সিলেটপোস্ট ডেস্ক::আমীনূর রশীদ চৌধূরী ব্যক্তিপ্রজ্ঞায় আলোকিত এক অনন্য মানুষ। তঁার আলোকপ্রভায় আলোকিত হয়েছে সময়। ব্যক্তির উৎকর্ষতা নয় সামগ্রিকতায় বিশ্বাস করতেন তিনি। অতীত আর বর্তমানের সংযোগ স্থাপনেও তিনি ছিলেন বদ্ধপরিকর। খন্ডাংশ বা চুর্ণাংশ নয় প্রকৃত সত্য ও তথ্যের পূজারী ছিলেন তিনি। সত্যকে ধারণ করেই অব্যাহত ছিলো তঁার জীবনের গতিপথ। জেল, জুলুম আর রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করা ছিলো তাঁর সহজাত প্রবৃত্তি। ‘সত্য যে কঠিন সে কখনো করেনা বঞ্চনা’- কবির এই অমোঘ বাণীকে মর্মমূলে লালন করেছিলেন গভীর প্রত্যয় আর বিশ্বাসে। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত সেই বিশ্বাস ও আদর্শ থেকে এতটুকু বিচ্যুৎ হননি। কর্মের প্রতি ছিলেন শতভাগ নিষ্ঠাবান। সে কারণে তাঁর নামের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল কর্মবীর শব্দটি। সিলেটের ন্যায্য দাবি দাওয়া আদায়ের ক্ষেত্রে আপোষহীন থাকায়-সিলেটবন্ধু অভিধাটিও চিরদিনের জন্য নিজের করে নিয়েছেন আমীনূর রশীদ চৌধূরী। যুদ্ধ কিংবা বিপবে, ত্যাগে কিংবা সংগ্রামে, নীতিনিষ্ঠায় সমকালে তঁার মতো মুক্তিপথের অভিযাত্রী আর একজনও নেই কথাটি বললে অত্যুক্তি হবে না মোটেই। তিনি দুহাত ভরে শুধু দিয়েই গেছেন, বিনিময়ের প্রত্যাশা করেননি কখনও।
তঁার জন্মের শতবর্ষ পরও তাই তিনি প্রাসঙ্গিক। তঁার আদর্শ, চেতনা আমাদের চলার পথের পাথেয়। অথচ সমাজ ও রাষ্ট্র সেভাবে মূল্যায়ন করেনি এই সূর্য সন্তানকে। এতে আমীনূর রশীদ চৌধূরীর কিছু যাবেও না আসবেও না। কারণ আজ এসবের অনেক উর্ধ্বে তঁার অবস্থান। কিন্তু একজন আমীনূর রশীদ চৌধূরীকে যদি মূল্যায়ন করা হয়, তাহলে আগামীতে তঁার আদর্শের আলোকবর্তিকা হাতে নিয়ে অগ্রগামী হবে কেউ না কেউ। কারণ গুণের কদর না করলে গুণীর জন্ম হয় না সমাজে।
‘দূর করো ভাই দূর করো
বেইমান সবকো দূর করো…’
আমীনূর রশীদ চৌধূরীর অসমাপ্ত আত্মজীবনী সত্য ও তথ্যের প্রারম্ভিক বক্তব্য এটি। আমিনূর রশীদ চৌধূরী তাঁর বেড়ে উঠা কালের কথা বর্ননা করতে গিয়ে ইংরেজ বিরোধী এই শ্লোগান তুলে ধরেন আমাদের সামনে। তখন সহজেই অনুমান করতে পারি তাঁর জন্মের সময়টা। সহিংস অহিংস উভয় পন্থার আন্দোলনের কারনে দীর্ঘ শাসনের শেষপ্রান্থে তখন দাঁড়িয়ে ব্রিটিশরা। মাহাত্মা গান্ধি এবং নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর সংগ্রামে তখন ব্রিটিশদের নাভিশ্বাস ওঠার অবস্থা। সেই সময়টাতই আমিনূর রশীদ চৌধূরীর বেড়ে ওঠা। বাঙালির সন্তান হলেও পরিস্থিতিগত কারণে ভূমিষ্ট হওয়ার পর পরই ইংরেজ দম্পত্তির হাতে তুলে দেওয়া হয় তাকে। তাদেও আপত্য স্নেহে লালিত হয়েছেন তিনি। স্বভাবতই ইংরেজি ভাষা হয়ে উঠে তাঁর মুখের ভাষা। অথচ রক্তের উত্তরাধিকার তাঁকে ব্রিটিশ বিতারণে শুধু উদ্বুদ্ধই করেনি ইংরেজ বিরোধী সহিংস এবং অহিংস উভয় পন্থার আন্দোলনে ওতোপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়তে করেছে সংকল্পবদ্ধ।
ব্রিটিশের সাম্রাজ্য পতনের ঠিক ৩২ বছর পূর্বে অবিভক্ত ভারতর্ষে জন্মগ্রহন করেন আমিনূর রশীদ চৌধূরী। কলকাতার ৩৮ নম্বর জাননগর রোডে ১৯১৫ সালের ১৭ নভেম্বর ভূমিষ্ট হন তিনি। তাঁর জন্মের আগের বছর অর্থাৎ ১৯১৪ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে দেশে ফিরেন মাহাত্মা গান্ধি। সে সময়টায় সারা ভারত ভ্রমন করে তিনি মানুষের দুঃখ-দুর্দশার চিত্র অবলোকন করতে থাকেন। যুদ্ধের বিকল্প হিসেবে সত্যাগ্রহ প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে অবতীর্ন হওয়ার সংকল্পে তিনি তখন বদ্ধপরিকর। ১৯২০ সালে ব্রিটিশ বিতারণের আন্দোলন শুর“র পটভূমি তৈরি হয় তার জন্মের সময়টায়। তিনি যখন দুই বছরের শিশু সেই সময়টায় ঘটে র“শ বিপব। আমীনূর রশীদের জন্মের আগের বছর বেজে উঠে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা।
বিপব, যুদ্ধ আর আন্দোলনের ডামাডোলের মধ্যেই আমিনূর রশীদের আগমন ঘটে পৃথিবীতে। যুদ্ধাবহে জন্ম নেওয়া শিশুটির মানষপটেও তাই প্রোথিত হয়ে যায় সংগ্রামমুখরতা। বাঙালি এই শিশুর বিকাশপর্ব মূলত সমৃদ্ধ হয়েছে অগ্রসর বেল দম্পত্তির বদৌলতে। কারন কর্মসূত্রে কলকাতায় অবস্থান করা এই ইংরেজ দম্পত্তি সর্বক্ষেত্রেই ছিলেন প্রাগ্রসর। তাদের এই প্রাগ্রসরতাই শিশু আমিনূর রশীদ চৌধূরীর বোধ শক্তিকে করেছে শানিত, কিন্তু অনুগামি করতে পারেনি এতটুকুও। রক্তের যে উত্তরাধিকার সেটাই সুখ-সাচ্ছন্দে বেড়ে উঠা রশীদ পরিবারের সন্তানকে করেছে মুক্তিকামী, বিপবী। নিজের আরাম আয়েস উপেক্ষা করে তিনি সাধারণের জীবনমান উন্নয়নের লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়েছেন। সার্বজনীনতার পথেই তিনি প্রবহমান করেছেন জীবনের গতিপথ। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, গণভোট, ভাষা আন্দোলন, গণঅভ্যুত্থান, অসহযোগ আন্দোলন এবং মুক্তিসংগ্রামে তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন একজন অকুতভয় বীর সেনানী হিসেবে এবং প্রতিটি লড়াইয়ে হয়েছেন বিজয়ী। মানুষের মুক্তিই ছিলো তাঁর আরাধ্য। সেই আরাধ্যের আরাধনাই আজীবন করেছেন তিনি।
জন্ম ও শৈশব
আর দশটা শিশুর মতো আমীনূর রশীদ চৌধূরী শৈশব স্নেহের পরশে সিক্ত ছিলো না! তাঁর জন্মদাত্রী রোগাক্রান্ত হয়ে অকালে মৃত্যুবরণ করায় মায়ের ভালোবাসা বঞ্চিত হতে হয় তাঁকে। পরিস্থিতগত কারনে কলকাতায় ভিন্ন এক পরিবেশে প্রতিপালিত হন তিনি। যার ফলে তাঁকে স্বাভাবিক শৈশবের স্বাদ থেকে বঞ্চিত হয়।
১৯১৫ সালের ১৭ নভেম্বর কলকাতার ৩৮ নম্বর জাননগর রোডে আমীনূর রশীদ চৌধূরীর জন্ম হয়। পিতা আবদুর রশীদ চৌধুরীর নিবাস ছিল তৎকালীন সিলেট জেলার সুনামগঞ্জ মহকুমার পাগলা পরগনার দুর্গাপাশা গ্রামে। তাদের পূর্বপুর“ষ ফুল খান পাঠান মুলুক থেকে এখানে এসে বসতি স্থাপন করেন। পাঠানে পাঠানে বা পাঠানে মোগলে সংঘর্ষে পরাজিত হলে মৃত্যু ছিল অবধারিত। মাঝে মাঝে ব্যতিক্রম হতো। আমীনূর রশীদ চৌধূরীর পূর্বপুর“ষদের ক্ষেত্রেও তেমনটি হয়েছিল।
আমীনূর রশীদ চৌধূরীর পিতা আবদুর রশীদ চৌধুরী শৈশবে পিতৃহীন হন। কিন্তু পিতার বিয়োগান্তে তঁার শিক্ষাজীবনে তেমন একটা ছন্দপতন হয়নি। কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বি.এ. পাস করে শিক্ষা বিভাগে চাকরি নেন। ১৯০৬ সালে আসাম সরকারের এক্সস্ট্রা অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার নিযুক্ত হন আবদুর রশীদ। তঁার মেধা ও সুন্দর চেহারা দেখে কলকাতার খান বাহাদুর আগা কবির উদ্দিন আহম্মদ আকৃষ্ট হয়ে তঁার সঙ্গে পিতৃহীন ভাইঝি রাজিয়া বেগমের বিয়ে দেন। খান বাহাদুর আগা কবির উদ্দীন আহম্মদ ও আমীনূর রশীদ চৌধূরীর মাতামহ মোহাম্মদ সঈদের পূর্বপুর“ষ ইরানের মেশেদ থেকে ভারতে আসেন। তঁারা সুন্নি ছিলেন। ইরানে শিয়াদের প্রাধান্য ছিল। সেখানকার রাষ্ট্র বিপবের পর তঁারা দিলী আসেন এবং দিলীতে উচ্চ পদ লাভ করে সসম্মানে বসবাস করতে থাকেন।
১৯০৯ সালের ২৭ নভেম্বর আবদুর রশীদ চৌধুরীর সাথে রাজিয়া রশীদের বিয়ে হয়। রশীদ-রাজিয়া দম্পতির ঔরসে প্রথম সন্তান আসে ১৯১০ সালের ২৬ নভেম্বর। নাম রাখা হয় জেবা রশীদ। জন্মগ্রহণের মাত্র চার সপ্তাহের মাথায় জেবা মারা যায়। ১৯১১ সালের ৮ নভেম্বর তাদের ঘরে জন্মগ্রহণ করে পুত্রসন্তান। নাম রাখা হয় জিয়াউর রশীদ। এই দম্পতির তৃতীয় সন্তান আমীনূর রশীদ চৌধূরী। তঁার জন্মের পর রাজিয়া রশীদ যক্ষ্মারোগে আক্রান্ত হন। তৎকালীন সময় প্রচলিত কথা ছিল ‘যক্ষ্মা হলে রক্ষা নাই’। ছেঁায়াচে এই রোগের প্রতিষেধক তখনও আবিষ্কৃত না হওয়ায় চিকিৎসকরা তঁাকে মায়ের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রাখার পরামর্শ দেন। এই পরিস্থিতিতে চৌধুরী দম্পতি মহাদুশ্চিন্তায় পড়ে যান। কিন্তু রাজিয়া রশীদেরই এক ইংরেজ সহপাঠিনী এলিজাবেথ আশার বাণী শোনান। তিনি আমীনূর রশীদ চৌধূরী দেখভাল করার দায়িত্ব নেন। এলিজাবেথ ছিলেন নিঃসন্তান। তঁার স্বামী চার্লস বেল কলকাতার তৎকালীন বিখ্যাত বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান বুলক ব্রাদার্সের ম্যানেজিং ডাইরেক্টর ছিলেন। ১৯১৯ সালের ১৯ জুন চূঁচুড়ায় গঙ্গার তীরে একটি বাড়িতে রাজিয়া রশীদ শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।
রাজিয়া রশীদের মৃত্যুর পর আবদুর রশীদ চৌধুরী বিয়ে করেন সুনামগঞ্জের পীরপুরের দেওয়ান মুহাম্মদ মুসলিম চৌধুরীর কন্যা সুকুর“ন্নেসা চৌধুরীকে। তঁার দ্বিতীয় স্ত্রীর গর্ভে জন্ম নেয়া একমাত্র সন্তান মামুনুর রশীদ চৌধুরী সমাজসেবী ও টি পান্টার ছিলেন। আবদুর রশীদ চৌধুরী তৃতীয় বিয়ে করেন মৌলভীবাজার জেলার রাজনগর থানার ইটা পরগনার দেওয়ান বংশের আবদুল করিম চৌধুরীর কন্যা সিরাজুন্নেসা চৌধুরীকে। এই দম্পতির ঘরে পঁাচ সন্তান জন্মলাভ করে। তারা প্রত্যেকেই স্ব-স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। প্রথম পুত্র হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও স্পিকার ছিলেন, কায়সার রশীদ চৌধুরী ছিলেন রাষ্ট্রদূত, ফরর“ক রশীদ চৌধুরী সমাজসেবী এবং ফার“ক রশীদ চৌধুরী ছিলেন অর্থ প্রতিমন্ত্রী, টি পান্টার ছিলেন জাহানজেব রশীদ চৌধুরী। আবদুর রশীদ চৌধুরীর সন্তানদের মধ্যে বেঁচে আছেন জেবা রশীদ চৌধুরী ও কোহীনূর দস্তগীর ও ফার“ক রশীদ চৌধুরী।
আমীনূর রশীদ চৌধূরী জ্ঞান হওয়ার পর মায়ের সান্নিধ্য না পেলেও মায়ের অভাব তিনি কোনোদিন উপলব্ধি করেননি। প্রথমে মিসেস বেল এবং পরবতর্ীকালে আম্মা বেগম সিরাজুন্নেসা চৌধুরীর তত্বাবধানে অকৃত্রিম আদরে বেড়ে ওঠেন তিনি। শৈশবে আমীনূর রশীদ হালকা-পাতলা গড়নের হলেও আকর্ষণীয় ছিলেন।
বেল দম্পতির সান্নিধ্যে থাকার কারণে শৈশবে তঁার মুখে ফুটেছে ইংরেজি বুলি। এ কারণে দশ-বারো বছর বয়স পর্যন্ত অন্য কোনো ভাষায় তিনি কথা বলতে পারতেন না। বেল দম্পতির কাছে বেড়ে ওঠার কারণে তঁার শৈশব কেটেছে অন্যরকম। তঁাদের মতো করেই আচার-অনুষ্ঠানে যোগ দিতে হতো তঁাকে। এমনকি প্রতি রোববার দু’বেলা তঁাকে চার্চে যেতে হয়েছে। থাকা-খাওয়া, চলাফেরা সবই করতে হয়েছে ইংরেজদের মতো।
শিক্ষাজীবন
বেল দম্পত্তির তত্বাবধানে কলকাতা বয়েজ স্কুলে শুর“ আমীনূর রশীদ চৌধূরীর শিক্ষা পর্ব। এই স্কুলে সহশিক্ষার ব্যবস্থা ছিল। ছাত্রছাত্রীদের প্রায় সবাই ছিলেন ইংরাজ ও অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান। চীনা এবং জাপানিও ছিলেন দু’একজন। ভারতীয় হিসেবে একমাত্র ছাত্র ছিলেন তিনি। সবকিছুই ইংরেজি ভাষায় শেখানো হতো।
বেল দম্পতির ভারতবর্ষে কাজের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে এলিজাবেথ তঁাকে সঙ্গে করে যুক্তরাজ্যে নিয়ে যাওয়ার জন্য উদ্যোগী হন। তঁাদের ইচ্ছে ছিল, আমীনূর রশীদ চৌধূরীকে নিজেদের সহায়-সম্পত্তির উত্তরাধিকারী করা। কিন্তু তঁার বাবা ও চাচা তাহিদ চৌধুরী এবং আত্মীয়-স্বজনের প্রবল আপত্তি থাকায় তঁাদের সেই ইচ্ছা বাস্তবায়িত হয়নি। বেল দম্পতির স্বদেশযাত্রার প্রাক্কালে সিলেটে নিয়ে আসা হয় আমীনূর রশীদ চৌধূরীকে। সিলেটে চলে এলেও বহু বছর বেল দম্পতি তঁার সাথে যোগাযোগ রাখেন। চিঠিপত্র ও নানা উপহার পাঠাতেন তঁাকে। মিসেস বেল ১৯৩৪ সালে এবং মি. বেল ১৯৩৬ সালে ইংল্যান্ডে মৃত্যুবরণ করেন।
