মৌলভীবাজার প্রতিনিধি : সূদুর অতীতে খাসিয়ারা ভারতের আসাম উপত্যকায় পাহাড় টিলার পাদদেশের গুহায় বসবাস করত। প্রায় ৬/৭ শ বছর পূর্বে আসামের ভয়াল বন্যায় স্রোতে খাসিয়ারা ভাসতে ভাসতে সিলেট চলে আসে। পানিতে সভ্যতা কৃষ্টির ভাষাগ্রন্থ, ধর্মগ্রন্থ সব কিছু হারিয়ে যায়। জৈন্তা রাজার অধীনে টিলার উপর তারা পুঞ্জি স্থাপন করে। বৃহত্তর সিলেটের সদর, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জও মৌলভীবাজার জেলার অরণ্য ঘেরা পাহাড়ী টিলায় বিক্ষিপ্ত ভাবে খাসিয়া আদিবাসিরা বসবাস করে। নান উত্থান পতনের মধ্য দিয়েও খাসিয়ারা তাদের অতীত সামাজিক বোধকে এখনো ধরে রেখেছে। পাহাড় টিলার উপরে পুঞ্জিতে তারা দলবদ্ধ একতাবদ্ধ হয়ে থাকে। বিহঃশত্রর হামলা থেকে নিজেদের রক্ষা করার জন্য সুপরিকল্পিত ভাবে তিন দিক বন্ধ রেখে একদিকে উঠানামার মাটিতে সিঁড়ি রাখা হয়। খাসিয়াদের কোন নিকট প্রতিবেশি নেই।সমতল বা অরণ্য ভূমির অন্য কোন জাত বা সম্প্রদায়ের মানুষের সাথে খাসিয়াদের মেলামেশা একেবারেই কম। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর খাসিয়া রাজতন্ত্রের অবসান হলেও অতীত সমাজ ব্যবস্থাতেই নিজেদের সীমাবদ্ধ রেখেছে। রাজার আমলে নিয়োজিত বংশ পরস্পরায় মন্ত্রীরা প্রতিটি পুঞ্জির শাসক, বিচারক ও রক্ষক। আদি মঙ্গোলয়েড জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভূক্ত খাসিয়াদের গায়ের রং ফর্সা। পুরূষদের হাল্কা দাঁড়িগোফ প্রায়ই দেখা যায়। পুরূষদের তুলনায় মেয়েরা বেশ সুঠাম দেহের অধিকারী। গারোদের মত খাসিয়াদেরও মাতৃতান্ত্রিক সমাজ। পরিবার পোষণে মেয়েরাই কঠোর পরিশ্রম করে। পুরূষরা পরিবারের কোন সম্পত্তির অধিকারী হয় না। গারো সমাজ ব্যবস্থার মত খাসিয়া পরিবারের কনিষ্ঠ কন্যা সব সম্পদের অধিকারী হয়। খাসিয়াদের মাতৃভাষা খাসিয়া। তবে কেউ কেউ ইংরেজী বা বাংলায় কথা বলতে পারে। খাসিয়া মেয়েরা দুই খণ্যে কাপড় পরিধান করে। এক খন্ড উর্ধ্বাঙ্গে আর এক খন্ড নাভীর নিচে। শিশুদের পিঠে বেঁধে সাধারণত চলাফেরা করে। তারা অলংকার পছন্দ করে। খাসিয়া মেয়েরা বাজার হাটে কেনাবেচা করে ও অসময়ে ভ্রমণ পছন্দ করে। খাসিয়াদের নিজস্ব সংস্কৃতি রয়েছে। নৃত্যগীত এদের খুবই প্রিয়। নানা ধরণের নাচ গানে সবাই একত্রিত হয়। বিশেষত: বড়দিনে আনন্দ উৎসব করে।