প্রতারণার হাতিয়ার যখন গুজব

সিলেট পোস্ট ২৪ ডেস্ক
প্রকাশিত হয়েছে : ১৮ নভেম্বর ২০২৪, ৬:৩১ অপরাহ্ণনাসরীন জাহান লিপি::দুই গৃহবধূর কথোপকথন চলছে।
: শুনেছেন? সিলিন্ডার গ্যাস কেনার ঝামেলা আর করতে হবে না। বাড়িতে গ্যাসের লাইন লাগতেছে।
: আমিও দেখলাম। ফেসবুকে কে যেন পোস্ট দিছে। কোনো এক কোম্পানি না এইরকম কিছু। তারা বাসাবাড়িতে গ্যাস সংযোগ দিয়ে দেবে।
: খুব ভালো হবে। আমার উনারে বলছি।
: আমিও বলছি আমার উনারে।
সঙ্গতকারণেই গৃহবধূদের উনারাও আগ্রহী হয়েছেন। ২০০৯ সাল থেকে সরকারিভাবে আবাসিক গ্যাস সংযোগ বন্ধ করা হয়েছে। ২০১৩ সালের শেষের দিকে আবারও সংযোগ চালু করলেও ২০১৪ সালের পর আবাসিকের নতুন কোনো আবেদন নেওয়া হচ্ছে না। অবশেষে ২০১৯ সালে লিখিতভাবে আবাসিক সংযোগ স্থগিত রাখার সরকারি আদেশ জারি করাতে নতুন কোনো আবাসিক গ্যাস সংযোগের আবেদন নেওয়া হচ্ছিল না।
তাহলে দুই গৃহবধূর কথোপকথনে কেনো নতুন সংযোগের আনন্দবার্তা? এর কারণ গুজব। ফেসবুক পোস্ট থেকে তারা জানতে পেরেছেন, টাকা দিয়ে নতুন সংযোগ নেওয়া যাচ্ছে। টাকাটা দেওয়ার ব্যবস্থা করে ফেলেছেন তাদের উনারা। এরকম সময় তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ ডাকলেন সংবাদ সম্মেলন। সেই সংবাদ সম্মেলনের খবর পত্রিকায় পড়ে জানলেন তারা, তিতাস গ্যাসের কর্তাব্যক্তিরা জানিয়েছেন যে সরকার এখনো নতুন সংযোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেননি, এখনো সংযোগের আবেদনপত্র জমা নেওয়া হচ্ছে না, এখনো সরকারি আদেশ মোতাবেক বাসাবাড়িতে নতুন বা লোড বৃদ্ধির সংযোগ দেওয়া বন্ধ। প্রতারিতরা বুঝতে পারলেন, প্রতারকচক্র গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অসত্য খবর প্রকাশ করে গুজব ছড়াচ্ছে এবং গুজবকে হাতিয়ার করে জনসাধারণের পকেট কাটছে। তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ সংবাদ সম্মেলনে স্পষ্ট বলেছেন, এসব খবর সম্পূর্ণ গুজব ও ভিত্তিহীন।
সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে তিতাস সংশ্লিষ্ট সবাইকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছে। প্রয়োজনে গ্যাস বিতরণ কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছে। প্রতারণার শিকার হলে তারা নিশ্চয়ই তা করবেন বলে আশা করি।
ক্রমশ গুজব হয়ে উঠছে প্রতারণার হাতিয়ার, যার শিকার হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সাধারণ মানুষ। দেশের বিপুলসংখ্যক চাকরিপ্রত্যাশীরা সরকারি অফিসে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি পেলেই হুমড়ি খেয়ে পড়েন, গুজব কি গুজব না তা যাচাই করার মতো ধৈর্য ও সচেতনতা অনেকেরই থাকে না। এ সুযোগে প্রতারকচক্র গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে ব্যবহার করে সরকারি অফিসে নিয়োগের গুজবীয় প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সর্বস্বান্ত করছে চাকরিপ্রত্যাশী এই তরুণদের।
+৮৮০১৮৯৪৯২৫৪৯৬ নাম্বার থেকে একটি এসএমএস পেলেন হেলাল। ঢাকা মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে আবেদনের আহ্বান জানিয়ে সরকারি একটি ওয়েবসাইটের লিংক দিয়ে মোবাইল ফোনে পাঠানো ক্ষুদেবার্তায় ইংরেজিতে লেখা ছিল: ‘‘Exciting Job Opportunities in the Metro Rail! Metro Rail is hiring. No prior experience required! A huge recruitment notice has just been released https://bit.ly/job-dmtcl Apply directly with a single click through the link above (limited time only!)’’