কলকাতার বয়েজ স্কুলে জুনিয়র কেম্রিজ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে আমীনূর রশীদ চৌধূরী সিলেটে চলে আসেন। ভর্তি হন রাজা গিরীশচন্দ্র হাইস্কুলে (রাজা জি.সি. স্কুল) এবং সেখান থেকে ১৯২৮ সালে ম্যাট্রিক পাস করেন। উচ্চশিক্ষার জন্য তিনি স্থানীয় মুরারীচঁাদ কলেজে (এম.সি কলেজ) আই.এ ক্লাসে ভর্তি হন। কিছুকাল পড়াশোনার পর কলেজ পরিবর্তন করে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যান। সেখানে কিছুদিন পড়াশোনার পর ১৯২৯ সালে মহাত্মা গান্ধী পরিচালিত আন্দোলনে যোগদান করেন। আইন অমান্য আন্দোলনের পুরোভাগে থাকায় তঁাকে গ্রেফতার করা হয়। সেই সাথে তঁার শিক্ষাপর্বের সমাপ্তি ঘটে।
রাজনৈতিক চেতনার স্ফূরণ
যঁার চেতনায় বাঙালিয়ানার কোনো ছাপ ছিল না, সেই আমীনূর রশীদ চৌধূরী বেল দম্পতির কাছ থেকে দূরে চলে আসার পর অনুধাবন করলেনÑ ইংরেজরা উপমহাদেশকে দাসত্বের ভূমিতে পরিণত করে রেখেছে। ইংরেজ বলয়ে বেড়ে ওঠার কারণে বাঙালিদের সম্পর্কে তঁার যেসব বদ্ধমূল ধারণা ছিল ধীরে ধীরে তা পাল্টে যেতে থাকে। আবদুর রশীদ ছেলেকে সত্যের পথে চলার সাহস জোগান।
মূলত পারিবারিক-রাজনৈতিক আবহের প্রভাব পড়ে আমীনূর রশীদ চৌধূরীর ওপর। বাবা আব্দুর রশীদ চৌধুরী সরকারি চাকরিজীবী হলেও তিনি মনেপ্রাণে ছিলেন ইংরেজবিদ্বেষী। কিন্তু প্রতিকূল পরিবেশ-পরিস্থিতির কারণে সরাসরি ইংরেজবিরোধী ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারেননি। তবে ইংরেজদের বির“দ্ধে তিনি সবসময়ই সোচ্চার ছিলেন। মা সিরাজুন্নেসা চৌধুরী যখন তঁাদের আবাসস্থল রশীদ মঞ্জিলে বিপবীদের আশ্রয় দিতেন, এমনকি তাদের থাকা-খাওয়ার বন্দোবস্ত করতেন, তখন আব্দুর রশীদ খুব খুশি হতেন। নিজেও প্রয়োজনীয় সাহায্য-সহযোগিতা করতে কার্পণ্য করতেন না।
আব্দুর রশীদ খুবই উঁচুমাপের ও বড়মনের মানুষ ছিলেন। এই অঞ্চলে ১৯২০-২১ সালে যারা ইংরেজবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন, সেসব ব্যক্তির প্রায় সবারই যাতায়াত ছিল রশীদ মঞ্জিলে। তঁাদের সবার সাথেই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল আব্দুর রশীদ চৌধুরীর। করিমগঞ্জের বারহলের মৌলবি রিয়াজ উদ্দিন চৌধুরী, মো. আব্দুলা বিএল, মকবুল হোসেন চৌধুরী, মওলানা আবদুল মুসাব্বির ও আবদুল মতিন চৌধুরীর যাতায়াত ছিল তঁাদের বাড়িতে।
তৎকালীন সময় ইংরেজ সরকারের দৃষ্টি ছিল এই নেতাদের ওপর। ঔপনিবেশিক পুলিশের সন্দেহভাজনদের তালিকায় তঁারা ছিলেন শীর্ষে। প্রায় প্রতিদিনই তঁাদের আড্ডা বসত রশীদ মঞ্জিলে। পারিবারিক আবহই তাকে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত হতে উদ্বুদ্ধ করে। সহিংস এবং অহিংস উভয় পন্থার আন্দোলনের সাথেই তিনি সম্পৃক্ত ছিলেন ওতোপ্রোতভাবে।
আমীনূর রশীদ চৌধূরীর দ্রোহী চেতনা শাণিত করতে বিপবী অমূল্য ঘোষের ভূমিকা অনেকখানি। সহিংস আন্দোলনের সাথে জড়িয়ে পড়তে তঁাকে উদ্বুদ্ধ করেন অমূল্য ঘোষ। বিপবী দলের কর্মকাণ্ড বেগবান করতেই তিনি সিলেট আসেন। ঢাকা জেলার পদ্মার চরের অধিবাসী অমূল্য ঘোষ শৈশবে পিতৃহীন হন। বোনের অকৃত্রিম স্নেহে বেড়ে ওঠেন তিনি। তঁার দিদি সিলেট চৌহাটাস্থ পোস্টঅফিসের মাস্টার হয়ে যোগ দিলে অমূল্য ঘোষ সিলেট গভর্নমেন্ট হাইস্কুলে ভর্তি হন। তিনি আমীনূর রশীদ চৌধূরীর চেয়ে চার-পঁাচ বছরের বড় ছিলেন। স্বদেশপ্রেমী বাবা-মায়ের প্রেরণা আর অমূল্য ঘোষের দিক নির্দেশনায় গোপন রাজনৈতিক দলের অপরিহার্য সৈনিকে পরিণত হন আমীনূর রশীদ। শুর“ হয় নতুনের পথে পথচলা।
বাঘা বাঘা নেতাদের সাথে তঁার পরিচিত হওয়ার পেছনে ভৌগোলিক অবস্থানগত দিকটিও কাজ করেছে। তৎকালীন সময়ে সিলেটকে বিপবীরা নিজেদের অন্যতম নিরাপদ ঘঁাটি হিসেবে ব্যবহার করতেন। সিলেট শহর থেকে শুর“ করে হাওরবেষ্টিত জনপদগুলো ছিল বিপববাদীদের নিরাপদ আস্তানা। সিলেট জেলা আসামের অর্ন্ক্ত থাকায় এবং আসাম ও বেঙ্গল পুলিশের মধ্যে তেমন যোগাযোগ ও সহযোগিতা না থাকার সুযোগকে কাজে লাগান দূরদশর্ী বিপবীরা।
তৎকালীন সিলেট জেলার কুলাউড়া এলাকা ছিল বিপবীদের অন্যতম নিরাপদ স্থান। রঙ্গিরকুল আশ্রম ছাড়াও কুলাউড়ার নিকটবতর্ী কঁাকড়াছড়া (বর্তমানে রেহানা) ও গুগালীছড়া (বর্তমানে মেরিনা) চা বাগান ছিল বাংলাদেশের অসংখ্য বিপবীর নিরাপদ আশ্রয়স্থল। অমূল্য ঘোষের মাধ্যমে সিলেট অঞ্চলে দলের আত্মগোপনকারীদের সাথে সাক্ষাতের সুযোগ ঘটে আমীনূর রশীদ চৌধূরীর। এ থেকেই ঘনিষ্ঠতা, সখ্য। এই বিপবীদের অনেকে বিভিন্ন সময় রশীদ মঞ্জিলেও আশ্রয় গ্রহণ করেন।
একই সময়ে হবিগঞ্জের অমিয় দত্ত চৌধুরী, সুবোধ রায়, চঞ্চল শর্মা, সিলেটের বিভূতি লস্কর, কালীরমণ ভট্টাচার্য, প্রহ্লাদ চন্দ্র দাস, নরেন্দ্রনাথ মহাপাত্র, ধীরেন্দ্র দত্ত, সুবোধ দত্তের সাথে তঁার যোগাযোগ গড়ে ওঠে।
বিপবী দলের কর্মকাÊ বেগবান করতে সিলেটে তর“ণ সংঘ এবং ছাত্র সংঘ নামের দুটি ছাত্র সংস্থা গঠন করা হয়। সিলেট নগরীর মণিপুরি রাজবাড়ির পেছনে তর“ণ সংঘের এবং দঁাড়িয়াপাড়ায় ছাত্র সংঘের সদস্যদের প্রশিক্ষণ দেয়া হতো। বিপবী দলের অপরিহার্য ব্যক্তিতে পরিণত হওয়ায় দলের সব ধরনের কার্যক্রমেই অংশ নিতে হতো আমীনূর রশীদ চৌধূরীকে। সে সময় দলের অর্থ সংগ্রহের জন্য বিপবীরা লুটতরাজ চালাতো। মেইল ভ্যান, সরকারি অফিস-আদালত, এমনকি ইংরেজদের তঁাবেদাররাও রেহাই পেতো না তাদের হাত থেকে। সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়কের জাঙ্গাইল গ্রামের কাছে তৎকালীন সময়ে একটি ডাকাতির ঘটনা ঘটে। এতে দলের অন্য সদস্যদের সাথে তিনি অংশ নেন এবং সেখান থেকে প্রাপ্ত সাত হাজার টাকা নিরাপদ বিবেচনায় বিপবীরা তঁার কাছে রেখে দেন। আমীনূর রশীদ সেই টাকা নিজের বালিশের নিচে রাখেন। বিষয়টি অঁাচ করতে পেরে পিতা আব্দুর রশীদ বিপদের শঙ্কায় টাকাগুলো ছেলের কাছ থেকে নিয়ে নিজের কাছে রেখে দেন। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে বাবার কাছ থেকে টাকাগুলো নিয়ে যথাস্থানে পেঁৗছে দেন তিনি।
জেল জীবন
ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত থাকার কারনে আমীনূর রশীদ চৌধূরীকে কিশোর বয়সেই জেলে যেতে হয়। মাত্র তেরো বছর বয়সে জেলের তিক্ত অভিজ্ঞতা অর্জন করেন তিনি। এরপর অনেকটা ধারাবাহিকভাবেই আসা-যাওয়া করতে হয় জেলে। শৈশবে যে বয়সে শিক্ষাঙ্গনে সময় অতিবাহিত করার কথা সেই সময়টাতে কারাগারের অন্ধকার জীবন তঁাকে বারংবার গ্রাস করেছে। তথাপি তিনি ছিলেন আলোর পথের অভিযাত্রী। আলোর পথেই ছিল তঁার পথচলা।
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের কমর্ী হিসেবে মোট চারবার জেলে যেতে হয়েছে তঁাকে। দীর্ঘমেয়াদে জেলে ছিলেন আইন অমান্য আন্দোলনে অংশগ্রহণের অপরাধে। ১৯৩২ সালে সিলেট গোবিন্দ পার্কে সরকারের আইন অমান্য করে উস্কানিমূলক বক্তব্য প্রদানের অপরাধে তঁার দেড় বছরের কারাদণ্ড হয়। পুরো দেড় বছরই ছিলেন জেলে। আমীনূর রশীদ চৌধূরী স্বদেশি আন্দোলনের সাথে যুক্ত থাকার অপরাধে প্রথমবার গ্রেফতার হন।
আন্দোলন-সংগ্রামে আত্মনিয়োগ করার কারনে আমীনূর রশীদের লেখা পড়া বিনষ্ট হওয়ার উপক্রম হলে আব্দুর রশীদ তঁাকে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ব্যবস্থা করেন। সে অনুযায়ী আমীনূর রশীদ চৌধূরী উত্তর প্রদেশে পাড়ি জমান। আব্দুর রশীদের ঘনিষ্ঠজন ছিলেন বিচারপতি আবদুস সোবহান চৌধুরী ও সিকন্দর আলী। তঁাদের তত্ত্বাবধানেই নতুন করে শিক্ষাজীবন শুর“ করেন আমীনূর রশীদ চৌধূরী। কিন্তু বেপরোয়া মনোভাব থেকে তঁাকে নিবৃত্ত করা যায়নি। আইন ভাঙা যেন ছিল তঁার সহজাত প্রবৃত্তি। তবে সেখানে বড় ধরনের কোনো বিপত্তিতে পড়তে হয়নি তঁাকে। হঠাৎ একদিন তাতে ছন্দপতন ঘটে। আলীগড়ে গিয়ে হাজির হন সিলেট পুলিশের এক দারোগা। প্রিন্সিপালের র“মে ডেকে আনা হয় আমীনূর রশীদকে। সেই ঘর পোড়ানো মামলায় পুলিশ তঁাকে গ্রেফতার করে সিলেটে নিয়ে আসে।
অমূল্য ঘোষের সাথে সম্পর্ক ও বিপবী দলে যোগদানের কারণেই পুলিশের নজরে পড়েছিলেন আমীনূর রশীদ চৌধূরী। কিন্তু তঁাকে শায়েস্তা করার কোনো সুযোগ না পেয়ে ঘর পোড়ানো মামলার আসামি করা হয়। জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর পুরোপুরি বিপবী কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িয়ে পড়েন তিনি। পরিবারের সদস্যরা যাতে বিপাকে না পড়েন এজন্য ঘর ছাড়েন। শুর“ হয় তঁার ভবঘুরে জীবন। নিবেদিতপ্রাণ বিপবী আমূনীর রশীদ চৌধুরী দলের অপরিহার্য কমর্ীতে পরিণত হন। শুধু সিলেট অঞ্চলে নয়, শিলচরসহ অন্যান্য অঞ্চলেও দলের প্রচারকার্যে অংশগ্রহণে যেতে হয় তঁাকে। শিলচরে প্রচার কাজ চালাতে গিয়ে দ্বিতীয়বার পুলিশের হাতে ধরা পড়েন। এরপর যথারীতি পাঠিয়ে দেয়া হয় জেল-হাজতে। মাসাধিককাল জেলের ঘানি টানার পর আব্দুর রশীদ চৌধূরীর ঘনিষ্টজন এক্সট্রা অ্যাসিট্যান্ট কমিশনার নসিব আলী মজুমদারের বদৌলতে মুক্তি পান তিনি। একই সময়ে গান্ধীসহ অন্য রাজবন্দিরা মুক্তি পান। কিন্তু লন্ডনে রাউন্ড টেবিল কনফারেন্সে ফলপ্রসূ না হওয়ায় ফের শুর“ হয় আইন অমান্য আন্দোলন। মিছিল-সমাবেশে যোগদান ও দলীয় প্রচার কাজে পুরোদমে আত্মনিয়োগ করেন আমীনূর রশীদ চৌধূরী।
সিলেটের গোবিন্দচরণ পার্কে একটি সভা অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে গিয়ে তৃতীয়বারে মতো গ্রেফতার হন আমীনূর রশীদ চৌধূরী। পুলিশ তঁাকে আটক করেই ক্ষান্ত হয়নি। তঁার ওপর চালায় অমানুষিক নির্যাতন। নির্যাতনে তার টেইল বোন ভেঙে যায়।
মাহাত্মা গান্ধী ও নেতাজীর সান্নিধ্যে
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের দুই দিকপাল মহাত্মা গান্ধী ও নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর সান্নিধ্যে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল আমীনূর রশীদ চৌধূরীর। ঘনিষ্ঠতাও ছিল তঁাদের সাথে। আমীনূর রশীদ চৌধূরী বিখ্যাতজনদের অটোগ্রাফ একটি খাতায় লিপিবদ্ধ করে রাখতেন। ১৯৭১ সালে ডায়েরিটা বাড়ির অন্যান্য মূল্যবান সামগ্রীর সাথে লুট হয়ে যায়। এ কারণে আমীনূর রশীদ চৌধূরীর আত্মস্মৃতিতে গান্ধীজির সাথে তঁার সাক্ষাতের বিবরণ পাওয়া গেলেও সঠিক দিন-তারিখের উলেখ নেই। গান্ধীজির সাথে একাধিকবার সাক্ষাতের বিবরণ স্থান পেয়েছে তঁার স্মৃতিকথায়। একদিনের বর্ণনাÑ
‘খান আবদুল কাইয়ুম খান যখন বিড়লা ভবনে যাওয়ার প্রস্তাব করলেনÑআমি খুশি হয়ে রাজি হয়ে গেলাম। …কাইয়ুম খান গিয়েছিলেন মহাত্মার সঙ্গে সীমান্ত প্রদেশের রাজনৈতিক অবস্থা জানানোর জন্য। অনেকক্ষণ আলাপ হলো। মহাত্মাজি আমাকে রহস্য করে জিগ্যেস করলেনÑ ‘তুমিও তো আরো এক সীমান্ত প্রদেশের লোক অর্থাৎ আসামের, তোমাদের সেখানকার বড়দলই সরকার কী রকম কাজ করছে?’
