ফয়ছল আহমদ, সিলেটপোস্ট২৪ডটকম :
বিজয়ের প্রান্তে বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রাম। বাংলার দামাল গেরিলাদের একটি গ্রুপ মেজর আমিনুল হকের নেতৃত্বে ভারতের কৈলাশহর হয়ে বাংলাদেশের মৌলভীবাজার এলাকায় ঢুকে। এই গেরিলা দলে ইপিআর সদস্য সিপাহী মোহাম্মদ ইমাদ উদ্দিন।
তিনি জানান, ‘দিন তারিখ ঠিক মনে করতে পারছি না। তবে আমরা তখন যুদ্ধ জয়ে দ্বারপ্রান্তে। ভঅরত যুদ্ধ ঘোষণা করার খবর পেয়েই কৈলাশহর হয়ে ঢুকার পথে পাকিস্থানী ৫ সেনা ও ২ রাজাকারকে বন্দি করে মেজর আমিনুল হকের কাছে হাত-পা বেঁধে হস্তান্তর করি। রাত ১১টার দিকে মৌলভীবাজারের ভানুগাছ বাজার পাকিস্থানীদের সাথে সম্মুখ যুদ্ধ শুরু হয়। টানা ৫/৬ দিন বন্দুকযুদ্ধকালে খবর আসে পাকিস্থান থেকে ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা করা হয়েছে। এদিকে ভানুগাছ যুদ্ধে বিজয় নিশ্চিত জেনে ইপিআর সদস্য সৈনিক জিল্লুর রহমান কমলগঞ্জ থানায় ‘জয়বাংলা’ শ্লোগান দিয়ে পাকিস্থানী পতাকা নামিয়ে বাংলার লাল সবুজ পতাকা উড়াতে যান।
জিল্লুর রহমানের থেকে প্রায় ১শ গজ পিছনে অবস্থানে ছিলেন মেজর আমিনুল হক, সিপাহী মোহাম্মদ ইমাদ উদ্দিনসহ অন্যরা। পাকিস্থানী পতাকা নামাতে গিয়ে বুকে গুলিবিদ্ধ হয়ে লুটিয়ে পড়েন জিল্লুর। সহযোদ্ধা গুলিবিদ্ধ হওয়ায় ইমাদ উদ্দিনসহ অন্যরা এগিয়ে যান। আহত জিল্লুরকে কোলে তুলে অবস্থান নেন শত্রু মোকাবেলায়। সৈনিক জিল্লুরের পবিত্র রক্তে সারা শরীর একাকার হয়ে যায় ইমাদ উদ্দিনের। বেদনায় কাতরাতে থাকা সৈনিক জিল্লূর স্বপ্নের স্বাধীন দেশের কথা বলতে বলতেই শহীদ হন। রক্তমাখা সহযোদ্ধাদের প্রেরণা যোগান মেজর আমিনুল হক। তিনি জিল্লুর রহমানের রক্তকে শক্তিতে পরিণত করে যুদ্ধে এগিয়ে যেতে বলেন। শহীদ জিল্লুর রহমানকে ভানুগাছ বাজারের পশ্চিমে সমাহিত করে যুদ্ধে এগিয়ে যাই।’
সিপাহী মোহাম্মদ ইমাদ উদ্দিন। সিলেট জেলার দক্ষিণ সুরমা উপজেলার মোগলাবাজারের গোপালগাঁও গ্রামের বাসিন্দা। ১৯৬৯ সালে ইপিআরে যোগদান করে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। টানা ৯ মাস যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীনের পর বিডিআরে কর্মরত ছিলেন। ১৭৯৫ সালে বিডিআর থেকে অবসর গ্রহণ করেন। তার ভারতীয় নং-২২০১৮, মুক্তিবার্তা-০৫০১০১০৫০০৬৬, গেজেট-৫০৩৭ রেজিমেন্ট।
তিনি জানান, ইপিআরে যোগদান করে ঢাকায় প্রশিক্ষণ নিয়ে চট্ট্রগাম সেক্টরে ১৪ উইং সি কোম্পানী ৪নং ক্যাম্পেইনে চাকুরীরত ছিলাম। ১৯৭১ সালে যুদ্ধ শুরু হলে চট্টগ্রাম হেডকোয়ার্টার ক্যাপ্টেন রফিকের মাধ্যমে আমাদের কাছে বার্তা আসল, তোমরা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হও। দেশের পরিস্থিতি খারাপ। বার্তা পাওয়ার সাথে সাথে ৩০/৩৫ জনের দল যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হলাম। আমাদের সাথে ৫ জন পাকিস্থানী ইপিআরে চাকুরীরত ছিল। তারা হলেন, হাবিলদার সরোয়ার হোসেন, হাবিলদার বশির বাট, হাবিলদার সরওয়াব, ল্যান্সনায়েক বাহাদুর, ল্যান্সনায়েক শাহ মোহাম্মদ।