হেলাল সত্যি সত্যিই সিঙ্গেল ক্লিকের মাধ্যমে ‘আবেদন’ করলেন। বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ টিকেট মেশিন অপারেটর পদে ১৩৯ জন এবং কাস্টমার রিলেশন অ্যাসিস্টেন্ট পদে ৬৩ জনকে নিয়োগ দেবে, যাতে আবেদনের শেষ সময় পাঁচই নভেম্বর। নির্দেশনা অনুযায়ী বিকাশ বা নগদ অ্যাপ থেকে ০১৬৪৫৯৭৩৩৫৫ নম্বরে আবেদন ফি পাঠানোর আহ্বানে সাড়া দিয়ে হেলাল বিপুল উৎসাহে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে আবেদন ফি ২২৫ টাকা পাঠালেন এবং কখনো শেষ না হওয়া অপেক্ষার বলয়ে বন্দী হলেন। প্রতারিত হয়েছেন টের পেতে সময় লেগে গেল। তখন তার রাগ আর ক্ষোভের লক্ষ্যবস্তু হলো বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ। তিনি জানতেও পারলেন না যে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের ওয়েবসাইটের ইন্টারফেস বা সরকারি ওয়েবসাইটের সাব-ডোমেইন হিসেবে পরিচালিত প্রতারকচক্র প্রতারণার জন্য নিজেদের একটি ওয়েবসাইট লিংক তৈরি করেছে। সিঙ্গেল ক্লিকে প্রতারকচক্রের ওয়েবসাইট লিংকেই যেতে হয়, আর সেটাকে দেখে কোনোভাবেই বোঝা সম্ভব নয় যে এটা সেতু কর্তৃপক্ষের ওয়েবসাইট নয়।
প্রতারকদের বুদ্ধি আছে বলতে হয়। তবে সেটা কুবুদ্ধি। চৌঠা সেপ্টেম্বর আবেদনের শেষ সময় দিয়ে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ টিকেট মেশিন অপারেটর এবং কাস্টমার রিলেশন অ্যাসিস্টেন্ট পদে নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছিল, যার আবেদন ফি হিসেবে ১০০০ টাকা ব্যাংক ড্রাফট বা পে-অর্ডার সোনালী ব্যাংকের যে কোনো শাখার মাধ্যমে পরিশোধের কথা বলা হয়েছিল। পরবর্তীতে আবেদনের সময় সীমা তেসরা অক্টোবর পর্যন্ত বাড়িয়ে একই নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি আরেকবার প্রকাশিত হয়। তবে কোনো বারেই আবেদন ফি মোবাইল ব্যাংকিং পরিষেবার মাধ্যমে পরিশোধের কথা বলা হয়নি। বিজ্ঞপ্তির কনটেন্ট ঠিক রেখে ভুয়া সময়সীমা হিসেবে পাঁচই নভেম্বর বসিয়ে মোবাইল ব্যাংকিং এর মাধ্যমে আবেদন ফি জমা দেওয়ার ‘আহ্বান’ জানিয়ে প্রতারণার ফাঁদ ফেলতে ভুয়া সাব-ডোমেইন ব্যবহার করেছে এবং ফাঁদে শিকার ধরতে ক্ষুদেবার্তা ছড়িয়ে দিয়েছে প্রতারকচক্র। গুজব আকারে এদের ক্ষুদেবার্তা পৌঁছে গেছে হেলালের মতো লাখো তরুণের কাছে। তারা প্রতারিত হয়েছেন।
অনেক নেটিজেনের কিন্তু সন্দেহ হয়েছিল। নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে ‘নভেম্বর’ বানানের জায়গায় ‘নভেম্বার’ দেখে খটকা লাগলেও আর কোনো ফাঁক নেই। এরপরও সচেতন নেটিজেনরা ট্রু-কলার অ্যাপে ফোন নম্বরটিকে স্প্যাম হিসেবে শনাক্ত করে অসংখ্যবার রিপোর্ট করেছেন। আর যে নম্বরে আবেদন ফি পাঠাতে বলা হয়েছিল, সেটিকে ট্রু-কলারে সচেতন নেটিজেনদের কল্যাণে ‘ত্রাণ বাটপাড়’ নামে চিহ্নিত করা আছে। সমস্যা হচ্ছে, সবাই তো আর সচেতন নন, অচেনা ফোন নম্বর যাচাই করতে এরকম অ্যাপ কজন ব্যবহার করেন?