খাসিয়াদের বড় অংশ সিলেটের উত্তরে মেঘালয়ের শিলং বসবাস করে। মেঘালয় এবং সিলেট, যেখানে কোন নামের শেষে পুঞ্জি কথাটি যুক্ত আছে, বুঝে নিতে হয় সেটি খাসিয়াদের সংরক্ষিত টিলাগ্রাম। বৃহত্তর সিলেটে ৭২টি পুঞ্জি আছে। প্রতিটি পুঞ্জিতে গড়ে ৪০টি পরিবার বাস করে। খাসিয়া আদিবাসীরা ৬টি গোত্রে বিভক্ত। গোত্র গুলো হলো- লেংদু, সিংতে, লিংগাম, পনার, ভুই ও বার। ৬টি গোত্রের মানুষ একই পুঞ্জিতে মন্ত্রীর অধীনে বাস করে। খাসিয়াদের নিজ গোত্রে বিয়ে নিষিদ্ধ। অন্য গোত্রের সাথে বিয়ে দিতে হয়। ছেলে-মেয়েরা বড় হলে নিজেরাই স্বাধীনভাবে কিংবা পারিবারিক পছন্দে মন্ত্রীর অনুমোদনে এক পুঞ্জির মেয়ের সাথে অন্য পুঞ্জির ছেলের বিয়ে হয়ে থাকে।জানা যায়, আদিকাল থেকে পানের জুম চাষ করে খাসিয়ারা জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। পুঞ্জির আশেপাশে সুপারি গাছ এবং সুপারি গাছের মত একদাঁড়া বন্য গাছের নীচে পান জন্মায়। কোন পুঞ্জিতে বিনিয়োগেরও প্রয়োজন হয় না। তবে পরিচর্যা করতে হয় এবং বেশি পান পাওয়ার জন্য নতুন ‘পুকি’ লাগাতে হয়। পান সংগ্রহ ও বাঁচাই করে রাখলে প্রতিদিন বিকেলে এসে বিভিন্ন এলাকার পাইকাররা খাসিয়াদের কাছ থেকে পান ক্রয় করে নিয়ে যায়। খাসিয়াদের উৎপাদিত পান ইউরোপ, আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্য ও পাকিস্থানে যত পান রফতানী হয়, তার শতকরা ৮০ ভাগ খাসিয়া পান। প্রতিটি খাসিয়া পরিবার পানের জুম চাষের উপর নির্ভরশীল। খাসিয়াদের অবস্থার পরিবর্তন ঘটায় ছেলে- মেয়েরা এখন মিশনারী স্কুলে লেখাপড়া শিখছে। পাহাড় টিলার পুঞ্জি ছেড়ে খাসিয়ারা সমতল ভূমিতে নেমে এসে বাস করতে মোটেই ইচ্ছুক হয় না।পাহাড় টিলার পুঞ্জিতে বসবাসকারী খাসিয়ারা বেশ সুস্থ সবল। বৃদ্ধ বয়সে তারা সমতল থেকে উপরের টিলায় উঠানামা করতে পারে। তাদের শরীরে রোগ বালাই দেখা যায় না। শিশুরা জাপানী পুতুলের মত ফুটফুটে। খাসিয়াদের কোন রোগ হলে নিজেদের চিকিৎসা নিজেরাই করে এবং তারা বিশেষ করে যাদু মন্ত্রে বিশ্বাসী।মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার মাগুরছড়া ও ডবলছড়া এলাকায় খাসিয়া সম্প্রদায় বসবাস করছে। শুধু কমলগঞ্জ উপজেলায় নয়, জেলার বিভিন্ন উপজেলায় কমবেশী খাসিয়াদের বসবাস রয়েছে। এক সময় খাসিয়ারা টিলায় টিলায় ছন-বাঁশের ছাউনিল মাটির কাঁচাঘরের বাস করত। সেকাল এখন খাসিয়াদের বিস্ময় স্মৃতি। খাসিয়ারা আদি ধর্ম ছেড়ে খৃষ্টান ধর্ম গ্রহণের পর (পান) জুম চাষে প্রায় সবাই এখন স্বাবলম্বী, স্বনির্ভর।সরেজমিনে দেখা যায়,খাসিয়ারা জেনারেটরের বিদ্যুৎ ব্যবহার করে ঘরকে আলোকিত করছে, ফ্রিজ, টিভি চালাচ্ছে। হাঁটি হাঁটি পা পা করে দূর্গম পথ পাড়ি দিয়ে কিভাবে তারা ইট, বালু, সিমেন্ট, চুন লোহার রড ও টিন টিলার উপরে তুলে এনে আধুনিক সৌন্দর্য্য উপযোগী পাকা ও সেমিপাকা বাড়ী তৈরি করেছে। যা একবার দেখলে ভাবিয়ে তুলে।