আমরা ৫ পাঞ্জাবীসহ সকলে চট্টগাম সেক্টরে ১৪ উইং সি কোম্পানী ৪নং ক্যাম্প থেকে সুবেদার মফিজুল বারীর নেতৃত্বে রামগড় যাই। ট্রাকে করে রামগড় থেকে হেডকোয়ার্টারে আসি। এক সময় নানা বাধা উপেক্ষা করে নদী পাড়ি দিয়ে ভারতে হরিনা টিলায় পৌছি। সেখানে আমাদের সবাইকে বিভিন্ন কোম্পানীতে ভাগ করে দেওয়া হয়।
ভারতে থাকাকালীন আমরা গেরিলা যুদ্ধ করতে থাকি। বাংলাদেশে একমাত্র মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প ছিলো চাম্পানগর। মুক্তিযুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে ফেণীর চাম্পানগর ক্যাম্পে আমাদের কিছু লোক পাঠানো হয়। রাত ১২টার দিকে ১৩/১৪ জনের একটি দলের সদস্য হয়ে ক্যাম্পে যাই। পরে আমরা চাম্পানগর ক্যাম্প থেকে গেরিলা যুদ্ধ চট্টগ্রামে শুরু করি। চট্টগ্রামের ডাবলমুরিং রেলের ব্রিজ লেফটেন্যান্ট মাহফুজের নেতৃত্বে ধ্বংস করে দেওয়া হয়। এটাই ছিলো আমার প্রথম সফল অপারেশন। পরে আমরা ভারত ফিরে যাই।
পরে আসামে মেঘালয় তেলডালাতে অবস্থান নিয়ে ট্রেনিং করি। জঙ্গল পরিস্কার করে অস্টম বেঙ্গলের ক্যাম্প করা হয়। আমি অস্টম বেঙ্গল হেড কোয়ার্টার কোম্পানীর কমান্ডো প্লাটুনে প্রশিক্ষণ নিই। কোম্পানী কমান্ডার সুবেদার আবু মোতালেব এবং প্লাটুন কমান্ডার আবু তাহেরের নেতৃত্বে আমি প্রথম, চতুর্থ ও অস্টম বেঙ্গল পাশাপাশি ছিলাম। আনুমানিক ৪ মাস প্রশিক্ষণ শেষে আমরা আবার গেরিলা আক্রমণ শুরু করি। সেখান থেকে আমরা ময়মনসিং নকশি ক্যাম্পে আক্রমনে যাই।
নকশি ক্যাম্পে আক্রমনের আগে ভারত সীমান্তে মেজর জিয়াউর রহমান আমাদের বললেন, তোমাদের কোন ভয় নেই। ভারত থেকে কমপক্ষে ১ হাজার গোলা গিয়ে ক্যাম্পে পড়বে। তোমরা সকালে চার্জিং করে আসবে।
নকশি ক্যাম্পে যুদ্ধে আমাদের ৩৬ সহযোদ্ধা আহত হন। সেখান থেকে ফিরে বর্ডারে মেজর জিয়াউর রহমানসহ ভারতীয় একজন বিগ্রেডিয়ার জেনারেলকে পাই।
পরবর্তীতে আমরা অস্টম বেঙ্গল ত্রিপুরার কৈলাশহরের উত্তরদিকে কদমতলী নামক স্থানে পাহাড়ে অবস্থান নিই। সেখান থেকে আমরা মৌলভীবাজারে কুলাউড়ার সাগরনাল এবং ফুলতলা সাগরনাল ক্যাম্পে আক্রমণ করি। এই যুদ্ধে অনেক মুক্তিযোদ্ধা আহত হন। চা বাগানের মেশিনসহ নকশী ক্যাম্প ধ্বংস করা হয়। গেরিলা হামলা শেষে আমরা ভারতের সীমান্তে অবস্থান করি। এ অপারেশনের সফলতার জন্য সেদিন স্বয়ং জিয়াউর রহমান আমাদেরকে ধন্যবাদ জানান।
এপর ডিসেম্বর মাসের কোন এক সময় কৈলাশশহর হয়ে বাংলাদেশে ঢুকে পড়ি। ভানুগাছ যুদ্ধে শহীদ হন সৈনিক জিল্লুর রহমান। পরে শ্রীমঙ্গল, কুলাউড়ায় অপারেশন শেষে সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জের কটালপুর হয়ে বিভিন্ন অপারেশন শেষে দক্ষিণ সুরমার পারাইরচকে পৌছলে পাকিস্তানীরা বোমা বর্ষণ করে। এতে ২ সৈনিক আহত হন। ধীরে ধীরে মুক্তিযোদ্ধার সিলেট শহর ঘিরে ফেলে।
তখনই আসে মাহেন্দ্রক্ষণ। পাকিস্থানী বাহিনী আত্মসমর্পণ করে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে। ইমাদ উদ্দিনসহ ৮ম বেঙ্গল সিলেট পৃুরাতন রেল স্টেশনে অবস্থান নেয়।
পরে মেজরের নেতৃত্বে ইপিআরের লোক মুভমেন্ট অর্ডারের মাধ্যমে চট্টগ্রাম হেডকোয়ার্টারে ইমাদ উদ্দিনসহ অন্যরা ফিরে যান স্বাধীন বাংলাদেশে।