সিলেট পোস্ট রিপোর্ট : বগুড়ার শেরপুরের ঐতিহ্যবাহী কেল্লাপোশী মেলা রোববার থেকে শুরু হচ্ছে। তিথি অনুযায়ী প্রতি বছর জ্যৈষ্ঠের দ্বিতীয় রোববার থেকে উপজেলা সদরের অদূরে কেল্লাপোশী নামক স্থানে ৪৫৯ বছরের প্রাচীন ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে এ মেলার আয়োজন করা হয়। প্রতি বছরের মতো এবারো এই মেলার সার্বিক প্রস্তুতি ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। স্থানীয়দের ভাষায়, যাকে ‘জামাইবরণ’ মেলাও বলা হয়ে থাকে। আর মেলাটিকে ঘিরে গ্রামে গ্রামে চলে রকমারি আয়োজন। মেলার অন্তত সপ্তাহখানেক আগ থেকেই গ্রামের লোকজন নানা ধরনের প্রস্তুতি নিতে থাকেন। নতুন-পুরনো বলে কথা নেই। মেলা উপলক্ষে সবাই নিজ নিজ আত্মীয়স্বজনকে দাওয়াত করে বাড়িতে আনেন। বিশেষ করে নতুন জামাই-বউকে নিয়ে সবাই ভিন্ন আনন্দে মেতে ওঠেন। শ্বশুরবাড়ির পক্ষ থেকে জামাই বাবুকে মোটা অঙ্কের সেলামিও দেয়া হয়। সেই সেলামি আর নিজের গচ্ছিত টাকা দিয়ে জামাই বাবুরা মেলা থেকে খাসি কিনে শ্বশুর বাড়িতে আনেন। এমনকি বড় বড় মাটির পাতিল ভর্তি করে মিষ্টান্ন সামগ্রী, সবচেয়ে বড় মাছ, মহিষের মাংস, রকমারি খেলনা কেনেন। এছাড়া শ্যালক-শ্যালিকাদের নিয়ে মেলা ঘুরেফিরে দেখেন। তাদের সার্কাস, নাগরদোলা, হুন্ডা, জাদু, পতুল নাচ খেলা দেখিয়ে দিনব্যাপী আনন্দ শেষে ছাতা, ছোটদের কাঠের ও ঝিনুকের তৈরি খেলনা সামগ্রী নিয়ে সন্ধ্যায় বাড়িতে ফেরেন। আর গ্রাম্য মানুষরা সেই মেলা থেকে রকমারি মসলা, তুলা, কাঠের সামগ্রী, বড় বড় ঝুড়ি, চুন সারা বছরের জন্য কিনে রাখেন। এদিকে প্রতিটি মেলার পেছনেই কিছু না কিছু লোকগাথা কথা থাকে। কেল্লাপোশী মেলা সম্পর্কে তেমনি একটি লোকগাথার কথা জানা যায়। ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে এ মেলা হয়ে আসছে বলে কথিত আছে। এ সম্পর্কে জানা যায়, বৈরাগ নগরের বাদশা সেকেন্দারের একজন ঔরসজাত এবং একজন দত্তক পুত্র ছিলেন। ঔরসজাত পুত্রের নাম ছিল গাজী মিয়া আর দত্তক পুত্রের নাম কালু মিয়া। গাজী মিয়া দেখতে খুবই সুদর্শন ছিলেন। তারা রাজ্যের মায়া ত্যাগ করে ফকির সন্ন্যাসীর বেশ ধারণ করে ঘুরতে ঘুরতে ব্রাহ্মণ নগরে আসেন। সেখানে ব্রাহ্মণ রাজমুকুটের একমাত্র কন্যা চম্পা গাজীকে দেখে মুগ্ধ হন। এক পর্যায়ে তারা দুজন দুজনকে ভালোবেসে ফেলেন। পালিত ভাই কালু মিয়া বিষয়টি জানতে পেরে গাজীর বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে মুকুট রাজার কাছে যান। মুকুট রাজা ফকিরবেশী যুবকের এরূপ স্পর্ধা দেখে ক্ষিপ্ত হয়ে তাকে বন্দি করেন। এতে গাজী মিয়া দারুণ আঘাত পান। তিনি মুকুট রাজার কাছ থেকে ভাই কালু মিয়াকে উদ্ধারের জন্য কেল্লাপোশী নামক একটি দুর্গ নির্মাণ করেন। পরে রাজার সঙ্গে যুদ্ধ করে ভাইকে উদ্ধার এবং তার কন্যাকে বিয়ে করেন। আর তিথি অনুযায়ী ওই দিনটি ছিল জ্যৈষ্ঠের দ্বিতীয় রোববার। ওই সময় গাজীর বিয়ে উপলক্ষে কেল্লাপোশী দুর্গে নিশান উড়িয়ে তিন দিনব্যাপী আনন্দ উৎসব চলে এবং সেখানে মাজার গড়ে তোলা হয়। মেলা চলাকালে সেখানে ভক্তরা আসর বসায়। ওই দিনগুলোকে অ¤øান করে রাখতে প্রতি বছর জ্যৈষ্ঠের দ্বিতীয় রোববার থেকে তিন দিনব্যাপী মেলা বসে। আর এই মেলা উপলক্ষে এলাকাবাসী নতুন জামাইকে ঘরে এনে আনন্দ উৎসবে মেতে ওঠেন। এ ছাড়া নিকটাত্মীয়স্বজনের পদচারণায় মুখরিত হয়ে ওঠে মেলা প্রাঙ্গণ।