উত্তরে বললামÑ ‘গোপীনাথ বড়দলই অত্যন্ত সৎ ও ভদ্রলোক। তার সরকার তো ভালো চলবে-ই।’
গান্ধীজি হেসে হেসে বললেনÑ ‘বড়দলইকে আমি চিনি। ও তো ভালো মানুষ, কিন্তু অন্যেরা।’
আমি বললামÑ ‘ফখর উদ্দিন থেকে আরম্ভ করে সবাই ভালো লোক। আমাদের ওখানে কোনো কিছু নষ্ট হওয়ার ভয় নেই।’
সহিংস পন্থার আন্দোলনের সাথে যুক্ত থাকার সুবাদে নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর সাথে তঁার যোগসূত্রতা এবং ঘনিষ্ঠতা ছিলো। নেতাজীর আজাদ হিন্দ্ ফৌজের সৈনিক হিসেবে কাজ করেছেন। শুধু তাই নয় নিজ বাসভবনকে করেছিলেন নেতাজী নেতৃত্বাধীন আজাদ হিন্দ্ সরকারের কার্যালয়। নেতাজীর সাথে পত্র যোগাযোগও ছিল আমীনূর রশীদ চৌধূরীর। নেতাজীর সাথে প্রথমবার সিলেটেই সাক্ষত হয় তাঁর। সেবার একটি একটি সম্মেলনে যোগদান করতে সিলেটে আসেন বসু। তার সাথে দেখা করতে গেলে তিনি সস্নেহে আমিনূও রশীদ চৌধূরীর পিঠ চাপড়িয়ে বললেনÑ ‘এরি মধ্যে লায়েক হয়ে গেছ! হাজতবাস, আর পুলিশের মার, দুটিই হয়ে গেছে। তুমি দেশের কাজে লাগবে।’
তখন থেকে অনেকবার নেতাজীর সান্নিধ্য লাভ ও তঁার নির্দেশ পালনের সুযোগ হয়েছিল বিপবী আমিনূও রশীদের। নেতাজীর সিলেট, কাছাড় ও ত্রিপুরা জেলাকে নিয়ে ‘পূর্বাচল’ নামে একটি প্রদেশ গঠনের পরিকল্পনা করেছিলেন। এই পূর্বাচলের জন্য ‘শ্যাডো ক্যাবিনেট সদস্যদের মধ্যে আমীনূর রশীদের নামও তালিকাভুক্ত করা হয়েছিলো।’
নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর অনুপ্রেরণায় দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় আজাদ হিন্দ ফৌজের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য বার্মা যাওয়ার পথে ভারত-বার্মা সীমান্তে ইংরেজদের অনুগত সরকারি ভারতীয় বাহিনীর হাতে ধরা পড়েছিলেন আমীনূর রশীদ চৌধূরী। মুখ থেকে কথা বের করার জন্য সৈন্যরা তঁার ওপর অত্যাচারের স্টিমরোলার চালায়। তাদের হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য তিনি স্বদেশি ভাষায় কথা না বলা এবং নিজেকে অস্ট্রেলীয় বাহিনীর সৈন্য হিসেবে পরিচিত করার চেষ্টা চালান। নিজের বুদ্ধিমত্তার বদৌলতে সে যাত্রায় রক্ষা পান তিনি।
রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে
১৯৫২ সালে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবীতে যখন রাজপথ উত্তাল তখন আমিনূর রশীদ চৌধূরী রাজপথে ছিলেন। উদুর্কে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার বির“দ্ধে তিনি ছিলেন সোচ্চার। সে সময়ে সিলেটের রাজপথে আমীনূর রশীদ চৌধূরীর পদাচারণা ছিলো উলেখ করার মতো। প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফের ভাষায়Ñ বিভাগ পূর্ব যুগে সিলেটের সাংস্কৃতিক জীবনে যে ত্রিশংকুর অবস্থা ছিল তাতে আমীনূর রশীদের মত সংস্কৃতিমনা মানুষের সাহায্য ও সহযোগিতা না পেলে সিলেটের মুসলিম সমাজের সাংস্কৃতিক জীবন অচল হয়ে পড়তো। সিলেট পূর্বাপর অবিভক্ত বাংলাদেশের অংগ হিসাবে ছিল। ১৮৭৪ সালে জনগণের প্রতিবাদ সত্ত্বেও সিলেটকে আসামের সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়ার ফলে সিলেটের লোকদের আসামীরা বলতো বাংগালী আর বাংগালীরা বলতো আসামী। এদিকে, আবার সিলেটের তথাকথিত অভিজাত সমাজ উদুর্কে সিলেটের সংস্কৃতির ভাষা বলে প্রচার করতেন। এসব প্রচারণার বির“দ্ধে বাংলা ভাষাকে আমাদের মাতৃভাষারূপে গ্রহণ করে এবং তারই মাধ্যমে আমাদের সাংস্কৃতির বিকাশের জন্য তখনকার দিনের যে সব বিদ্রোহী এগিয়ে এসেছিলেন, আমীনূর রশীদ চৌধূরী ছিলেন তাদের অন্যতম। এ দলের উদ্যোগেই ১৯৩৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে মুসলিম সাহিত্য সংসদ গঠিত হয়েছিল।’
প্রতিরোধ আন্দোলনে ভূমিকা
’৬৯ এর গনঅভ্যুত্থান এবং ’৭০ এর অসহযোগ আন্দোলনে আমীনূর রশীদ চৌধূরী ছিলেন নীতি নির্ধারকদের ভুমিকায়। তঁার দিক নির্দেশনা আন্দোলনকারীদের চলার পথের পাথেয় হয়েছে। দলীয়ভাবে আওয়ামীলীগের সাথে কোনো সম্পর্ক না থাকলেও আওয়ামীলীগ বা সমমনা অন্যদলের নেতারা তাঁকে অভিভাবকের আসনে বসিয়েছিলেন। আজন্ম প্রতিবাদী ও সততার প্রশ্নে আপোষহীন অগ্নিযুগের এই বিপবীকে সাধারণ মানুষ নিজেদের বন্ধু ভাবতো।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে পারিবারিক সম্পর্ক ছিলো আমীনূর রশীদ চৌধূরীর। ৭০-এর নির্বাচন পরবতর্ী সময়ে রাজনৈতিক অস্থিতিশীল পরিস্থিতি ও অন্যান্য বিষয় নিয়ে বঙ্গবন্ধুর সাথে তঁার মাঝে মধ্যেই ফোনালাপ হতো। দেশের পরিস্থিতি দিনে দিনে অবনতির দিকে ধাবিত হতে থাকলে সাধারণের ন্যায় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন আমীনূর রশীদ চৌধূরী। এই পর্যায়ে ‘৭১ সালের পহেলা মার্চ ঢাকায় একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে যান তিনি। ২ মার্চ স্ত্রী ফাহমীদা রশীদ চৌধুরী নিয়ে বঙ্গবন্ধুর সাথে ধানমন্ডীস্থ বাসভবনে সাক্ষাৎ করেন। এসময় তাদের সাথে ছিলেন তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুস সামাদ আজাদ। সেদিন দেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে বঙ্গবন্ধুর সাথে দীর্ঘক্ষণ কথা হয় রশীদ দম্পতির। বঙ্গবন্ধুর কথায় দেশের পরবতর্ী রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে অবগত হতে আমীনূর রশীদ চৌধূরীর কোনো অসুবিধা হয়নি। সিলেটে ফিরে আগামীর করনীয় সম্পর্কে সিলেটের শীর্ষস্থানীয় রাজনীতিবিদদের সাথে এ নিয়ে আলোচনা করেন তিনি। এরই মধ্যে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ সারা বাংলাদেশের ন্যায় সিলেটেও এসে বিপবের স্ফুরণ ঘটনায়। স্বাধীনতার জন্য আন্দোলনের বিকল্প নেই তা বুঝতে বাকী থাকেনা কারো। শুর“ হয় মিছিল-মিটিং সমাবেশ। গঠিত হয় সংগ্রাম পরিষদ। আন্দোলন পরিচালনার অন্যতম কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয় জ্যোতি মঞ্জিল। প্রায় প্রতিদিনই জ্যোতি মঞ্জিলে অনুষ্ঠিত হয় সভা। এই সভাগুলোতে অংশগ্রহণ ছাড়াও স্ত্রী ফাহমীদা রশীদ চৌধুরী সিলেটের নারীদের স্বাধীনতা আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত করতে তৎপরতা চালাতে শুর“ করেন আমীনূর রশীদ চৌধূরীর অনুপ্রেরণায়।
১৯৭১ সালে মার্চ মাসে সিলেট নগরীতে স্বাধীনতার দাবীতে যে বিশাল মিছিল বের হয় তাতে সিলেটের উলেখযোগ্য সংখ্যক নারী অংশগ্রহণ করেন। এমনকি সেই মিছিল শিশুকন্যারাও যোগ দেন। মিছিলে নারীদের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে সকল প্রতিবন্ধকতা উপেক্ষা করে ফাহমীদা রশীদ চৌধুরী বাড়ি বাড়ি গিয়ে অনুপ্রেরণা যোগান। এমনকি মেয়েসমেত সেদিনের মিছিলে অংশগ্রহণ করেন তিনি।
মুক্তিসংগ্রাম শুর“ হওয়ার পর পরই আমিনূর রশীদ চৌধূরী যুদ্ধে ঝঁাপিয়ে পড়ার আহ্বান সংবলিত প্রায় ২ লক্ষাধিক পোস্টার যুগভেরী প্রেস থেকে মুদ্রণ করেন। যা তৎকালীন সময়ে ইপিআরসহ অন্যান্যদের মধ্যে বন্টন করা হয় এবং এ অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত ও প্রানসঞ্চার করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
মুক্তিসংগ্রামের বীর সেনানী
আরেকটি সশস্ত্র লড়াইয়ে অংশ গ্রহণের প্রস্তুতি নিচ্ছেলেন আমীনূর রশীদ চৌধূরী। সব প্রস্তুতি চূড়ান্ত করে যখন অস্ত্র হাতে লড়াই করার জন্য শত্রুর উপর ঝাপিয়ে পড়ার পরিকল্পনা করেন তখনই পাক হানাদারদের হাতে আটক হন তিনি। শ্রীমঙ্গলের নিজ মালিকানাধীন চা বাগান থেকে স্ত্রী ও মেয়েকেসহ তঁাকে আটক করে সিলেটে নিয়ে আসে পাক সেনাবাহিনীর সদস্যরা। আটকের পর স্ত্রী সন্তাদের হাউজ এরেষ্ট করে রাখলেও হায়নারা আমিনূর রশীদ চৌধূরীকে নিয়ে যায় তাদের টর্চার সেল শহরতলীর সালুটিকরস্থ মডেল হাইস্কুলে। সেখানে একশ ত্রিশ দিন আটকে রেখে অমানুষিক নির্যাতন চালায় তঁার উপর। নির্যাতনে শরীর ক্ষতÑবিক্ষত হলেও তঁার কাছ থেকে মুক্তিযুদ্ধ সম্পকর্ীত কোনো তথ্য উদঘাটন করতে পারেনি হানাদাররা।
পাকিদের হাতে আটক হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করার পাশাপাশি ভারতে প্রশিক্ষণ ও শরণাথর্ী শিবিরের জন্য অর্থ সংগ্রহে রত ছিলেন। এছাড়াও সিলেট থেকে চা পাতা, গাড়ি এবং বিপুল পরিমাণ কাপড় সংগ্রহ করে মুজিবনগর সরকারের দায়িত্বশীলদের হাতে তুলে দেন তিনি। এই তৎপরতার খবর দালাল মারফত অবগত হয়ে তঁাকে গ্রেফতারের পরিকল্পনা করে হানাদাররা। বিষয়টি জানতে পেরে আম্মা সিরাজুন্নেসা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। আমিনূর রশীদ চৌধূরীর উদ্দেশ্য ছিলো, সিলেটে অবস্থান করে শত্রুদের মোকাবেলা করা। কিন্তু সিরাজুন্নেসার অনুরোধ আর পরিবার পরিজনের কথা ভেবে অনিচ্ছা সত্বেও তাকে শ্রীমঙ্গলে যেতে হয়। এপ্রিল মাসের ৮ তারিখ তিনি শ্রীমঙ্গলে চলে যান।
শ্রীমঙ্গল শহর তখনও শত্রুমুক্ত ছিল। আগে থেকেই শ্রীমঙ্গলে অবস্থান করছিলেন দেওয়ান ফরিদ গাজী। তিনি সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করতে শুর“ করেন। দিন কয়েক শ্রীমঙ্গলে অবস্থান করে ফরিদ গাজী ভারতে চলে যান। যাবার পূর্বে আমিনূর রশীদ চৌধূরীসহ অন্যান্য মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকদের সাথে একাধিক বৈঠক করেন। এসময় আমীনূর রশীদ চৌধূরীর উপর গুর“ দায়িত্ব অর্পন করা হয়। তঁাকে প্রধান করে একটি অর্থ উপ কমিটি গঠন করা হয় মুক্তিযুদ্ধের জন্য অর্থ সংগ্রহের লক্ষ্যে। কমিটিতে অন্য যারা ছিলেন তারা হলেনÑজেমস্ ফিনলে চা বাগানের ম্যানেজার এস.এম উদ্দিন ও এবিএম মজুমদার, স্থানীয় এসএনএ মোহাম্মদ ইলিয়াস এবং এমপি এ আলতাফুর রহমান চৌধুরী।
