সংবাদ শিরোনাম
সিলেটে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস পালন  » «   সিলেট জেলা প্রেসক্লাবের দ্বিবার্ষিক সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত  » «   চেম্বারের অবৈধ কমিটি বাতিলে ৪ দিনের আল্টিমেটাম-ব্যবসায়ীদের মানববন্ধনে বক্তারা  » «   নতুন বছরের প্রথম দিনে পাঠ্য বই পাচ্ছেন না সব শিক্ষার্থী  » «   সিলেট ব্যাটালিয়ন (৪৮ বিজিবি) কর্তৃক ৫০ লক্ষ টাকার চোরাচালানী মালামাল আটক  » «   সীমান্তে ১৯ বিজিবি’র অভিযানে প্রায় ৪০ লক্ষ টাকার ভারতীয় চোরাই পণ্য জব্দ  » «   সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সাথে মহানগর বিএনপির মতবিনিময় সভা শুক্রবার  » «   বিচার বিলম্বিত হলে, ন্যায় বিচার ক্ষুন্ন হয়- বিচারপতি খিজির আহমেদ চৌধুরী  » «   শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা অক্ষুন্ন রাখব : কাইয়ুম চৌধুরী  » «   লালদিঘীরপাড়ে মাছ ব্যবসায়ীদের হামলায় এক কিশোর নিহত ১  » «   সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভরপুর উপজেলায় ভূয়া পুলিশসহ দুই যুবক আটক  » «   তারেক রহমানের খালাসের খবরে সিলেটে আনন্দ মিছিল  » «   সিলেটে জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেসি’র উদ্যোগে মাসিক পুলিশ-ম্যাজিস্ট্রেসি কনফারেন্স অনুষ্ঠিত  » «   কুলাউড়ায় মানব পাচারকারীর বাড়িতে বিজিবির অভিযান,আটক-৮  » «   চিনিকাণ্ডে সবচেয়ে বেশি আলোচিত অঞ্চল সিলেট  » «  

বাংলাদেশে কোন সরকারের শাসনামলে ওসমানীর মূল্যায়ন কেমন ছিল

মোঃ আব্দুল মালিক::স্বাধীন বাংলাদেশে জেনারেল ওসমানী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, খন্দকার মোশতাক আহমদ, জেনারেল জিয়াউর রহমান ও জেনারেল এরশাদের শাসনামলের কিছুকাল পেয়েছিলেন। এই চার সরকারের কে তাঁকে কেমন মুল্যায়ন করেছিলেন তা সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো। ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি করে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার গঠন করা হয়। ঐ সরকার কর্ণেল (অব) ওসমানীকে মন্ত্রীর পদমর্যাদায় মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার ইন চীপ নিযুক্ত করেন।

উল্লেখ্য ঐ সময় মেজর জেনারেল এম আই মজিদ নামে আরো একজন অবসর প্রাপ্ত বাঙালি সামরিক কর্মকর্তা ছিলেন। যার সভাপতিত্বে ২২ মার্চ ১৯৭১ বায়তুল মোকাররম চত্বরে প্রাক্তন সৈনিক পরিষদের এক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশ শেষে সৈনিকরা মিছিল সহকারে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে যান। সেখানে মেজর জেনারেল এম আই মজিদ সংগ্রামের প্রতীক হিসেবে একখানা তরবারি বঙ্গবন্ধুকে উপহার দেন। বঙ্গবন্ধু তা গ্রহণ করে তাতে চুমু খেয়ে এম আই মজিদের হাতে আবার তুলে দেন। একজন মেজর জেনারেলকে বাদ দিয়ে একজন কর্ণেলকে এই দায়িত্ব প্রদান এটা কম কথা নয়। অবশ্য এম আই মজিদ মেজর জেনারেল হলেও নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ছিলেন না। তবে লে.কর্ণেল (অব) এম এ রব যিনি নির্বাচিত জাতীয় পরিষদ সদস্য ছিলেন, তাঁকেও দায়িত্ব দেয়া যেত। দেশ স্বাধীনের পর বঙ্গবন্ধু সরকার (অব.) ওসমানীকে এক সাথে ৪টি পদোন্নতি দিয়ে চার তারকা জেনারেল করেন। উল্লেখ্য সে সময় একজন জেনারেলের অধীনে যে পরিমাণ সৈনিক থাকার কথা সে পরিমাণ সৈনিক বাংলাদেশের ছিল না। জেনারেল ওসমানী সামরিক বাহিনীর সর্বাধিনায়কের পদ ছেড়ে সংসদ সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালনের আগ্রহ দেখালে বঙ্গবন্ধু শেষ মুজিবুর রহমান তাঁকে কেবিনেট মন্ত্রী পদে নিয়োগ দেন। স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু তাঁকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন দেন এবং তিনি বিজয়ী হন। আবারও বঙ্গবন্ধু সরকার তাঁকে আরো বেশি দায়িত্ব দিয়ে কেবিনেট মন্ত্রী নিযুক্ত করেন এবং তিনি পদত্যাগ না করা পর্যন্ত এই পদে বহাল  ছিলেন। উল্লেখ্য ১৯৭০ সালের নির্বাচনেও বঙ্গবন্ধু তাঁকে মনোনয়ন দিয়েছিলেন।