এরকম প্রতারণামূলক নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির গুজব ছড়িয়ে পড়ছে অহরহ। কেবল সরকারি প্রতিষ্ঠান নয়, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ভুয়া নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির গুজবে বিশ্বাস করে প্রতারিত হচ্ছেন দেশের প্রায় ২৬ লাখ বেকার জনগোষ্ঠী। প্রতিষ্ঠানগুলোর নাম, লোগো ব্যবহার করে ভুয়া নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে প্রথমে ইমেইলে জীবনবৃত্তান্ত পাঠানোর কথা বলা হয়। এরপর মোবাইল ব্যাংকিং বা খুব কম সময় বেঁধে দিয়ে ব্যাংক ড্রাফট এর মাধ্যমে টাকা পাঠানোর নামে আর্থিকভাবে প্রতারণা করা হয়। ক্ষুদেবার্তা, ইমেইল, ফেসবুকের মতো নানা ডিজিটাল যোগাযোগ মাধ্যমকে কাজে লাগিয়ে একই কৌশলে প্রতারণা করা হয়েছে কয়েকটি সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা, সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল, পাসপোর্ট অফিসের নামে ভুয়া নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে। সর্বস্বান্ত হয়েছেন অসংখ্য মানুষ। প্রতারণা করা হচ্ছে টের পেয়ে সংশ্লিষ্ট বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান স্বপ্রণোদিত হয়ে থানায় জিডি বা সাধারণ ডায়েরি করেছেন। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী সম্ভবত এখনো এধরণের প্রতারণা ঠেকাতে পুরাপুরি সক্ষমতা অর্জন করেনি, কেননা প্রতারক চক্রদের গ্রেফতারের খবর খুব একটা চোখে পড়ে না। অথচ একাধিক চক্র সক্রিয় আছে। এদেরকে ধরা গেলে এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হলে জনমানুষের আর্থিক ও মানসিক ক্ষতি কমানোর বিষয়ে উপকারী পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হতো।
তাহলে উপায় কি? উপায় একটাই, প্রতারিত হওয়া থেকে নিজেকে বাঁচাতে সচেতন হতে হবে। ফেসবুকে বিজ্ঞাপন দেখলেই নিজের জীবন বৃত্তান্ত পাঠিয়ে দেওয়া যাবে না। মনে রাখতে হবে, জীবন বৃত্তান্ত থেকে অনেক ব্যক্তিগত তথ্য প্রতারক চক্রের হাতে তুলে দেওয়া মানে ব্যক্তিগত নিরাপত্তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা। এসব তথ্য হাতিয়ে নিয়ে প্রতারক চক্র নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে ব্ল্যাকমেইল করতে পারে।
সচেতন হওয়ার উপায় কী?
যে কোনো নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি নজরে আসলে প্রথমেই যাচাই করে নিতে হবে যে এটি আসল না কি ভুয়া। এই যাচাই করার সহজ উপায় হচ্ছে, যে প্রতিষ্ঠানের নামে বিজ্ঞপ্তি, সেই প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইট, অফিসিয়াল ফেসবুক পেজে হুবহু একই বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছে কী না, তার খোঁজ নিতে হবে। এসব জায়গায় বিজ্ঞপ্তিটি না পেলে এবং নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে দেওয়া ইমেইল ঠিকানা আর প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে দেওয়া ইমেইল ঠিকানা এক কী না, নাম বা নামের অক্ষরে কোনো হেরফের যদি পাওয়া যায়, তবে বুঝতে হবে ঝামেলা আছে। এরপরও মন যদি না মানে, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে দেওয়া যোগাযোগের জন্য যে ফোন নম্বর আছে, সেই নম্বরে ফোন করে সত্যতা যাচাই করতে হবে, সত্যিই প্রতিষ্ঠানটি এরকম কোনো নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে কী না।
সত্যিই, প্রতারকচক্রের হাত থেকে রক্ষার সক্ষমতা অর্জন করতে গুজব থেকে সাবধান হওয়ার বিকল্প নেই।
লেখিকা: উপপ্রধান তথ্য অফিসার, তথ্য অধিদফতর
পিআইডি ফিচার