আমীনূর রশীদ চৌধূরী প্রথমেই ঘনিষ্টজন, চা বাগানের মালিক ও ম্যানেজারদের সাথে যোগাযোগ করে মোটা অংকের টাকা সংগ্রহ করেন। তাদের কাছ থেকে গাড়িও চেয়ে নেন। পাশাপাশি বিপুল পরিমান-কাপড় সংগ্রহ করেন শরনার্থীদের জন্য। এছাড়াও প্রায় প্রতিদিনই নিজের জীপে করে সীমান্ত এলাকায় চলে যেতেন। এই অঞ্চলের লোকজনদের কাছে নিরাপদে ওপারে পাড়ি দেওয়ার অন্যতম র“ট ছিলো শ্রীমঙ্গল সীমান্ত। বর্ডারে দঁাড়িয়ে লোকজনদের ওপার যাত্রায় সহযোগিতা করেছেন তিনি। শুধু সীমান্তে অবস্থান করেই দায়িত্ব শেষ করতেন না, নিজের গাড়ি নিয়ে মাঝে মধ্যেই চলে যেতেন আগরতলা। এই অঞ্চলের পরিস্থিতি ও সংগৃহীত অর্থসহ অন্যান্য সামগ্রী তুলে দিতেন সেখানে অবস্থারত নেতৃস্থানীয়দের হাতে। এরপর বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়ে আসতেন দেশে। আমিনূর রশীদ চৌধূরীর নেতৃত্বাধীন উপকমিটি ১৯৭১ সালের ২৮ এপ্রিল পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কয়েক হাজার কাপড়, রেশন ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী সরবরাহ করে।
মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে যেখানে মানুষজন ঘর থেকে বের হতে সাহস পেতো না; সেখানে আমীনূর রশীদ চৌধূরী নিজের জীবন বাজী রেখে দিনরাত সমানতালে কঠোর পরিশ্রম করে দেশ মাতৃকার শ্রেষ্ঠ সন্তানদের একজনের ভুমিকা পালন করেন। স্বাধিনতার স্বপ্নে যখন আমিনূর রশীদ চৌধূরী বিভোর ঠিক এমনি একদিন শ্রীমঙ্গল হানাদারদের দখলে চলে যায় এবং সেদিনই (৬ মে) নূরজাজান চা বাগান থেকে তাকে সপরিবারে আটক করে সিলেটে নিয়ে আসে। এরপর তাকে সালুটিকরস্থ মডেল হাইস্কুলে নিয়ে গিয়ে একটি কামরায় তালাবন্দি করে রাখা হয়। হাত বেধে চালানো হয় অমানুষিক নির্যাতন। তঁার কাছে জানতে চাওয়া হয়Ñ মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকরীদের নাম ঠিকানা ও মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে কারা জড়িত সেসব তথ্য। এজন্য তঁার উপর চাপ প্রয়োগ করা হয়। শত নির্যাতনেও তাকে টলানো যায়নি। প্রায় সব ধরনের নির্যাতন চালিয়েও পাকিরা ব্যর্থ হয় তার কাছ থেকে তথ্য আদায়ে। প্রায় প্রতিদিনই তঁার ওপর নির্যাতন চালানো হতো। নির্যাতনে অজ্ঞান হয়ে গেলে নিস্তার পেতেন।
মুক্তি পেলেন যেভাবে
পাকিস্তানী বন্দি শিবির থেকে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকদের জীবন নিয়ে ফিরে আসার খুব একটা নজির নেই। যারাই ফিরে এসেছেন তারা ফিরেছেন কাকতালীয়ভাবে, অথবা পঙ্গু হয়ে। আমীনূর রশীদ চৌধূরীর ক্ষেত্রে কাকতালীয় কোনো ঘটনা ঘটেনি। সিলেট মডেল হাইস্কুলের বন্দি শিবির থেকে তিনি ফিরে আতে সক্ষম হন ঘনিষ্ট কয়েকজন ইউরোপিয় বন্ধুর কল্যাণে। তাদের চতুরতার কাছে হেরে যায় পাক জান্তা। যার ফলে অনেকটা ‘মেঘ না চাইতে বৃষ্টি’র মতো মুক্তি লাভ করেন তিনি। কিন্তু মুক্তি দেওয়া হলেও প্রথমদিকে তাকে গৃহবন্দি করে রাখা হয়। কৌশলী বন্ধুরা তঁাকে বঁাচাতে অনঢ় থাকে। গৃহবন্দি থাকা অবস্থায়ই তারা তঁার সাথে দেখা করে এবং কিভাবে দেশ ত্যাগ করার বন্দোবস্ত করা হয়েছে তা নিশ্চিত করে।
পাকিস্তান আমলে বিদ্যমান আইন অনুযায়ী ট্রেড বডির কোনো কর্মকর্তাকে একাধারে তিন বছরের অধিককাল একই পদে রাখার বিধান ছিল না। ১৯৭১ সালে সে কারণে কোনো পদধারী কর্মকর্তা ছিলেন না আমীনূর রশীদ চৌধূরী। ’৭১ সালের মাঝামাঝি সময়ে তাকে পুণরায় এই প্রতিষ্ঠানের সহ-সভাপতি মনোনীত করা হয়। ইউরোপীয় বন্ধুরাই এক্ষেত্রে ক্রীড়ানকের ভুমিকা পালন করেন। তারাই স্বপ্রনোদিত হয়ে তাকে সহ-সভাপতি মনোনীত করেন। তাদের এই মনোনয়নের পেছনে ছিল আমীনূর রশীদ চৌধূরীকে রক্ষা করার পরিকল্পনা।
শ্রীমঙ্গল থেকে তাকে আটক করে নিয়ে আসার সময় শেরপুর খেয়া পারাপারকালে অনেকটা কাকতালীয়ভাবে মেসার্স ডানকান ব্রাদার্সের চট্টগ্রামের অফিসস্থ বড়কর্তা এলেপটারার ম্যাকডোন্যাল্ডের সাথে দেখা হয় তঁার। অন্য বন্ধুদের সে খবর অবগত করেন এলেপটারার ম্যাকডোন্যাল্ড। এমনকি বন্দিদশায় থাকাকালীন সময়ে মডেল স্কুলে গিয়ে তঁার খোজ খবরও নেন তিনি। এবং সহ-সভাপতি মনোনয়নের কথাও জানান। আমীনূর রশীদ চৌধূরীর জবানীতে শুনা যাক সে সময়ের কথাÑ‘জেমস ফিনলের বড় কর্তা নরম্যান স্মিথ ও এলেপ্টেয়ার ম্যাকডোনাল্যান্ড দু’জনে মিলে আমাকে বাঁচাবার বহু চেষ্টা করেছেন। যখন আমি বাড়িতে কড়া পাহারায় গৃহবন্দি তখন জেমস ফিনলের অন্যতম কর্তা বিল প্যাট্রি আর পাকিস্তান টি এসোসিয়েশনের জর“রী এ্যাকটিং সেক্রেটারী কর্নেল হিউস এসোসিয়েশনের আর্জেন্ট কাজের অছিলায় আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে কি প্রচেষ্টা নেওয়া হচ্ছে জানালেন। ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে জেনিভায় অনুষ্ঠিতব্য আই.এল.ওর কমিটি অন ওয়ার্কস এ পাকিস্তানের উপযুক্ত ডেলিগেট না থাকলে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে এই ওজরে আমাকে পাকিস্তান চা-শিল্প মালিকগণের প্রতিনিধি মনোনয়ন দিয়ে সরকারের সঙ্গে বিস্তর দেন দরবার করে, দেশ ছেড়ে পালাবার ব্যবস্থা হয়ে গেছে জানালেন। এ যেন ফ্রাইং প্যান (আগুনে পোড়া) থেকে বাঁচাবার পথ।’ তাদের সে প্রচেষ্টা নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে ফিরিয়ে আনে আমিনূর রশীদ চৌধুরীকে।
ছাড়া পেলেও ঘুচেনি বন্দি দশা
মুক্তি পাওয়ার পরও বন্দি দশা ঘুচেনি আমিনূর রশীদ চৌধূরীর। হাউজ এরেস্ট করে রাখা হয় পরিবারের সদস্যদের। প্রথমে ৭ জন সেনা সদস্য এবং পড়ে ৬ জন দারোগা দিয়ে বসানো হয় ক্যাম্প। কারো সাথে তিনি যেনো দেখা করতে না পারেন সেজন্য নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। বাড়ির বিদ্যুৎ ও টেলিফোনের লাইন বিচ্ছিন্ন রাখা হয়। শুর“ হয় উদ্বেগ-উৎকন্ঠা এবং অবর“দ্ধকালীন জীবন যাপন।
মাত্র পঁচিশ পাউন্ড নিয়ে ৭১ সালের ১৬ই সেপ্টেম্বর স্ত্রী ও মেয়েকে নিয়ে জেনেভার উদ্দেশ্যে সিলেট ছাড়েন তিনি। এসময় তার আবাসস্থলকে নিশ্চিহ্ন করার প্রচেষ্টা চালায় হানাদাররা। জ্যোতি মঞ্জিলকে বম্বিং করে উড়িয়ে দেয়ার অপচেষ্টা চালায় পাকবাহিনী। আর তাদের এ দেশীয় দোসররা বাড়িতে চালায় লুটতরাজ। অনেক মূল্যাবান সামগ্রী লুট করে নিয়ে যায় হানাদারদের পদলেহনকারীরা।
মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে জেনেভায় যাত্রা
নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পান আমিনূর রশীদ চৌধূরী। অনেকটা কাকতালীয়ভাবে পরিবারসহ তাঁর জীবন রক্ষা পায়। জেনেভায় যাবার জন্য সকল কাগজপত্র ঠিক করে দেন তার ইউরোপীয় বন্ধুরা। কিন্তু প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো ক্লিয়ারেন্স না দেওয়ায় সিলেট ছাড়তে পারছিলেন না তিনি। এরকমই একদিন সেই ক্লিয়ারেন্স এসে যায়। পাকবাহিনীর পক্ষ থেকে জানিয়ে দেওয়া হয়Ñ দেশ ছাড়তে আর তাদের কোনো বাধা নেই। বন্ধুর পরিস্থিতিতে এমন সংবাদে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেন তিনি। পরিকল্পনা অনুযায়ী রওয়ানা হন ঢাকার পথে। ঢাকা থেকে পিআইয়ের একটি ফ্লাইটে লন্ডনের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন স্ত্রী ও মেয়েকে নিয়ে। কিন্তু করাচী বিমানবন্দরে পৌছার পর তাদের বিমান থেকে নামানো হয়। আর্মি ইন্টেলিজিয়েন্সের নির্দেশে তাদের বিমানবন্দরে আটকে রাখা হয়। জানানো হয়Ñ নির্দেশনা আছে লন্ডন যেনো যেতে না দেওয়া হয় তাদের। হতবাক হয়ে যান আমীনূর রশীদ চৌধূরী, মনে শংসয় সৃষ্টি হয় তার। সেখানে প্রায় ৮ ঘন্টা আটকে রাখার পর তাদের পুনরায় পাকিস্তান বিমানের একটি ফ্লাইটে করে বাংলাদেশ নিয়ে আসা হয়। পাক আর্মির এক সদস্য তাদের ঢাকায় নিয়ে আসেন। পাক আর্মির ঐ সদস্য কতৃর্ক তাদেরকে যার হাতে তুলে দেওয়ার কথা ছিলো তাকে না পেয়ে বিমানবন্দরে দায়িত্বরত আর্মির অন্যএক সিপাহির কাছে রেখে তাকে একটি চিরকুট দিয়ে সে ফিরতি ফ্লাইটে করাচীতে পাড়ি জমায়। ঐ আর্মি কর্মকর্তার বিমানবন্দরে না থাকাই আশীর্বাদ হয়ে দেখা দেয়। তাদেরকে একটি র“মে বসিয়ে রাখা হয়। ঐ সময় বিমানবন্দরের টেলিফোন সেটের দিকে চোখ পড়ে ফাহমীদা রশীদ চৌধুরীর। তিনি টেলিফোন অপারেটরের কাছে ছুটে যান। অপারেটর পূর্ব পরিচিত ছিলেন। তিনি দুইদিন ধরে চলে আসা ঘটনা তাকে খুব দ্র“ত বলেন এবং ফোন ব্যবহারের অনুরোধ করেন। ‘যা করবার দ্র“ত কর“ন’Ñ অপারেটরের এমন কথায় যেনো নিঃশ্বাস ফেলেন ফাহমীদা রশীদ চৌধুরী। ঢাকার তৎকালীন নিকটজন প্রভাবশালী ব্যক্তিদের ফোন করে তাদের বিমান বন্দরে নিয়ে আসার কথা অবগত করেন। তড়িঘড়ি করে তারা ছুটে আসেন বিমান বন্দরে। বিষয়টি এরইমধ্যে অবগত হয়ে যান ইউরেপীয় বন্ধুরাও। বিষয়টি জানাজানি হয়ে যাওয়ার কারণে পাকিদের পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। তাদের উদ্দেশ্য ছিলো আমীনূর রশীদ চৌধূরীকে সপরিবারে ক্যান্টনম্যান্টে নিয়ে গিয়ে হত্যা করার।
প্রবাসে স্বাধীকার দাবীতে সোচ্চার
জেনেভায় আই এল ও সম্মেলনে যোগদান শেষে আমীনূর রশীদ চৌধূরী লন্ডনে চলে যান। সেখানে গিয়ে বাঙালীদেরকে ঐক্যবদ্ধ করতে কাজ শুর“ করেন। শুধু ঐক্যবদ্ধ করার কাজেই ব্যস্ত ছিলেন নাÑ লন্ডনে প্রথম অস্থায়ী বাংলাদেশ মিশন অফিস খোলার ব্যাপারে অনন্য ভুমিকা পালন করেন তিনি। এছাড়াও সেখানে অর্থ সংগ্রহের কাজে মনোনিবেশ করেন। অর্থ সংগ্রহের জন্য তৎকালীন সময়ে ভারতে অবস্থানরত প্রখ্যাত লোকসঙ্গিত শিল্পী নির্মলেন্দু চৌধুরীকে ইংল্যান্ডে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে অগ্রনী ভূমিকা পালন করেন। তাছাড়াও তিনি লন্ডনে অবস্থানরত পরিচিতজনদের দ্বারে দ্বারে গিয়েছেন ছঁরহংমধঃব এ বাংলাদেশে হাই কমিশনের নিজস্ব ঋৎববযরষফ ভবন ক্রয়ের অর্থ সংগ্রহের জন্য। নিজেও চঁাদা দিয়েছেন সামর্থ অনুযায়ি। সেখান থেকে ভারতের জনপ্রিয় সাপ্তাহিক দেশ পত্রিকায় একশ ত্রিশ রাতের এক রাত নামে নিবন্ধে তঁার বন্দিকালীন নির্যাতনের কথা তুলে ধরেন। যা সে সময় ব্যাপক আলোচিত হয়।
আমিনূর রশীদ চৌধরীর সহধর্মিনী ফাহমীদা রশীদ চৌধুরী বলেন, আমরা ঘুরে ঘুরে আমরা চঁাদা সংগ্রহ করি। সে সময় অর্থ সংগ্রহের জন্য প্রখ্যাত লোকগানের শিল্পী নির্মলেন্দু চৌধুরীকে লন্ডনে আনা হয়। লন্ডনে একাধিক অনুষ্ঠানে সুরের মুচ্র্ছনায় দর্শকদের মাতিয়ে রাখেন তিনি। এই সঙ্গিতানুষ্ঠানের সমুদয় অর্থ তুলে দেওয়া হয় অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের হাতে।