১৫ আগস্টের পট পরিবর্তনের পর আসে খন্দকার মোশতাক আহমদের সরকার। এই সরকারে জেনারেল ওসমানী রাষ্ট্রপতির অবৈতনিক প্রতিরক্ষা উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করেন। ২৫ আগষ্ট ১৯৭৫ খ্রি. থেকে ৫ই নভেম্বর ১৯৭৫ খ্রি.মাত্র দুই মাসের এই উপদেষ্টা পদ থেকে তিনি যে সম্মান অর্জন করেছিলেন তার চেয়ে অনেক বেশি দূর্নাম কুড়িয়েছেন বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করেন। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের শাসনামলে জেনারেল ওসমানী রাষ্ট্র বা সরকার থেকে তেমন সম্মান বা মূল্যায়ন পাননি। বরং চরম অবহেলা ও অসম্মান পেয়েছিলেন।

বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের এডভোকেট বিজন কুমার দাস যিনি পরবর্তীতে হাই কোর্টের বিচারপতি নিযুক্ত হয়েছিলেন। তিনি লেখেন, ১৯৮২ সালের জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহের এক সন্ধ্যায় ওসমানী সাহেবের সান্নিধ্যে আসার আমার সৌভাগ্য হয়েছিল। শান্ত, ধীর, স্থির, বিচক্ষণ আর আত্মপ্রতয়ী জেনারেল ওসমানী জানালেন, ক্ষমতার শীর্ষে আর কেন্দ্রবিন্দুতে যারা ছিলেন এবং আছেন তাঁদের প্রত্যাশায় শরীক হলেই ন্যায্য অবসর ভাতা পেয়ে যাবেন। এমন আশ্বাস প্রায়ই তাঁকে দেওয়া হচ্ছে। পেনশন সম্পর্কীয় একাউনট্যান্ড জেনারেল (সামরিক) অফিসের সূত্র নং পিজি- (ও/এ/১৭১/৭৫ তারিখ ০১-০৬-১৯৭৬ থেকে ০৪-০৬-১৯৭৬ ইংরেজি তারিখের প্রি অডিট রির্পোটের প্রেক্ষিতে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি এ. এস. এম সায়েম ওসমানীকে জেনারেল এবং সশস্ত্রবাহিনীর সর্বাধিনায়ক হিসেবে উভয় পদেই নিযুক্ত করেন। তিনি স্বাভাবিক ভাবে তিন বছর অফিস অলংকৃত করেছেন গণ্যে ওসমানীকে পূর্ণ পেনশনদানের মঞ্জুরী প্রদান করেন। কিন্তু তাঁকে জেনারেল হিসেবে পেনশন না দিয়ে কর্ণেল হিসেবে পেনশন  দেওয়া হচ্ছিল।……..