অপরদিকে মেলা শুরুর প্রায় সপ্তাহখানেক আগ থেকে গ্রামে গ্রামে চলে মাদার খেলা। একটি বড় বাঁশকে লাল কাপড়ে মুড়িয়ে ও নানা রঙে সাজিয়ে সেটির বিভিন্ন স্থানে চুল লাগিয়ে ১৫-২০ জনের একটি দল বেরিয়ে পড়ে। ঢাকঢোল, গান-বাজনার নানান সরঞ্জামাদি আর লাঠি নিয়ে তারা গ্রামগঞ্জ থেকে শুরু করে শহরে খেলা দেখায়। মেলা শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত চলে ওই মাদার খেলা।
জ্যৈষ্ঠের দ্বিতীয় রোববার দলটি মেলা এলাকায় অবস্থিত মাজার প্রাঙ্গণে গিয়ে তা শেষ করে। এ বছরও মেলাকে কেন্দ্র করে বিভিন্নস্থানে মাদার খেলা চলে। আর ঐতিহ্যবাহী এই মেলাকে সামনে রেখে এলাকায় সাজ সাজ রব পড়ে যায়। উপজেলা সদর থেকে প্রায় ৩ কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত কেল্লাপোশী নামক স্থানে ৩ দিনব্যাপী এ মেলায় যাত্রা, সার্কাস, নাগোরদোলা, পুতুল নাচ, বিচিত্রা, হুন্ডাখেলা, কারখেলাসহ নানা অনুষ্ঠান চলে। সেই সঙ্গে জুয়াড়িরা পাল্লা দিয়ে মেলা দেখতে আসা সহজ-সরল মানুষকে ঠকিয়ে হাজার হাজার টাকা হাতিয়ে নেয়। মেলায় সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত চলে কেনাকাটার ধুম। দূর-দূরান্ত থেকে আগত বিক্রেতারা এখানে দোকান সাজিয়ে জাঁকিয়ে বসেন। এ মেলার প্রধান আকর্ষণ হলো বিভিন্ন ধরনের কাঠের আসবাবপত্র, মিষ্টি-ফলমূল, নানা জাতের বড় বড় মাছ, কুটির শিল্প সামগ্রী, মহিষ ও খাসির মাংস, রকমারি মসলা। তিনদিন মেলা চলার নিয়ম থাকলেও তা শেষ পর্যন্ত ছয়-সাত দিনে গড়ায়। এ মেলায় কোটি টাকার দ্রব্যাদি কেনাবেচা হয়। আর মেলাকে কেন্দ্র করে ইজারার নামে অবৈধভাবে লাখ লাখ টাকা চাঁদা আদায় করা হয়। প্রতি বছর এই চাঁদা আদায়কে কেন্দ্র করে সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটে থাকে। এদিকে প্রশাসন মেলার শৃঙ্খলা রক্ষায় বিশেষ পুলিশি টহলের ব্যবস্থা করে থাকে। কিন্তু লাখো মানুষের ভিড়ে তাদের কার্যক্রম দায়সারা হয়ে পড়ে। ফলে চুরি, ছিনতাই ও চাঁদাবাজি রোধ করা যায় না। যে মেলা সাড়ে ৪৫৯ বছরের বাঙালি ঐতিহ্য ধরে রেখেছে, সেখানে মানুষ প্রশাসনের সুদৃষ্টি কামনা করেছেন।
এ প্রসঙ্গে জানতে শেরপুর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আলী আহমদ হাশমী এ প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের জানান, ঐতিহ্যবাহী এই মেলাটি করতে প্রশাসনিকভাবে অনুমতি দেয়া হয়েছে। একইসঙ্গে মেলায় সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে পুলিশের পক্ষ থেকে সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে বলেও ওই পুলিশ কর্মকর্তা দাবি করেন।