আমরা যারা প্রবাসে অবস্থান করছিলাম তারা দেশের পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকতাম। আজকের দিনের মতো প্রচার মাধ্যম এতো শক্তিশালী ছিলনা। যোগাযোগের দ্র“ততর পদ্ধতির কোনো যোগাযোগ মাধ্যমও ছিলনা। তবে আমরা মরহুম হুমায়ূন রশীদ চৌধুরীর কল্যানে অনেক খবরই জানতে পারতাম। তিনি যখন ‘দেশ স্বাধীন হতে আর বেশি বাকী নেই বলতেন তখন আমাদের বুকটা ভরে উঠতো। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমরা ভারতে চলে যাই। এবং সেখান থেকে ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ২৯ তারিখ দেশে ফিরি।
অনন্য দেশপ্রেমী
দেশের প্রতি ছিলো তঁার ছিলো অগাদ ভালোবাসা। তাঁর আশা, আকাংখা, স্বপ্ন সবই আবর্তিত হতো সিলেটকে ঘিরে। সিলেট অঞ্চলের ন্যায্য দাবীর প্রশ্নে তিনি ছিলেন আপোষহীন। যেখানেই দেখেছেন সিলেটের স্বার্থের বিপক্ষে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে সেখানেই ছুটে গেছেন। প্রতিবাদ করেছেন, লিখেছেন। একথা বলতে দ্বিধা নেই যে, আজকের সিলেট বিভাগের স্বপ্নদ্রষ্টা ও রূপকার আমীনূর রশীদ চৌধূরী। তঁার দুরদশর্ী চিন্তা ও যথাযথ দাবী উত্থাপন এবং এই দাবীর সপক্ষে আন্দোলনই সিলেট বিভাগ প্রতিষ্ঠার ভীত রচনা করে। আর ধারাবাহিকভাবে চলে আসা এই আন্দোলনের ফসল আজকের বিভাগ। সিলেটে বিভাগ প্রতিষ্ঠার অগ্রসৈনিক হিসেবে আমীনূর রশীদ চৌধূরীর অবদান কালের ক্যানভাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
আমিনূর রশীদ চৌধূরী প্রথমে সিলেটকে প্রদেশ করার দাবী উত্থাপন করেন। কালপরিক্রমায় এই দাবীই বিভাগ আন্দোলনে রূপ নেয়। তিনিই প্রথম পাক সরকারের কাছে এ দাবীটি উত্থাপন করেন। আমীনূর রশীদ চৌধূরী শুধু এই দাবী উত্থাপন করেই ক্ষান্ত হননি; এর সপক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করেন সরকারের কাছে। সিলেটে প্রদেশ গঠনের দাবী কেন যুক্তসঙ্গত তাও তিনি তুলে ধরেন। দাবী জানানোর পাশাপাশি আমীনূর রশীদ চৌধূরী এর পক্ষে জনমত গড়ে তোলার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখেন। সাপ্তাহিক যুগভেরীতে প্রদেশের দাবী জানিয়ে একের পর এক লিখতে থাকেন প্রবন্ধ-নিবন্ধ। সেই সাথে সম্পাদকীয় লেখাও অব্যাহত রাখেন। তঁার ক্ষুরধার লেখনীতে জনমত সৃষ্টি হয়। বিভিন্ন ফোরাম থেকে তঁার দাবীর সপক্ষে সমর্থন জানানো হয়। বক্তব্য বিবৃতি দিয়ে প্রদেশ প্রতিষ্ঠার দাবীকে আন্দোলনে রূপান্তরের প্রক্রিয়া চালাতে থাকেন নেতৃস্থানীয়রা। সময়ের সাথে সাথে সেই আন্দোলনও তীব্রতর হতে থাকে। অবশেষে ১৯৯৫ সালে সিলেটকে বিভাগ হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
চা-শিল্পের উন্নয়নে ভূমিকা
বাংলাদেশের চা শিল্পের উন্নয়নে আমীনূর রশীদ চৌধূরীর অবদান অতূলনীয়। বিশেষ করে ছোট ছোট বাগান রক্ষার ক্ষেত্রে তঁার ভূমিকা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। চা-শিল্পের দুর্দিনে চা-বাগানসমূহ রক্ষায় সরকারের সাথে দেন দরবার থেকে শুর“ করে সকল রকমের প্রচেষ্টা চালিয়েছেন তিনি। বাগানগুলোতে যখন নানা টানাপোড়েন চলছিলো তখন তার দূরদশর্ী চিন্তুা ও ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় সফলতার বন্দরে পৌছেন বাগান মালিকরা। ক্ষুদ্রকায় চা বাগানগুলোর প্রতি তার ভালবাসার অন্ত ছিলনা। শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষার ব্যাপারে তিনি ছিলেন আপোসহীন।
চলিশের দশকের শেষ দিকে সিলেটের প্রধান অর্থকরী পণ্য চা শিল্পে ভয়াবহ দুর্দিন উপনীত হয়। ১৯৪৬ সালের কলিকাতা হত্যাযজ্ঞের অজুহাতে পাকিস্তান সরকার সেখানকার নিলামে অংশ নেওয়া থেকে বিরত থাকে। আমীনূর রশীদ চৌধূরী কলকাতার নিলামে অংশ নেওয়ার জন্য পাকিস্তানের বাণিজ্য মন্ত্রী ফজলুর রহমানকে পরামর্শ দিলে তিনি এতে কর্ণপাত করেন নি। যার ফলে সংকুচিত হয়ে আসে চায়ের বাজার। এই প্রেক্ষাপটে ছোট ছোট বাগান সমূহের মালিক-ম্যানেজারগণের এক সম্মেলন আহ্বান করেন। সম্মেলনস্থল হিসেবে নির্বাচন করা হয় জ্যোতি মঞ্জিলকে। পরিস্থিতির বিষদ আলোচনা পর্যালোচনাক্রমে একটি পৃথক সমিতি গঠনের সিদ্ধান্ত গৃহিত হয় এবং ‘পাকিস্তান ন্যাশনাল টি এসোসিয়েশন’ নামে অধ্যক্ষ মি. মজদউদ্দিন আহমেদ চৌধুরীকে চেয়ারম্যান, বেগম সিয়াজুন্নেসা চৌধুরীকে ভাইস চেয়ারম্যান, আমীনূর রশীদ চৌধূরী অবৈতনিক সচিব এবং বিনয় কৃষ্ণ দাসকে সহকারী অবৈতনিক সচিব ও অন্যান্য বাগানের প্রতিনিধিগণকে সদস্য করে একটি সমিতি গঠন করা হয়। সমিতির কার্যালয় নির্ধারণ করা হয় জ্যোতি মঞ্জিলকেই। আবাদী প্রতি একর ভিত্তিক চাঁদা নির্ধারিত হলেও সমিতির ব্যয়ভারের সিংহভাগ রশীদ পরিবারের মালিকানাধীন আমীনাবাদ ও নূরজাহান চা বাগানকেই বহন করতে হতো।
দাবী দাওয়া এবং দেন-দরবার করেও যখন আমিনূর রশীদ চৌধূরী অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌছতে পারছিলেন না তখন পত্র-পত্রিকায় এনিয়ে লেখা-লেখি শুর“ করেন। পাকিস্তান অবজার্ভার পত্রিকায় যুক্তিনিষ্ঠ ক্ষুরধার প্রবন্ধ প্রকাশিত হতে থাকে। এরফলে বিপর্যস্ত চা বাগান সমূহের সমস্যাদি প্রশাসনের সর্বস্তরে পৌছে। কৃষি বাণিজ্য অর্থÑ এই তিন বিভাগের সমন্বয় ঘটানো দুষ্কর, তদুুপরি চা কেন্দ্রে শাসিত পণ্য। ফলে, পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার নীলগিরির এক চা বাগান থেকে ড. ব্র্যাবান্ট নামে আশ্রিত একজনকে চা বিশেষজ্ঞ রূপে নিয়ে আসেন উদ্ভূত পরিস্থিতিতে করনীয় নির্ধারনের লক্ষ্যে মতামাতের জন্য। তিনি প্রতিটি বাগান পরিদর্শন করে প্রতিবেদনে সুপারিশ করলেন, ছোট ছোট বাগান বন্ধ করে এই পরিমাণ জমি এজেন্সী হাউস পরিচালিত বিদেশী চা বাগান কোম্পানীকে দিয়ে দেওয়া হোক। তাহলে উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে।’ তার এই পরামর্শে প্রতিবাদের ঝড় বয়ে যায়। বাধ্য হয়ে তাকে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। আর এই প্রতিবাদের মূলে ছিলেন আমিনূর রশীদ চৌধূরী।
আমিনূর রশীদ চৌধূরী টি বোর্ডের সদস্য ছিলেন। পাকিস্তান টি এসোসিয়েশনের মনোনীত প্রতিনিধি হিসেবে জেনেভার আই.এল.ও সম্মেলন থেকে শুর“ করে বহু জায়গায় দেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। যেখানেই গেছেন সেখানেই এই শিল্পের স্বার্থ নিয়ে কথা বলেছেন। ন্যায্য দাবী আদায়ে তঁার কন্ঠস্বর ছিলো সোচ্চার।
সাহিত্য সংস্কৃতিতে অবদান
ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সময় গণসঙ্গীতের মাধ্যমে যে জাগরণের সৃষ্ঠি হয় তার ঢেউ বেশিদিন টিকে থাকেনি। দেশভাগের পর পাকিস্তান নামের রাষ্ট্রযন্ত্র রেডিওতে রবীন্দ্র নিষিদ্ধ করার মধ্য দিয়ে জানিয়ে দিয়েছিলো প্রগতির পথে পথ চলা যাবেনা। কিন্তু সরকারের সেই চোখ রাঙানীকে উপেক্ষা করে যে বা যারা নিজ আদর্শে তৎকালীন সময়ে অবিচল ছিলেন তাদের মধ্যে আমীনূর রশীদ চৌধূরী ছিলেন অগ্রণী। বিধি নিষেধ উপেক্ষা করে বাঙালীর প্রাণের সঙ্গীতকে তিনি লালন করেছেন, সেই সাথে রীবন্দ্র সঙ্গিতের প্রচারণাও চালিয়েছেন অকুতোভয় সেনানীর মতো।
তঁার সেই ভুমিকা ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ হয়ে আছে। ‘ভেঙে যাবেন কিন্তু মচকাবেন না’-এটা ছিলো তঁার জীবনের অন্যতম আদর্শ। যে সংকল্প নিয়ে কাজ শুর“ করতেন তা থেকে তিনি কখনো বিচ্যুৎ হননি। শত প্রতিকূলতাও তঁাকে লক্ষ্যচ্যুৎ করতে পারেনি। জীবনবোধ সম্পর্কে তঁার উপলব্ধি এতটাই প্রখর ছিলো যে তৎকালীন সময়ের অগ্রজরাও সে কারণে তঁাকে সমীহ করে চলতেন। আর অনুজদের কাছে ছিলেন জীবন্ত কীংবদন্তি, আদর্শের প্রতিরূপ। মেধা মননের সংমিশ্রণেই তিনি হয়ে উঠেছিলেন অনন্য, সবার প্রিয়।
আজকের দিনে নবীন-প্রবীনের মেলবন্ধন তেমন একটা চোখে পড়েনা! সে দুরত্ব যেনো দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু আমরা যদি ষাটের দশক থেকে শুর“ করে আশির দশক পর্যন্ত সময়টাকে পর্যালোচনা করি তাহলে সহজেই বর্তমান সময়ের সাথে অতীতের ব্যবধান উপলব্ধি করতে পারবো। সিলেটের প্রেক্ষাপটে এই সময়টাতে আমীনূর রশীদ চৌধূরী সাহিত্যিকদের কাছে হয়ে উঠেছিলেন বটবৃক্ষ। তঁার ছায়াতলেই বেড়ে উঠেছেন অনেক কবি সাহিত্যক। আমিনূর রশীদ চৌধূরীর দেখিয়ে দেওয়া পথে পথ চলে অনেকে নাম যশ খ্যাতি অর্জন করেছেন।
উদীয়মান সাহিত্যিকদের আমীনূর রশীদ চৌধূরী উদ্বুদ্ধ করতেন ধাবমান পথে অগ্রসর হওয়ার জন্য। শুধু তাই নয় তাদের রচনা প্রকাশের ক্ষেত্রেও উদ্যোগ নিতেন। নিজ মালিকানাধীন লিপিকা প্রিন্টার্স থেকে কতো যে সাহিত্যের ছোট কাগজ, ম্যাগাজিন প্রকাশ করেছেন কোনোরূপ অর্থ না নিয়ে তা বলে শেষ করা যাবেন। শুধু তর“ণদের সাহিত্য কর্মের বই-ই সে সময় লিপিকা প্রিন্টার্স থেকে বের হয়নি বের করেছেন অনেক প্রথিতযশা লেখকদের বইও। সাহিত্য-সংস্কৃতির পৃষ্টপোষকতার জন্য তার কাছে কেউ এসে খালি হাতে ফিরে গেছেন এমন নজির নেই। যাকে যেভাবে সম্ভব সেভাবেই সহযোগিতা করেছেন। আমীনূর রশীদ চৌধূরীর মৃত্যুর পর সিলেটের সাহিত্যঙ্গনে তঁার পদচারণা কতটা বলিষ্ট ছিলো সে সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। শত ব্যস্ততার মাঝেও সাহিত্যের প্রতি তঁার অগাধ ভালবাসা অনেকটা বিস্ময়কর। এক্ষেত্রে তাকে তাঁর মায়ের উত্তরাধীকার বললে অত্যুক্তি হবেনা। আমিনূর রশীদ চৌধূরীর জননী রাজিয়া রশীদ চৌধুরী ছিলেন একজন কবি।
আমিনূর রশীদ চৌধুরীর সম্পাদনাকালীন সময়ে যুগভেরীকে ঘিরে প্রতি সপ্তাহে সাহিত্যিকদের আড্ডা বসতো জ্যোতি মঞ্জিলে অথবা যুগভেরী কার্যালয়ে। সাহিত্য পাঠের আসর মাতিয়ে তুলতেন নবীন-প্রবীন সাহিত্যিকরা। সেইসব আসরে মধ্যমণি হিসেবে উপস্থিত থাকতেন আমীনূর রশীদ চৌধূরী। আসরগুলোতে তার রসত্বাবোধের আলোচনা নতুন মাত্রা যুক্ত করতো।