“ওসমানী সাহেব পাকিস্তান আমলে গৃহ নির্মাণ ঋণদান সংস্থা থেকে ঋণ নিয়ে সিলেট শহরের নাইওরপুলে বাড়ি নির্মাণ করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানীরা তাঁর বাড়িটি ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছিল। ১৯৭২ সালের ২৪ অক্টোবর অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ সরকারের কেবিনেট মিটিং নম্বর সি এম ২৭/৭২ এ সিদ্ধান্ত হয় যে, যারা স্বাধীনতা পূর্বকালে গৃহ নির্মাণ ঋণদান সংস্থা থেকে ঋণ নিয়েছিলেন এবং পরবর্তীকালে স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সময়ে ক্ষতিগ্রস্থ  হয়েছেন তাদের তৎকালীন গৃহীত ঋণ মওকুফ করা হবে অথবা অন্য কোন উপায়ে প্রতিকার দেওয়া হবে। জেনারেল ওসমানী সাহেব ঋণ মওকুফ এর আবেদন করেছিলেন। বেদনাদায়ক হলেও সত্যিকার অবস্থা হচ্ছে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ১৯৭৬ সালে সেই আবেদন নাকচ করেছিলেন, এই কারণে যে, জেনারেল ওসমানী সাহেবের ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার বিষয়টি গৃহীত নীতিমালার আওতায় পড়ে না। বঙ্গভবন থেকে রাষ্ট্রপতির সচিবালয়ের সচিব ১৪ই ডিসেম্বর তারিখে লিখিত স্মারক নং ১/২৮৫/৭৬ জেনারেল/৩৫০৮ মোতাবেক এই সংবাদ জানিয়ে উল্লেখ করা হয় যে, এই ঋণ মওকুফের বিষয়টি অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গেও পরামর্শ ও পূণঃপরীক্ষা করা হয় এবং গৃহীত নীতিমালার আওতায় পড়ে না। প্রকাশ থাকা আবশ্যক যে, ঐ সময় মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান সামরিক আইন প্রশাসক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন। “মোহাম্মদ আনওয়ার খান সম্পাদিত, চিরঞ্জীব ওসমানী,পৃষ্টা-৯৮, ১০২, ১০৮, ১০৯। জেনারেল ওসমানীন পেনশন বিষয়ে লেফটেনেন্ট কর্নেল এম এ হামিদ (অব.) লিখেছেন, “জিয়াউর রহমানের সাথে তার বনিবনা ছিল না। অতএব জেনারেল হিসেবে পেনশনের টাকা দাবি করেছিলেন, কিন্তু জিয়া সেটা দেননি। ওসমানী সাহেব আমার কাছে কথাটা পাড়লে একবার আমি জিয়ার কাছে কথাটা তুলেছিলাম। জিয়ার কথা ছিল ওসমানী আমার কাছে আবেদন করুন, তবেই দেব। ওসমানী সাহেবকে একথা বলতে তিনি রেগে গেলেন, আমি রুটিন ব্যাপারের জন্য ঐ ব্যাটাকে মোটেই আবেদন করব না।” মোহাম্মদ আনওয়ার খান সম্পাদিত চিরঞ্জীব ওসমানী, পৃষ্টা-৪১। এই ছিল জেনারেল জিয়ার শাসনামলে জেনারেল ওসমানীর মূল্যায়ন।

হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের শাসনামলে জেনারেল ওসমানীর সুদিন ফিরে আসে। এরশাদ সরকার জেনারেল ওসমানীর পেনশন মঞ্জুর করেন, গৃহ নির্মাণ ঋণ মওকুফ করেন। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদর দপ্তরের ১৯৮৩ সালের ৩০শে জানুয়ারি তারিখের স্মারক নং-৩৮৩০/১/ পিপি এন্ড এ-২ পত্র মোতাবেক, জেনারেল (অব.) এম এ জি ওসমানীকে কমান্ডার ইন চীপ হিসেবে জেনারেল পদ হতে অবসর গ্রহণের পুরো মঞ্জুরী প্রদান করা হয়েছে এবং ঐ মঞ্জুরী ১৯৭২ সালের ৭ ই এপ্রিল তারিখ থেকে কার্যকরী বলে গণ্য হয়েছে। সেই সঙ্গে তৎকালীন সামরিক আইন প্রশাসকের বর্তমানে মহামান্য রাষ্ট্রপতি মঞ্জুরী অনুমোদন সংক্রান্ত আদেশ নামারও উল্লেখ আছে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রতিরক্ষা বিভাগ সুত্র নং বিবিধ-১/৮৩/ ডি-৯৯ /১৭৫ তারিখ ২/৬/১৯৮৩ জেনারেল (অব) এম এ জি ওসমানী বরাবরে যে পত্র আসে তার অংশবিশেষ নিম্নরূপ-‘গৃহ নির্মাণ ঋনদান সংস্থার নিকট হইতে ঋণ গ্রহণ করিয়া জেনারেল ওসমানী স্বীয় জেলা সদর সিলেট যে বাসাবাড়ি নির্মাণ করিয়াছিলেন, স্বাধীনতা সংগ্রাম চলাকালে দখলদার বাহিনী কর্তৃক ইহা বিধ্বস্থ হইয়াছে। ফলে উক্ত বাসাবাড়ি হইতে তিনি আর্থিক কোন সুযোগ সুবিধা পাইতেছেন না এবং কালক্রমে আর্থিক অভাব অনটন বৃদ্ধির ফলে উক্ত টাকা পরিশোধ করিতে স্বীয় অক্ষমতার কথা প্রকাশ করিয়াছেন ।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে জেনারেল এম এ জি ওসমানীর ভূমিকা অনন্য সাধারণ, অবদান সর্বজনবিদিত। ইহার প্রতিদানে তাঁকে কোন সুযোগ সুবিধা দেওয়া সম্ভব না হইলেও এই বৃদ্ধ বয়সে তিনি আর্থিক অভাব অনটনের মধ্যে দুর্বিসহ জীবন যাপন করিবেন- তাহা আমাদের কাম্য নহে। তাই গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার জেনারেল এম এ জি ওসমানীর কাছে গৃহ নির্মাণ ঋণদান কর্পোরেশনের প্রাপ্য উক্ত অপরিশোধিত ঋণ মওকুফ করিতে সম্মত হইয়াছেন। ইহাতে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের অনুমোদন রহিয়াছে। এমতাবস্থায় উক্ত অনুমোদনের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণের জন্য অর্থ বিভাগকে অনুরোধ করা যাইতেছে। বিষয়টি অত্যন্ত জরুরী। মোহাম্মদ আনওয়ার খান সম্পাদিত, চিরঞ্জীব ওসমানী, পৃষ্টা -১১০।

জেনারেল ওসমানীর মৃত্যুর পর রাষ্ট্রপতি হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদ ওসমানীর সিলেটের বাড়ি নুরমঞ্জিলে ওসমানী যাদুঘর প্রতিষ্ঠা করেন। সিলেট আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর ও সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজের নাম পরিবর্তন করে ওসমানীর নামে নামকরণ করেন। ঢাকায়ও একটি অডিটোরিয়ামের নাম ওসমানীর নামে নামকরন করেন। শেখ হসিনার সরকার তাঁর নামে ওসমানী নগর উপজেলা প্রতিষ্ঠা করেন।

উপরোক্ত আলোচনা থেকে দেখা যায়। জেনারেল ওসমানী সবচেয়ে বেশি মূল্যায়িত হয়েছেন বঙ্গবন্ধু সরকারের সময় এবং সবচেয়ে বেশি অবমূল্যায়িত হয়েছেন নিজের হাতে গড়া বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রোডাক্ট পুত্রসম জিয়াউর রহমান সরকারের সময়। অথচ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের হত্যাকান্ডের পর তিনি যে ভূমিকা নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর নারকীয় হত্যাকান্ডের পর তাঁর সে রকম ভূমিকা জাতি দেখেনি। এ এক রহস্যাবৃত অধ্যায়।

 

সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়াার করুন

সর্বশেষ সংবাদ

Developed by:

.