ইমদাদ ইসলাম::কবি ফরিদুল ইসলাম তাঁর ‘তরুণের জয়গান’ কবিতায় লিখেছেন “আমরা অগ্নি আমরা ঝড় আমরা তরুণ দল, দেহে মোদের শক্তি আছে মনে প্রবল বল। আমি তরুণ তুমি তরুণ রক্ত মোদের তাজা, তেড়াবেড়া বক্রতাকে মোরা’ই করবো সোজা।” কবি যথার্থই বলেছেন তারুণ্যের শক্তি একটি সমাজ বা রাষ্ট্রের বড় হাতিয়ার। এই তারুণ্য এমন একটি শক্তি যা ইচ্ছা করলেই অবদমিত করা যায় না, নষ্ট করে দেওয়া যায় না বা থামিয়েও দেওয়া যায় না। সব বাধাকে অতিক্রম করে জয় নিয়ে আসাই যেন এর অভ্যাস। আমরা তারুণ্য বলতে অসম্ভবকে সম্ভব করাই বুঝি।
তারুণ্যের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে পরিবর্তনের, অর্থাৎ তারুণ্য এক জায়গায় স্থির থাকেনা, পুরাতন কে নিয়ে পড়ে থাকেনা। তাদের গতি সর্বদা চলমান; তাহাদের দৃষ্টি সর্বদা উর্ধ্বলোকে। অবদমিত দৃষ্টি দিতে তারা জানেনা।
আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর ‘যৌবনের গান’ এ তারুণ্যের জড়তাকে বার্ধক্যের সাথে তুলনা করেছেন- “বার্ধক্য তাহাই—যাহা পুরাতনকে, মিথ্যাকে, মৃত্যুকে আঁকড়িয়া পড়িয়া থাকে, বৃদ্ধ তাহারাই যাহারা মায়াচ্ছন্ন নব মানবের অভিনব জয় যাত্রার শুধু বোঝা নয়, বিঘ্ন; শতাব্দীর নব যাত্রীর চলার ছন্দে ছন্দ মিলাইয়া যাহারা কুচকাওয়াজ করিতে জানে না, পারে না; যাহারা জীব হইয়াও জড়; যাহারা অটল সংস্কারের পাষাণস্তূপ আঁকড়িয়া পড়িয়া আছে।” কবি হেলাল হাফিজের লেখা ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ কবিতায় কবি লিখলেন–“এখন যৌবন যার, যুদ্ধে যাওয়ার শ্রেষ্ঠ সময় তার।” এ যুদ্ধ মানে কারো উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা নয়, কোন কিছুর নিয়ন্ত্রণ নেয়া নয়। এ যুদ্ধ অন্যায়, অসত্যের, অবিচার, অধিকার আদায়ের, পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে স্বাধীনতা লাভের এবং সর্বোপরি ইতিবাচক পরিবর্তনের। কালজয়ী এ কবিতা প্রেরণা জুগিয়েছিল উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, মুক্তিযুদ্ধ, স্বৈরাচারবিরোধীসহ প্রগতিশীল সব আন্দোলনে।
বাংলাদেশের প্রতিটি গৌরবময় অর্জনের সার্থক রূপকার আমাদের তরুণ সমাজ। একাত্তর ও নব্বইয়ের পর আরও এক গণজোয়ার দেখল বাংলাদেশ। ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে হলো সরকার পতন। বর্তমানে দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন একটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। নানা সমস্যায় জর্জরিত রাষ্ট্রের কাঠামো ব্যবস্থা। এই সমস্যা সমাধানে তারুণ্যের চিন্তাভাবনাই তৈরি করতে পারে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের রূপরেখা। দেশের বর্তমান তরুণ প্রজন্মের রাষ্ট্র মেরামতের আগ্রহ ও দেশপ্রেমের আকুতি চোখে পড়ার মতো। বাংলাদেশ এ প্রত্যয় যেন শিশু-কিশোর-তরুণ থেকে শুরু করে সবার মাঝে নতুন আশার সঞ্চার করেছে।
বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশই তরুণ। দেশের মধ্যমা বয়স ২৭ অর্থাৎ অর্ধেক জনগোষ্ঠীর বয়স ২৭ বা এরচেয়ে কম৷ এতেই বুঝা যায় আমরা সীমাহীন মানব শক্তি, সৃজনশীলতা ও উদ্যোগে ভরা এক দেশে পরিণত হচ্ছে – প্রযুক্তিকে বরণ করে নেওয়ার মাধ্যমে এ দেশ বিশ্বমঞ্চে দ্রুত এগিয়ে যেতে পারে। এ জাতির রন্ধ্রে রন্ধ্রে এখন পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা। নাগরিকদের সমস্ত মানবাধিকার কেড়ে নেওয়া, দেড় দশক ধরে দেশের সম্পদ লুণ্ঠন করা ফ্যাসিবাদী শাসকগোষ্ঠীর পতনে নেতৃত্ব দিয়েছে এই তরুণরাই। তাদের ডাকে সাড়া দিয়েই পুরো জাতি ফ্যাসিবাদ বিরোধী বিপ্লবে যোগ দেয় এবং নতুন এক বাংলাদেশ গড়ার প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করে৷
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস গত ৮ আগস্ট দেশে ফিরে জনগণের উদ্দেশে ভাষণ দেন । তিনি বলেন, ‘যে বিপ্লবের মাধ্যমে বাংলাদেশ আজকে নতুন বিজয় দিবস সৃষ্টি করল, সেটা সামনে রেখে এবং আরও মজবুত করে আমাদের সামনে এগিয়ে যেতে হবে। যারা এটা সম্ভব করেছে, যে তরুণ সমাজ, তাদের প্রতি আমি আমার সমস্ত প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। তারা আমার পাশে আছে। এরা এ দেশকে রক্ষা করেছে। এ দেশকে নতুনভাবে পুনর্জন্ম দিয়েছে এবং এই পুনর্জন্মে যে বাংলাদেশ পেলাম, সেই বাংলাদেশ যেন অত্যন্ত দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলতে পারে, সেটাই হলো আমাদের শপথ, সেটাই আমরা রক্ষা করতে চাই, এগিয়ে নিতে চাই।’ তিনি আরও বলেন ‘তোমাদের দেখে সারা দুনিয়া শিখবে যে একটা দেশ কীভাবে তরুণ সমাজ নিগ্রহ করতে পারে, তাকে পাল্টে ফেলতে পারে। তাদের আমি এমনই উপদেশ দিই যে পুরাতনকে বাদ দাও, পুরোনো চিন্তা দিয়ে মুক্তি হবে না আমাদের। পুরো দুনিয়াতেই এটা। এটা শুধু বাংলাদেশের কথা না। তোমাদের মধ্যে যে শক্তি আছে, যে সৃজনশীলতা আছে, সেই সৃজনশীলতাও কাজে লাগাতে হবে। এটা শুধু বই-খাতায় লেখার জিনিস না। এটা প্রকাশ করার জিনিস, স্থাপন করার জিনিস।’ — ‘বাংলাদেশ একটা খুব সুন্দর দেশ হতে পারে। এটা খুবই সম্ভাবনাময় দেশ। এই সম্ভাবনাকে আমরা নষ্ট করে দিচ্ছে। এখন আবার সেই বীজতলা তৈরি করতে হবে। আবার আমাদের জেগে উঠতে হবে। ছাত্ররা এই বীজতলা তৈরি করবে। তাদের হাত দিয়েই হবে এবং তাদের দিকেই আমরা তাকাব।’ তরুণদের দিকে ইঙ্গিত করে ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘নিজেকে প্রশ্ন করুন, আমি বিশ্বের জন্য কী করতে পারি? একবার আপনি কী করতে চান, তা বুঝতে পারলে আপনি তা করতে পারবেন, কারণ আপনার সেই ক্ষমতা রয়েছে।’ — ‘বিশ্বের তরুণ প্রজন্ম এখন সমগ্র মানব ইতিহাসের সবচেয়ে শক্তিশালী প্রজন্ম। তারা যথেষ্ট স্মার্ট হওয়ার কারণে নয়, বরং তাদের হাতে প্রচুর প্রযুক্তি রয়েছে বলে।’