শুধু তাই নয়, সিলেট প্রেসক্লাব ও মুসলিম সাহিত্য সংসদের অনেক সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে জ্যোতি মঞ্জিলে। সাহিত্য সংস্কৃতসেবীদের কাছে জ্যোতি মঞ্জিল ছিলো প্রাণকেন্দ্র। জ্যোতি মঞ্জিলকে আবর্তিত করেই বিকশিত হয়েছে এ অঞ্চলের সাহিত্য সংস্কৃতি।
আমীনূর রশীদ চৌধূরীর জীবনের উলেখযোগ্য অংশ কেটেছে কবি-সাহিত্যিক ও শিল্পীদের ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে। কবি কাজী নজর“ল ইসলাম, তারাশংকর, বনফুল, সজনীকান্ত দাস প্রমুখের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য তিনি লাভ করেছেন। প্রখ্যাত ভাষাবিদ ও পণ্ডিত সৈয়দ মুজতবা আলীর সঙ্গে সম্পর্ক ছিল খুবই ঘনিষ্ঠ। বিশিষ্ট কবি বেগম সুফিয়া কামাল বোনের অকৃপণ স্নেহ দিয়েছেন তাকে।
শিক্ষাক্ষেত্রে অবদান
পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি সময়ের কথা। দেশভাগ পরবতর্ী সময়ে মধ্যবিত্ত সমাজে চলছিল নানা টানাপাড়েন। অর্থনৈতিক অনগ্রসরতার কারণে অনেক পরিবারের পক্ষে তাদের ছেলেমেয়ের লেখা-পড়ার ব্যয় নির্বাহ করা দূরূহ ব্যাপারে পরিণত হয়। ঠিক সে সময় আলোকিত সমাজ বিনির্মাণের অভিপ্রায় নিয়ে মানুষের কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত করেন আমিনূর রশীদ চৌধূরী। তবে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে নয়, নীরবে-নিভৃতে তিনি সহায়তা করেন দারিদ্রতার অক্টোপাসে বন্দি পরিবারগুলোকে। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত মানুষের কল্যাণে তার সহায়তার হাত ছিল প্রসারিত।
আমীনূর রশীদ চৌধূরীর এই দানের কথা হয়তো অজানাই থেকে যেতো; যদি হেমাংশু শেখর ধর তার লেখা নিবন্ধ ‘যা দেখেছি, যা শুনেছি’-তে তা উলেখ না করতেন। অধুনালুপ্ত সাপ্তাহিক দেশবার্তা সম্পাদক হিমাংশু শেখর প্রথম জীবনে আমিনূর রশীদ চৌধূরীর মালিকানাধীন বাগানগুলোর হেড অফিসে টাইপ রাইটারের কাজ করতেন। সেই সুবাদে তিনি শিক্ষাক্ষেত্রে আমিনূর রশীদ চৌধূরীর অর্থনৈতিক সহায়তা প্রত্যক্ষ করেন। তঁার ভাষায়Ñ প্রতিদিন ২০/২৫ খানা চিঠি টাইপ করতে হতো। এর মাঝে আট/দশ খানা ব্যবসায়ীক চিঠি, ছয় খানা কোথায় রকমারী রঙ এবং গোলাপ ও অন্যান্য মৌসুমী ফুল ও ফলের চারা এবং বীজ পাওয়া যায় ইত্যাদি ছাড়া সমাজ কর্মের ও ব্যক্তিগত পত্রাদি থাকত। মাসের প্রথম সপ্তাহে আরো ১৫/১৬ খানা বাড়তি চিঠি টাইপ করতে হতো। সেগুলো সিলেট শহরের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ও ঢাকার কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধানকে লিখা চিঠি। ঐ চিঠিগুলোতে ‘অমুক’ ‘অমুক’ ছাত্রছাত্রীর এ মাসের বৃত্তি বাবত ‘এত’ টাকা পাঠানো হলো লিখা থাকতো।
শহরের চিঠি ও টাকা পিয়ন দিয়ে আসতো- বাইরের গুলো ডাকযোগে যেতো। ১৯৫৫ সাল থেকে ১৯৫৮ইং পর্যন্ত চার বছর তিনি যে বৃত্তি দিয়েছেন তার হিসেব তৎকালীন টাকায় সাড়ে তিন থেকে চার লক্ষ টাকার কম নয়। যারা বৃত্তি পেতো তাদের মাঝে আমি মাত্র দুই জনকে ব্যক্তিগত ভাবে জানতাম। বাকী অন্যান্যদের সাথে কাগজে কলমে ছাড়া সাক্ষাৎ পরিচয় ছিল না। যে দুজনকে জানতাম তাদের একজন এম এ পাশ করে কিছূদিন তৎকালীন ‘পাকিস্তান অবজারভারের’ সহ সম্পাদকের কাজ করে বর্তমানে আমেরিকায় একটি পত্রিকার সহ সম্পাদক হিসেবে নিয়োজিত থেকে সেখানেই স্বপরিবারে বসবাস করছেন। অপরজন আসামের কাছাড় প্রেসক্লাবের সভাপতি, সাপ্তাহিক ‘বরাক’ পত্রিকার সম্পাদক শ্রীঅতীন দাশ। আমীনূর রশীদ চৌধূরীর অর্থে ও সাাহয্যে অনেকেই জীবন সুপ্রতিষিঠত হয়েছেনÑ এর মধ্যে সরকারী উচ্চ পদস্থ আমলাও রয়েছেন। মজার কথা, তার ঐ দান তিনি, তার স্ত্রী, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান ও যাকে বৃত্তি দেয়া হতো তিনি ছাড়া অন্য কেউ জানতেন না।’
অর্থের অভাবে যখন মদন মোহন কলেজের দুরাবস্থা, মহিলা কলেজ বন্ধ হবার উপক্রম, বু-বার্ডেরও একই অবস্থা তখন আর্থিক সহায়তা করতে কার্পন্য বোধ করেন নি আমিনূর রশীদ চৌধূরী। তিনিসহ অন্যান্য বিদ্যুৎসাহীদের দানশীলতায় রক্ষা পায় আজকের দিনে প্রতিষ্ঠিত এই স্কুল কলেজগুলো।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে সোচ্চার
সিলেটে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আন্দোলনেও সোচ্চার ছিলেন আমিনূর রশীদ চৌধূরী। সিলেটে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবীতে তঁার মতো আর কেউ সোচ্চার ছিলো না। সিলেটে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য এমন কোনো পন্থা নেই যা তিনি অবলম্বন করেন নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবীতে তঁার ধারাবাহিক আন্দোলন আজকের বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সোপান তৈরী করে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে তঁার ভূমিকার প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করতে আমীনূর রশীদ চৌধূরীর মৃত্যুর পর প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হলের নামকরণ তঁার নামে করার দাবী উত্থাপন করা হয় সিলেট প্রেসক্লাবের পক্ষ থেকে। কিন্তু আজাবধি সেই দাবীর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেনি বিশ্ববিদ্যালয় কতর্ৃপক্ষ।
শিক্ষা-দীক্ষার প্রসারে স্কুল এবং কলেজ সমূহের আর্থিক অনুদান ছাড়াও আমীনূর রশীদ চৌধূরী যে কত শত শত গরীব মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীকে শিক্ষালাভে সাহায্য করেছেন তা সিলেটের অনেক শিক্ষানুরাগীরই জানা আছে। তবে তার দান-দাক্ষিণ্য লোক দেখানো কোন আনুষ্ঠানিকতায় সীমাবদ্ধ ছিল না এবং ব্যক্তিগতভাবে তিনি তা অপছন্দ করতেন।
তঁার সেই অবদানের কথা লেখক ফার“ক আহমদ ভাষায়Ñ‘সিলেট বিশ্ববিদ্যালয় আন্দোলনের কথা মনে হইলেই মরহুম আমীনূর রশীদ চৌধূরীর কথা স্বাভাবিকভাবেই মনে পড়ে।… বিশেষ করিয়া ১৯৬২-৬৪ সনের আন্দোলনের পটভূমিতে মরহুম চৌধুরী যে নিজের সংবাদপত্র এবং সাংবাদিকতায় বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন তাহা সমসাময়িককালের সকল আন্দোলনরত ছাত্র-জনতা কৃতজ্ঞচিত্তে মনে রাখিবেন বলিয়া আমার বিশ্বাস। …১৯৬৪ সনে আমি নিজে এবং আরও কতিপয় সহযোগী তৎকালিন বিশ্ববিদ্যালয় আন্দোলনের বিষয়ে বিস্তারিত কর্মসূচি নিয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হইতে সিলেটে আসি এবং আমাদের উক্ত আগমনী সংবাদ আন্দোলনের বৃহত্তর স্বার্থে মরহুম চৌধূরী ‘লিড নিউজ’ হিসাবে যুগভেরীর প্রথম কলামেই পরিবেশন করেন। আমাদের আন্দোলনের তীব্রতা উপলব্ধি করিয়া তৎকালিন পাকিস্তান সরকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য্য ডঃ এম.ও গণির নেতৃত্বে সিলেটে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য একটি কমিশন প্রেরণে বাধ্য হয়। মরহুম আমীনূর রশীদ চৌধূরী কাঁধে ক্যামেরা ঝুলাইয়া স্বয়ং আমাদের সঙ্গে এম.সি কলেজের বিভিন্ন অংশ ঘুরিয়া কমিশনের সদস্যগণকে সিলেটের বিশ্ববিদ্যালয়ের উপযুক্ততা প্রমাণের চেষ্টা করেন এবং নিজের সাপ্তাহিক পত্রিকাদ্বয়ের সিলেটে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনে কবিগুর“র সিলেটের শ্যামল পারিপার্শ্বিক অবস্থার বর্ণনা এবং মিঃ জিন্নাহর বর্ণনা এবং মিঃ জিন্নাহর প্রতিশ্রুতি ইত্যাদির বহু ঐতিহাসিক তথ্য সম্বলিত সম্পাদকীয় লিখিয়া আন্দোলনকে বাস্তবে রূপাদানের চেষ্টা করেন।’
তঁার সেই নিরলস প্রচেষ্টা সিলেটে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ভিত তৈরীতে অনন্য ভূমিকা পালন করে। শিক্ষা আন্দোলনে আমীনূর রশীদ চৌধূরীর এই অবদান কালের ক্যানভাসে অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
সাংবাদিকতার দিকপাল
১৯৬০ সালে বঞ্চিত সিলেটবাসীর মুখপত্র যুগভেরী আমিনূর রশীদ চৌধূরীরর সম্পাদনা ও মালিকানায় চলে আসে। সেই থেকে যুগভেরী ও আমীনূর রশীদ চৌধূরী এ-দুটি নাম একাকার হয়ে গেছে। যুগভেরী যতটা নিজ নামে পরিচিত, ঠিক ততটাই পরিচিত আমীনূর রশীদ চৌধূরীর পত্রিকা হিসেবে। সংবাদপত্রের মাধ্যমে যে জনসেবা করা যায় তার উদাহরণ সৃষ্টি করে গেছেন তিনি। বলা হয়ে থাকেÑ সাংবাদিকদের বন্ধু নেই। অথচ সাংবাদিকতা করেই তিনি জনগণের বন্ধুতে পরিণত হয়েছিলেন। সিলেটের জনগণ তাকে ‘সিলেটবন্ধু’ হিসেবে অবিহিত করে থাকে।
আমীনূর রশীদ চৌধূরীর সাংবাদিকতায় হাতেখড়ি হয় পিতৃ মালিকানাধীন সাপ্তাহিক যুগভেরী পত্রিকার মাধ্যমে। পিতা আব্দুর রশীদ চৌধুরীর আদেশ পালন করতে গিয়ে যুগভেরীর নামকরণ করেন তিনি। পরবতর্ীতে একটি ঐতিহাসিক মুহুর্তে কলম হাতে তুলে নেন। বিপবী অসিত ভট্টাচার্য্যের কাছ থেকে অস্ত্রের সন্ধান করতে গিয়ে নাম লেখান সাংবাদিকতায়। তবে তা ছিল স্বল্পকালীন সময়ের জন্য। কিন্তু এ থেকে সাংবাদিতার প্রতি তঁার যে আগ্রহ সৃষ্টি হয় তা-ই তাকে পরবতর্ীকালের কিংবদন্তিতে রূপান্তরিত করে। এক্ষেত্রে পারিবারিক পরিবেশও সহায়ক হয়েছিল।
১৯৩৪ সালে সাংবাদিকতা শুর“ করলেও সাংবাদিকতার মূল ধারার সাথে আমীনূর রশীদ চৌধূরী যুক্ত হন ষাটের দশকে। এসময় সাপ্তাহিক যুগভেরী ও ইস্টার্ন হেরাল্ড এ দুটি পত্রিকার সম্পাদনা ও মালিকানা গ্রহণ করতে হয় তাঁকে। বিপবী হিসেবে যে আমিনূর রশীদ চৌধূরী সময়ের প্রয়োজনে সাংবাদিকতাকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন সেই সাংবাদিকতাকেই একদিন জীবনের অন্যতম অনুসঙ্গ হিসেবে বেছে নিতে হবে তা তিনি কোনোদিন কল্পনাও করেন নি। বিশেষ করে যেখানে পুরো শৈশব লালিত হয়েছেন ইংরেজ দম্পত্তির তত্বাবধানে এবং ইংরেজী ভাষায়ই শুর“ হয়েছে তঁার কথা বলা। সে কারণে বাংলাভাষায় প্রকাশিত পত্রিকার সম্পাদক হবেন একদিন এমনটি ছিল তঁার ভাবনারও বাইরে। কিন্তু পরিণত বয়সে বাংলা ভাষায় শক্তিশালী গঁাথুনী নিজের মেধা ও কঠোর পরিশ্রমের বদৌলতে করায়ত্ব করতে সক্ষম হন তিনি।
