করতে হবে এবং তারা যেন যাচাই না করা তথ্য শেয়ার করা থেকে বিরত থাকে এ ব্যাপারে সকলকে উৎসাহিত করতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, স্থানীয় সম্প্রদায় এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে গুজব প্রতিরোধে বিশেষ প্রশিক্ষণ কর্মসূচির আয়োজন করা যেতে পারে। যারা ইচ্ছাকৃতভাবে ধর্মীয় গুজব ছড়ায় তাদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তি আরোপ করতে হবে। তথ্যপ্রযুক্তি আইন এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনকে কার্যকরভাবে প্রয়োগ করতে হবে।
নাগরিক ফ্যাক্ট চেকিংয়ের মাধ্যমে সমাজের প্রত্যেক নাগরিক মিথ্যা তথ্যের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে গুজবের বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারে। আশার কথা এই যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারীদের মধ্যে অনেকেই এখন যথেষ্ট সচেতন। নাগরিকদের মাঝে ভুয়া ও মিথ্যা তথ্যের ফাঁদে পা দেওয়ার প্রবণতা ধীরে ধীরে কমে আসছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কোন অপতথ্য ছড়িয়ে পড়তে দেখলে মন্তব্যের ঘরে সবাই তা তুলে ধরার চেষ্টা করছেন। ডিজিটাল যুগে গুজবের বিরুদ্ধে লড়াই করতে নাগরিকদের তথ্য যাচাই করার সক্ষমতা ও সচেতনতা আরও বাড়ানো প্রয়োজন। তবে এ প্রক্রিয়ার সফল বাস্তবায়নের জন্য প্রযুক্তিগত জ্ঞান, তথ্য যাচাইয়ের সক্ষমতা এবং সচেতনতা বৃদ্ধি অত্যন্ত জরুরি। প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহার, গণমাধ্যম ও সরকারের সমন্বিত প্রচেষ্টা এবং নাগরিকদের সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে আমরা একটি তথ্যসমৃদ্ধ, শান্তিপূর্ণ এবং গুজবমুক্ত সমাজ গড়ে তুলতে পারব।
লেখকঃ সহকারী তথ্য অফিসার, তথ্য অধিদফতর, ঢাকা
(পিআইডি ফিচার)