বাংলাদেশে ছাত্র জনতার অভ্যুত্থান এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে যে সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তাতে বাংলাদেশের মানুষ আশাবাদী।আমাদের স্বপ্ন বড় করে দেখাটা জরুরি। বড় করে স্বপ্ন দেখলে আমরা অনেক কিছু অর্জন করতে পারব। সে জন্য আমাদের গড়ে তুলতে হবে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ এবং সাংস্কৃতিকভাবে উদার এবং সক্রিয় একটি সমাজ। তরুণ তথা যুবকের স্বপ্নে, চিন্তা-ভাবনায় এবং কাজ-কর্মের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকবে দেশ, সমাজ ও আপামর জনগণের শান্তি, সমৃদ্ধি ও কল্যাণ। এসব তরুণই হবে জাতির মেরুদণ্ড। এ মেরুদণ্ডকে শক্তিশালী করে গড়ে তোলার কাজে অভিভাবক, সমাজ, এবং সর্বোপরি রাষ্ট্রকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। সঠিক পরিচর্যা পেলে একদিন তারাই তাদের মহৎ স্বপ্নগুলোকে বাস্তবে রূপ দিতে পারবে । তারুণ্যের চিন্তাভাবনাই তৈরি করতে পারে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের রূপরেখা। সুশাসন, মানসম্মত শিক্ষা, ন্যায়বিচার, দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন এবং বাকস্বাধীনতা নিশ্চিত করার প্রত্যাশা আছে তরুণদের মাঝে। তরুণরা এমন বাংলাদেশ চায়, যেখানে সকল নাগরিক সমঅধিকারের পাশাপাশি পাবে একটি উন্নত জীবনযাত্রা।
সৌন্দর্যের লীলাভূমি ও অফুরন্ত সম্ভাবনার দেশ বাংলাদেশ। আমাদের অতীত মহান ছিল। একটা সময় আমরা ছিলাম পৃথিবীর ষষ্ঠ সমৃদ্ধিশালী দেশ। আমাদের ভবিষ্যৎও হবে মহান, দেশ নিয়ে আমাদেরও আছে অনেক স্বপ্ন। তাই আমরা দেখতে চাই আগামীর বাংলাদেশ হবে দুর্নীতি, দারিদ্র্য ও বৈষম্যমুক্ত সমাজ হিসেবে । যেখানে মানবাধিকার ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে। নারীর ক্ষমতায়ন, সংখ্যালঘুদের অধিকার এবং শিশুদের সুরক্ষা প্রাধান্য পাবে। শিশুশ্রম পুরোপুরিভাবে বন্ধ হবে। বিচারব্যবস্থা হবে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ। দেশের প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক চাহিদা পূরণ হবে এবং শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও কর্মসংস্থান সবার জন্য নিশ্চিত থাকবে। আগামীর বাংলাদেশে মানুষের মত প্রকাশের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। যেন মানুষ নির্ভয়ে তার চিন্তা, মতামত এবং অনুভূতি প্রকাশ করতে পারে, এমনকি তা সরকারি বা সামাজিক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে গেলেও। আগামীর বাংলাদেশে মানুষকে মানুষ ভাবতে হবে। যে বাংলাদেশে মানুষ দুর্নীতি ও দারিদ্র্যকে পিছনে ফেলে মাথা উঁচু করে বলতে পারে আমরা একটি শান্তিপূর্ণ, সমৃদ্ধ এবং সবার জন্য নিরাপদ দেশের নাগরিক। যুবসমাজ তাদের দক্ষতা ও সৃজনশীলতা দিয়ে দেশের উন্নয়নে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে। পাশাপাশি বাংলাদেশের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সংরক্ষণ করে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান অর্জন করবে। এমন একটি উন্নত, সমৃদ্ধ ও সম্মানজনক লাল-সবুজের বাংলাদেশ আমাদের স্বপ্ন। যেখানে প্রতিটি নাগরিক গর্বিত বোধ করবে এবং জাতি হিসেবে বিশ্বমঞ্চে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে।
(পিআইডি ফিচার )