শিল্প-সাহিত্য সংস্কৃতি, রাজনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে ব্যস্ত থাকা আমিনূর রশীদ চৌধূরীকে অনেকটা আকস্মিকভাবেই এই দুটি পত্রিকার দায়িত্ব গ্রহণ করতে হয়। আমিনূর রশীদ চৌধূরী ছিলেন মাতৃভক্ত। একমাত্র আম্মা সিরাজুন্নেসাই তাঁকে নিবৃত করতে পারতেন। এছাড়া তিনি যে কাজে মনস্থির করেছেন তা করা থেকে তাঁকে বিরত রাখার সাধ্য কারো ছিলনা। আম্মার নির্দেশেই যুগভেরী ও ইস্টার্ন হেরাল্ড পত্রিকার দায়িত্ব গ্রহন করেন আমিনূর রশীদ চৌধূরী।
১৯৬১ সালের ৩০ নভেম্বর বুধবার থেকে সাপ্তাহিক যুগভেরীর নতুন করে পথ চলা শুর“ হয়। আর ৩ নভেম্বর থেকে প্রকাশিত হয় ইস্টার্ণ হেরাল্ড। মাতৃ নির্দেশনায় এ দুটি পত্রিকার অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখার শপথ গ্রহণ করেন আমীনূর রশীদ চৌধূরী। যেহেতু আম্মা সিরাজুন্নেসা পত্রিকা দুটি চালানোর দায়িত্ব দিয়েছেন সেহেতু পত্রিকা দুটি শুধু বের করলেই চলবে না, পত্রিকাগুলোর ঐতিহ্য পুনর“দ্ধারের পাশাপাশি সেগুলোকে জনসেবার মাধ্যম হিসেবে কাজে লাগানোর সংকল্প করেন তিনি। এনিয়ে সহধর্মিনী ফাহমীদা রশীদ চৌধুরীর সাথে কথা বলেন এবং তাকেও সমানভাবে দায়িত্ব পালন করতে হবে বলে জানিয়ে দেন। ফাহমীদা রশীদ চৌধুরী এব্যাপারে তাকে সাধ্যমত সহযোগিতা করার চেষ্টা করবেন বলে আশ্বস্ত করেন। শুর“ হয় সাপ্তাহিক যুগভেরী ও ইষ্টার্ন হেরাল্ড’র নতুন করে পথচলা। স্বল্প সময়ের মধ্যেই যুগভেরীকে আলোচনার কেন্দ্র বিন্দুতে নিয়ে আসেন আমীনূর রশীদ চৌধূরী। সেই সাথে অব্যাহত থাকে ইষ্টার্ন হেরাল্ডের প্রকাশনা। কিন্তু দু’টি পত্রিকার মধ্যে সিলেটবাসী সাপ্তাহিক যুগভেরীকে নিজেদের সুখ-দুখের সাথী হিসেবে বেছে নেয়। বাড়তে থাকে যুগভেরীর প্রচার সংখ্যা। শুধু সিলেট নয়; সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে যুগভেরী এবং তা জনতার মুখপত্রে পরিণত হয়।
মায়ের আদেশ তিনি অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে এবং ১৯৭৪ সালে সরকার কতর্ৃক মাত্র চারটি পত্রিকা রেখে দেশের সকল পত্রিকা প্রকাশের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হলে যুগভেরীর প্রকাশনাও বন্ধ হয়ে যায়। জীবনের সবচেয়ে বড় আঘাত তিনি এ-কারণেই পেয়েছিলেন। যুগভেরীর প্রকাশনা যেন অব্যাহত থাকেÑআম্মা সিরাজুন্নেসাকে দেয়া কথা সরকারের কারণে বাধাগ্রস্থ হওয়ায় চরম মনোকষ্ট পেয়েছিলেন আমিনূর রশীদ চৌধূরী।২২ আবেগ সংবরণ করতে পারেননি; কেঁদেছিলেন তিনি। দীর্ঘ সাড়ে পঁাচ মাস পর পুনঃপ্রকাশের মধ্যেদিয়ে তার সেই পীড়াদায়ক দিনগুলোর অবসান ঘটে। এরপর তঁার জীবদ্দশায় আর কখনও যুগভেরী প্রকাশনায় ব্যাঘাত ঘটেনি।
যে সময়টাতে আমীনূর রশীদ যুগভেরী ও ইস্টার্ণ হেরাল্ড নিয়মিতভাবে প্রকাশ করেছেন সেই সময় আজকের মত অনুকূল পরিবেশ ছিল না। তা ছিল দুঃসাধ্যও। কিন্তু অসাধ্যকে সাধনের কারিগর ছিলেন আমীনূর রশীদ চৌধূরী। পাকিস্তান আমলে রেডিওতে রবীন্দ্রসঙ্গীত নিষিদ্ধ থাকাবস্থায়ও তিনি ‘যুগভেরী’তে এ নিয়ে সম্পাকীয় লিখেছেন। নিজ বাসভবন জ্যোতি মঞ্জিলে রবীন্দ্র সম্পর্কিত সভা সেমিনার করে এসবের সংবাদও ‘যুগভেরী’তে প্রকাশ করেছেন। দুঃসাহসী ও সত্যের পথে থাকার কারণেই বির“দ্ধ পরিস্থিতিতেও নিজের আদর্শে তিনি ছিলেন অবিচল। জনগণের কল্যাণ সাধনই ছিল তঁার সাংবাদিকতার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। ব্যক্তি স্বার্থে কখনও সাংবাদিকতাকে ব্যবহার করেননি। করার প্রয়োজনও পড়েনি। তিনি নিজেই ছিলেন এক বিশাল মহির“হ।
আমিনূর রশীদ চৌধূরী পদসর্বস্ব সম্পাদক ছিলেন না। প্রকৃত অর্থে সম্পাদক হতে যে সকল গুণাবলী থাকা প্রয়োজন তার সবই ছিল তঁার মধ্যে। নিভর্ীকভাবে পত্রিকা সম্পাদনা করে গেছেন। দেশের স্বার্থ, দশের স্বার্থ ও সমস্যা সবার সামনে তুলে ধরতে তিনি ভয়ভীতি বা শঙ্কাবোধ করতেন না। সিলেটের সমস্যা প্রকাশের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন অকুতোভয়। ’৬৯-এর গণ অভ্যুত্থান ও অসহযোগ আন্দোলনে যুগভেরী এতটুকুও পিছপা হয়নি জনগণের কথা বলা থেকে। এ কারণে তাকে হুমকী-ধমকী দেওয়া হয়েছে। কিন্ত তাতে কোন কাজ হয়নি। দেশের স্বার্থ রক্ষায় তিনি ছিলেন ইস্পাত কঠিন।
সংবাদপত্রের নীতি-আদর্শে অবিচল থাকার পুরস্কারস্বরূপ ১৯৮৫ সালে সাপ্তাহিক যুগভেরী ‘এশিয়ান মাস কমিউনিকেশন রিচার্স অ্যান্ড ইনফরমেশন সেন্টার’-এর নির্বাচনে এশিয়ার সফল পঁাচটি আঞ্চলিক সংবাপত্রের একটি নির্বাচিত হওয়ার গৌরব অর্জন করে।
দৈনিক যুগভেরী, আমিনূর রশীদ চৌধুরীর স্বপ্ন
আমিনূর রশীদ চৌধূরীর স্বপ্ন ছিলো যুগভেরীকে দৈনিকে রূপান্তরের। সে অনুযায়ী কাজও শুর“ করেছিলেন তিনি। কিন্তু শারিরীক অসুস্থতার কারণে তার সেই উদ্যোগ বাস্তবতার মুখ দেখেনি। তবে ১৯৯৩ সালে আমিনূর রশীদ চৌধূরীর স্বপ্নের দৈনিক যুগভেরীর আত্মপ্রকাশ ঘটে। সেই থেকে যুগভেরী দৈনিক পত্রিকা হিসেবে নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে। যুগভেরী তারই আদর্শ লালন করে পথ চলছে।
সিলেট প্রেসক্লাব ও আমিনূর রশীদ চৌধূরী
আমীনূর রশীদ চৌধূরী সিলেট প্রেসক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। বাংলাদেশ সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয়ের সংবাদপত্র বিষয় উপদেষ্টা কমিটিরও সদস্য ছিলেন তিনি। এছাড়াও বাংলাদেশস্থ সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদক সমিতির সভাপতি ছিলেন। আমীনূর রশীদ চৌধুরী জীবদ্দশায় বিভিন্ন মেয়াদে মোট ১১ বছর সিলেট প্রেসক্লাবের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। যে সকল মেয়াদে তিনি প্রেসক্লাবের সভাপতি ছিলেন তা নিম্নে দেওয়া হলোÑ
১৯৬৫-৬৬ সভাপতিÑ আমিনূর রশীদ চৌধূরী, সম্পাদক-হিমাংশু শেখর ধর ও আবদুল মন্নান, ১৯৬৭-৬৮ সভাপতিÑ আমীনূর রশীদ চৌধূরী, সম্পাদক আবদুল মন্নান, ১৯৬৯-৭০ সভাপতিÑ আমীনূর রশীদ চৌধূরী, সম্পাদক শামসুজ্জামান সুফী, ১৯৭১-৭২ সভাপতিÑ আমীনূর রশীদ চৌধূরী, সম্পাদক আবদুল মন্নান, ১৯৭২-৭৭ সভাপতি- আমীনূর রশীদ চৌধূরী, সম্পাদক তবারক হোসেইন, ১৯৮১-৮২ সভাপতিÑ আমীনূর রশীদ চৌধূরী, সম্পাদক আবদুল মালিক চৌধুরী, ১৯৮৩-৮৪ সভাপতিÑ আমীনূর রশীদ চৌধূরী, সম্পাদক মো. মাহবুবুর রহমান।
সিলেট প্রেসক্লাব প্রতিষ্ঠায় তঁার ভুমিকা ক্লাবের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিখা থাকবে। বর্তমানে প্রেসক্লাব যে স্থানে প্রতিষ্ঠিত সেই জমি তিনি সভাপতি থাকাকালীন সময়ে জেলা প্রশাসকের কাছ থেকে লীজ নেওয়া হয়।
দক্ষ আলোকচিত্রী
আলোকচিত্রেও স্বীয় প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন আমীনূর রশীদ চৌধূরী। যে সময়টাতে ক্যামেরা ছিল প্রায় দুর্লভ, সেই সময়টাতে তিনি নানান ঐতিহাসিক মুহূর্তের চিত্রগ্রহণ করেছেন। তাঁর ক্যামেরায় মূর্ত হয়েছে সময়। শুধু স্থিরচিত্র ধারনেই তিনি দক্ষ ছিলেন না, সেই সময়ে মুভি ক্যামেরা পরিচালনায়ও দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ভ্রমণের সুবাদে সেসব দেশের ঐতিহাসিক নিদর্শন ও স্থাপত্যশৈলী ক্যামেরাবন্দি করে এদেশীয় চিত্রপ্রেমীদের মনোক্ষুধা নিবারন করেছেন। তার সেই সময়ের ধারণ করা ছবিগুলো শুধু দেশীয় পরিমন্ডলেই নয় আন্তর্জাতিকভাবেও সমাদৃত হয়েছে, হয়েছে পুরস্কৃত।
চলচ্চিত্র সাংবাদিক মঈন উদ্দিন চৌধুরী ‘বাংলাদেশের প্রথম মুসলিম চিত্রগ্রাহক যুগভেরী সম্পাদক মরহুম আমীনূর রশীদ চৌধূরীর স্মৃতির উদ্দেশ্যে নিবদ্ধে উলেখ করেছেনÑ ‘মুভি ক্যামেরা চালিয়ে চিত্রগ্রহণ তাও আবার সিনেমারÑ আমাদের সিলেটের তৎকালীন সমাজে এটা ছিলো একটা ঝুঁকিপূর্ণ ব্যাপার। এই দুঃসাহসী পদক্ষেপ গ্রহণ করা আমীনূর রশীদ চৌধূরীর পক্ষেই সম্ভব ছিলো। কারণ তিনি ছিলেন উদার, হীনমন্যতাবোধের উর্ধ্বে। কুপমÊুকতার অন্তমুখর্ী মনোভাব তার ছিলো না।’ এখানে একটা বিষয় উলেখ করা আবশ্যক যে, বিজ্ঞান সভ্যতার আজকের এই যুগে স্থিরচিত্র ধারণ অথবা চিত্রগ্রহণ যতটা সহজ এক সময়ে তা ছিল দুরহ ও দুঃসাধ্য ব্যাপার। কোনরূপ প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ না নিয়ে সেই দুরহ ও দুসাধ্যকে সাধন করেছিলেন তিনি।
জীবদ্দশায় যতবারই এ প্রসঙ্গে কথা উঠেছে, প্রশংসা হয়েছে ততবারই স্বনামধন্য ফটোগ্রাফারদের প্রশংসা করে বলেছেনÑ ‘শখের বসে আমি ছবি তুলেছিÑ এতটা প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য আমি নই।’
জীবনাবসান
১৯৭১ সালে পাক হানাদার বাহিনীর নির্যাতনের ফলে আমীনূর রশীদ চৌধূরীর শারীরিক অবস্থার দিন দিন অবনতি হতে থাকে। উচ্চ রক্তচাপসহ নানা ব্যাধি বাসা বঁাধে তার শরীরে। রোগযন্ত্রণা উপেক্ষা করেই তিনি নিজেকে জড়িয়ে রাখেন সত্য ও সুন্দরের সংগ্রামে। ১৯৭৮ সালে তঁার শরীরে ডায়াবেটিক ধরা পরে। একই সময়ে চোখে সমস্যা দেখা দিলে লন্ডনে নিয়ে গিয়ে চোখের চিকিৎসা করানো হয়। ১৯৮২ সালে স্ট্রোক হলে আশঙ্কাজনক পর্যায়ে চলে যায় তঁার শারীরিক অবস্থা। সিএমএইচে তঁাকে ভর্তি করা হয়। ঢাকায় প্রায় মাসাধিককাল চিকিৎসা শেষে শারীরিক অবস্থার কিছুটা উন্নতি হলে নিয়ে আসা হয় সিলেটে তঁার প্রিয় আলয় জ্যোতি মঞ্জিলে। এখানেই কখনও খুব বেশি অসুস্থ খাবার কখনোবা সুস্থ-এভাবে দিন কেটে যাচ্ছিল তঁার। ১৯৮৫ সালের ৩০ আগস্ট না ফেরার দেশে পাড়ি জমান আমীনূর রশীদ চৌধূরী। তঁার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে অবসান হয় একটি যুগের। মৃত্যু রক্ত-মাংসের আমীনূর রশীদ চৌধূরীকে ছিনিয়ে নিলেও আমীনূর রশীদ বেঁচে আছেন তঁার সৃষ্টিতে কর্মে। বেঁচে থাকবেন অগণিতকাল।
সিলেটের প্রাণপুর“ষ আমিনূর রশীদ চৌধূরী
মাহবুবুর রহমান
‘পরিচয়পত্র পেশের জন্য ভারতের রাষ্ট্রপতি ভবনে গিয়েছি। ভি ভি গিরি ও ফখর“দ্দিন আলী আহমদ। ভারতের রাষ্ট্রপতি ও উপরাষ্ট্রপতি। আনুষ্ঠানিকতার একপর্যায়ে ফখর“দ্দিন আলী আহমদ জিজ্ঞেস করলেন, ‘বাংলাদেশের কোথায় আপনার বাড়ি।’ বললাম সিলেটে। তখন তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি কি সিলেটের আমিনুর রশীদ চৌধুরীকে চেনেন?’
ফখর“দ্দিন আলী আহমদের প্রশ্নে গর্বে আমার বুক ফুলে উঠল। স্বয়ং ভারতের উপরাষ্ট্রপতি জানতে চাইছেন। বললাম, ‘আমি আমিনূর রশীদ চৌধুরীর ছোট ভাই।’ বললেন, ‘তুমি আমিনুর রশীদ চৌধুরীর ছোট ভাই!’ রাষ্ট্রীয় আনুষ্ঠানিকতা ভুলে আমাকে জড়িয়ে বললেন, ‘তুমি আমিনের ছোট ভাই। এসো এসো।’
কথাগুলো হুমায়ূন রশীদ চৌধুরীর। ১৯৮৫ সালের ৩০ আগস্ট আমিনুর রশীদ চৌধুরীর মৃত্যুর পর সিলেট প্রেসক্লাবে আয়োজিত শোকসভায় তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী এভাবেই স্মৃতিচারণা করেছিলেন।
ভি ভি গিরির পর ভারতের রাষ্ট্রপতি ফখর“দ্দিন আলী আহমদ আমিনূর রশীদ চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। রাষ্ট্রপতির ব্যক্তিগত আমন্ত্রণে তিনি দিলিও সফর করেছেন।
অবিভক্ত ভারতের স্বাধীনতার পক্ষে ছিলেন আমিনুর রশীদ চৌধুরী। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর ভারতে চলে যাওয়ার জন্য আমিনূর রশীদ চৌধূরীকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। প্রস্তাব দেওয়া হয় তাঁকে কোনো এক দেশে ভারতের রাষ্ট্রদূত করা হবে। সবিনয়ে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে আমিনুর রশীদ চৌধুরী বললেন, ‘আমি সিলেট ছেড়ে কোথাও যাব না।’
সিলেটকে আমিনূর রশীদ মনেপ্রাণে ভালোবাসতেন। জীবদ্দশায় তাই সিলেট ছেড়ে কোথাও তিনি যাননি।
আমিনূর রশীদের মালিকানা ও সম্পাদনাকালে বাংলাদেশের প্রাচীনতম সংবাদপত্র যুগভেরীর স্বর্ণযুগ ছিল। যুগভেরীর লাইনে লাইনে থাকত বঞ্চনা ও অবহেলার শিকার সিলেটের সুখ-দুঃখের কথা। ১৯৪৭ সালে গণভোটের মাধ্যমে সিলেট তৎকালীন পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। তাই দাবি ছিল, সিলেট অঞ্চলকে বিশেষ মর্যাদা দানের। বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় কাঠামোর আওতায় সিলেটকে স্বায়ত্বশাসন দেওয়ার দাবিও উচ্চারিত হয়েছিল যুগভেরীতে।
নিজ অঞ্চলের জন্য নিবেদিত যুগভেরীর এ বিরল সাংবাদিকতার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও মিলেছিল। আশির দশকে জাতিসংঘের আওতাধীন এশিয়ান মাস কমিউনিকেশন এশিয়ায় পাঁচটি সংবাদপত্রকে সাফল কমিউনিটি সংবাদপত্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। যুগভেরী তার মধ্যে অন্যতম ছিল।
আমিনুর রশীদ চৌধুরী ছিলেন একজন নির্ভীক সাংবাদিক। আমার সাংবাদিকতার হাতেখড়ি তাঁর কাছে।
১৯৭৪ সালের একটি ঘটনা মনে পড়ে। সেনাবাহিনীর কিছু উচ্ছৃঙ্খল সদস্য একদিন সিলেট শহরে ব্যাপক গÊগোল করে। সারা শহরের মানুষ ভয়ে তটস্থ। সেদিন আমিনুর রশীদ চৌধুরী ছিলেন ঢাকায়। পরদিন সিলেটে ফেরার পর তাঁর বাসভবন জ্যোতি মঞ্জিলে আসেন সিলেটের রাজনৈতিক নেতারা। যুগভেরীর সম্পাদক সিদ্ধান্ত নেন, এই ঘটনার প্রতিবাদ করতে হবে। আমাদের ডেকে বললেন, যুগভেরীতে গণপিটুনির খবর যাবে বড় করে। আমি ভয়ে আড়ষ্ট। সাহস দিয়ে বললেন, কোনো ভয় নেই, আমি আছি। আরও বললেন, মনে রাখবেন, সাংবাদিকের এক পা বাড়িতে, আরেক পা কারাগারে। খবর বের হলো যুগভেরীর প্রথম পাতা জুড়ে, ‘সিলেটের ইতিহাসে সেনাবাহিনী কর্তৃক ব্যাপক গণপিটুনি’।
সারা শহরে বিরাট চাঞ্চল্য। পত্রিকা বের করে আমি ভয়ে লুকালাম। দুদিন পর ভয়ে ভয়ে যুগভেরী অফিসে এলাম। এসে শুনলাম, আর্মি হেডকোয়ার্টার থেকে একজন মেজর এসে আমিনূর রশীদ চৌধূরীর সঙ্গে দেখা করে আশ্বাস দিয়ে গেছেন, এ গণপিটুনির প্রতিকার হবে। পরে শুনেছি, সেনাবাহিনীর ওই উচ্ছৃঙ্খল ইউনিটকে প্রত্যাহার করে পদব্রজে কুমিলা নেওয়া হয়েছিল।
আমিনূর রশীদ চৌধূরী শুধু নির্ভীক সাংবাদিকই ছিলেন না, ছিলেন উঁচু মানের সাহিত্যিক। খুব ভালো গদ্য লিখতেন। কলকাতার দেশ সাময়িকীতে তাঁর লেখা বের হতো। মরমি গানও লিখেছেন প্রচুর। তাঁর মানবিক গুণাবলি ছিল অতুলনীয়, ছিলেন দানশীল। ডান হাতে দিলে বাম হাত টের পেত না। র“চিবান, সংস্কৃতিমনা আত্মমর্যাদাসম্পন্ন মানুষ আমিনূর রশীদ চৌধূরীর ব্যক্তিত্ব ছিল খুবই আকর্ষণীয়। পাকিস্তান আমলে রবীন্দ্রজয়ন্তী উদ্যাপনের জন্য যখন ভয়ে কেউ এগিয়ে আসত না, তখন তাঁর বাসভবনে জাঁকজমকের সঙ্গে রবীন্দ্রজয়ন্তী উদ্যাপন করতেন। এ জন্য একাত্তর সালে বর্বর পাকিস্তানি হানাদারেরা বন্দিশিবিরে তাঁর ওপর অমানবিক নির্যাতন চালায়।
আমিনূর রশীদ চৌধূরীর সব মানবিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাÊে তাঁর পক্ষ থেকে সমর্থন ও সাহায্য করেছেন তাঁর সুযোগ্য সহধর্মিণী ফাহমীদা রশীদ চৌধুরী। তিনি সিলেটে একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের জন্য আন্দোলনের প্রথম সারির নেতা ছিলেন। এ জন্য তাঁর সম্পাদিত সংবাদপত্র যুগভেরীকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছেন। আশির দশকে সিলেটে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু মরহুম আমিনূর রশীদ চৌধূরীর নামে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হলের নামকরণ আজও হয়নি। এটা আমাকে বিস্মিত করে ও পীড়া দেয়।
স্মৃতির সুধাপাত্রখানি
নৃপেন্দ্র লাল দাশ
নিট্সে বলেন, মানুষ হচ্ছে দীর্ঘ স্মৃতিজীবী প্রাণী। স্মৃতির সঞ্চয় ব্যাংকে সঞ্চিত অর্থের চেয়েও মূল্যবান। স্মৃতির ভেতর দিয়ে মানুষ অতীতকে খুঁজে পায়। এ জন্যেই বলা হয়ে থাকে, স্মৃতি সতত সুখের। এমন কি দুঃখের স্মৃতিও সুখকর। দুঃখের ভেতর দিয়ে হাসি, তা অশ্র“জলে আনন্দেরই নাম লিখে যায়।
আমীনূর রশীদ চৌধূরীর যে স্মৃতি আমার মনে গাঁথা হয়ে আছে, সেটাও আনন্দের নামেই যুক্ত। সেই যুক্ততার কথা একটু নিবেদন করতে চাই।
আমি জন্মেছি শ্রীমঙ্গল থানার এক প্রত্যন্ত গ্রামে। গ্রামটির নাম গন্ধর্বপুর। সেখানে কোন দিন পত্রিকা যেতো না। শ্রীমঙ্গল শহরে বিপুল চৌধুরী ছিলেন সাপ্তাহিক যুগভেরী পত্রিকার নিজস্ব প্রতিনিধি। তঁার কাছেই প্রথম দেখি এই পত্রিকা। আমার অনতি যুবা বয়েসে বড়ই আকাঙ্খা ছিল যুগভেরীতে যেন আমার একটা কবিতা ছাপা হয়, ডাকযোগে অনেক কবিতা পাঠিয়েছি; কোন কবিতা ছাপা হয়নি। মনে নিদার“ণ অসন্তোষ। পত্রিকা সম্পাদককে মনে মনে অভিসম্পাত দেই। তবু অশান্তি যায় না। ষাটের দশকে বাংলা সাহিত্যে অনার্স পড়তে ভর্তি হই এমসি কলেজে। থাকি স্বাধীনতা সংগ্রাম নিকুঞ্জ বিহারী গোস্বামী প্রতিষ্ঠিত উমেশ চন্দ্র নির্মলা বালা ছাত্রাবাসে। একদিন গোসাইদা আমাকে বলেন, চলো জ্যোতি মঞ্জিলে, আম্বরখানায়, আমীনূর রশীদ চৌধূরীর ওখানে। আমি চমকে যাই। যখন জানলাম এই চৌধূরী সাহেবই যুগভেরী সম্পাদক। গেলাম আম্বরখানায়। দেখলাম এক রূপবান পুর“ষকে। ব্যক্তির আভায় দীপ্ত সুপুর“ষ। দু’টি চশমা এক সঙ্গে ব্যবহার করেন। কথা বলেন, সিলেটী আঞ্চলিক ভাষায়। ইংরেজি তাঁর কাছে মাতৃভাষার মতো। জ্যোতি মঞ্জিলের বারান্দায় বসে ছিলাম। বিনয় কৃষ্ণ দাসও এসে বসেছিলেন কাছে।
জানালেন, রবীন্দ্র রচনাবলী ও রবীন্দ্র সঙ্গীতের ক্যাসেট আছে অনেক। যখন রবীন্দ্রনাথের নাম মুখে উচ্চারণ করা যায় না, তখন তিনি সাড়ম্বরে রবীন্দ্র জয়ন্তী পালন করেন। আত্ম-সংস্কৃতিবান একজন মানুষ। নেতাজী সুভাষচন্দ্রের প্রিয়জন। বাংলা সাহিত্যের প্রায় সব বিখ্যাত লেখক তাঁর পরিচিত ও অনেকেই বন্ধুস্থনীয়। তাঁর ব্যক্তিক লাইব্রেরীও ঈর্ষণীয় সংগ্রহে ভরা। জ্যোতি মঞ্জিল আলোকিত হয়ে আছে অসংখ্য ফুলে। ইকর দিয়ে সীমানা প্রাচীর সজ্জিত। দার“ন আকর্ষণীয় এক লোক। পরে তার সঙ্গে ঘনিষ্টতা জন্মে। আমি হয়ে যাই যুগভেরীর একজন নিয়মিত লেখক। পাকস্তানী আমলে এক বর্ষণমুখর দিনে তাঁর বাসায় প্রথম দেখি বহুভাষাবিদ পন্ডিত রম্য লেখক সৈয়দ মুজতবা আলীকে। প্রথম দর্শনে তাঁকে বাঙালি মনে হয়নি। মাথায় বিদেশী টুপি তামাটে গায়ের রঙ। কথা বলেন, বিচিত্র বাচন শৈলীতে। চৌধূরী সাহেবই পরিচয় করিয়ে দেন। তাখন তাঁর নাসিকা ব্যায়াম করার সময় বলে বসলেন না- ভেতরে চলে গেলেন। কথা হয়নি। আমীনূর সাহেবই ব্যাখ্যা করে বলেন, নাসিকা ব্যায়াম হচ্ছে নিদ্রা দেয়া। তিনি তখন ঘুমাতে গেলেন।
সেই সময় সিলেটে এসেছিলেন প্রবোধ কুমার সান্যাল। তাঁর ‘দেবতাত্মা হিমালয়’ বইটি আমি পড়েছিলাম। বইটির ভূমিকা লেখেন জহরলাল নেহের“। আমীন সাহেব তাঁর সঙ্গেও পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন, বলেছিলেন, ‘এই তর“ণ লেখক হাসন রাজা সম্পর্কে আমার পত্রিকায় ১০টি গবেষণা প্রবন্ধ লিখেছে। মফস্বলের হলেও তার চিন্তন মফস্বলী নয়।’
কবি দিলওয়ার সংবর্ধনার সঙ্গেও তঁার সহযোগ ছিল স্মরণ করার মতো। তিনিই সভাপতি হয়েছিলেন। তাম্যপত্রে মানপত্র দেয়ার উদ্যোগী ছিলেন। তাঁর সাহিত্যপ্রীতি ছিল প্রবাদতুল্য। তিনি ‘গানের ডালি’ নামে একটি বই প্রকাশ করেছিলেন; সুরসাগর প্রাণেশ দাস গানগুলির স্মরলিপি তৈরী করে দিয়েছিলেন। লম্বা খাতার মতো বইটি ছাপা হয়েছিল তঁার লিপিকা প্রিন্টার্সে। এককপি বই আমাকেও উপহার দিয়েছিলেন।
এক পরাজিত সৈনিকের মতো মলিন মুখে বসে থাকা ছাড়া আর কিছুই করার নেই। সিলেট বন্ধু আমীনূর রশীদ চৌধূরী, ক্ষমা করবেন।
আপনার বহু স্বপ্ন ছিল কিছু তো পূরণ হয়েছে। জালালাবাদ প্রদেশ আন্দোলনের উচ্চকণ্ঠ উদ্যোগীর স্বপ্ন পূরণ হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে। আপনার নামে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিদ্যালয়ে কোন হল হয়নি সত্য- তবে আপনার স্বপ্ন সত্য হয়েছে। যুগভেরী দৈনিক হয়েছে। সিলেটের প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌঁছেছে আপনার পত্রিকা। আম্বরখানার রশীদিস্তানে আপনার নামে একটি সংস্কৃতি কেন্দ্র হোক এই দাবি জানিয়ে শেষ করি।
অনন্য কিংবদন্তী
দ্বীপেন্দ্র ভট্টাচার্য
সাম্প্রদায়িকতা, গোঁড়ামি ও এগুলোর ভয়াবহ বিচিত্র রূপ এবং ধর্ম উন্মক্ততা আমাদের জনপদ, সমাজ, রাষ্ট্র দেশ, তথা বিশ্ব ভূখÊকে বহুকাল অধিকার করে হিংসা, প্রতিহিংসার জন্ম দিয়ে আমাদের অস্তিত্ব, মানব সভ্যতাকে বার বার হুমকি প্রদান করেছে, করে চলেছে। সাম্প্রদায়িকতা কোন সম্প্রীতি মানে না, সাম্প্রদায়িকতা চোখের চশমকে হরণ করে, মানুষকে অজ্ঞানতার অন্ধাকরে নিমজ্জিত করে।
সাম্প্রদায়িকতার পিশাচগুলো ধর্মের বাতাবরণে তাদের হিংস্র নখর থাবা বিস্তার করে। শিক্ষা, জ্ঞান, বিজ্ঞান যতই সম্প্রসারিত হোক সাম্প্রদায়িকতা নানা ছলা কলায় শিক্ষা, বিজ্ঞানকে পাশ কাটিয়ে অন্ধকূপে সাগর রচনার কূটজাল বিস্তার করেই চলেছে। এর মধ্যে উন্নত চরিত্রের নরনারী জন্মগ্রহণ করে সাম্প্রদায়িকতার বির“দ্ধে কেহ কেহ বক্তব্য রেখেছেন, কেহ কেহ লেখনী ধরেছেন, কেহবা নিজস্ব কর্মপ্রবাহ দ্বারা তাকে প্রতিহত করতে ব্যাপৃত হয়েছেন। সকলকালে সকল জনপদে এমনিভাবে কিছু কিছু লোক সকল প্রতিকূলতা অগ্রাহ্য করে সাম্প্রদায়িকতার বির“দ্ধে প্রতিবাদমুখর হয়েছেন।
আমাদের এ বৃহত্তর জনপদ দীর্ঘদিন অসাম্প্রদায়িক চিন্তা চেতনার লালন ক্ষেত্র ছিল। বিদেশী শাসকগোষ্ঠী স্বীয় স্বার্থকে নিশ্চিত করনের জন্য এতদ্দেশে যে সাম্প্রদায়িকতার বীজ বপন করেছিল তার ধারাবাহিকতা আজ চলছে, বহুরূপে ও বহুমাত্রায়। আমাদের দেশের রাজনীতি দীর্ঘদিন সাম্প্রদায়িকতা বিবর্জিত ছিল। এবং ততদিন ত্যাগী, ধৈর্য্যশীল বীরপুর“ষরা রাজনীতিতে যোগ দিয়ে রাজনীতিকে করেছিলেন প্রতিষ্ঠিত নীতির রাজা হিসাবে। যেদিন থেকে এ গুনটি তিরোহিত সেদিন থেকে রাজনীতিও কলুষিত। রাজনীতি তার কৌলিন্য হারিয়ে কৃত্রিমতা দোষে দুষ্ট হয়ে গিয়েছে। আজ তাই রাজনীতি যেমন নীতি বিবর্জিত তেমনি রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরাও যাদের জন্য রাজনীতি করছেন তাদের সত্যিকারের প্রতিনিধি নন। এ উপমহাদেশের বড় বড় সংগ্রাম, সামাজিক আন্দোলন, রাজনৈতিক আন্দোলন যতদিন অসাম্প্রদায়িক ছিল ততদিন সংখ্যাগরিষ্ঠের ঐকান্তিক সমর্থনও সহানুভূতিতেই সার্থকরূপ লাভ করতে সমর্থ হয়েছিল। এই উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম ও স্বাধীনতা লাভ এর বাস্তব প্রতিফলন। আমাদের সিলেট, আসাম, বাংলা অঞ্চলে বহু রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব অসাম্প্রদায়িক শক্তির বলে বলীয়ান হয়ে নিজেদের এক বিশেষ ক্ষেত্র তৈরী করেছেন, পরিচিতির প্রবাদসম কাহিনী রচনা করেছেন এবং এর ফলশ্র“তিতে কাঙ্ক্ষিত লক্ষে পৌঁছতেও সফলকাম হয়েছিলেন। তেমনি একজন অধুনাকালে রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক, চা-কর, শুদ্ধ সংস্কৃতির ধারক ও বাহক, বিপবাদের অগ্নিচেতনায় উদ্বুদ্ধ, ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের কমর্ী আর বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন, ভাষা-আন্দোলন ও স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশ পুনর্গঠনের একনিষ্ঠ দেশপ্রেমিক কমর্ী, নেতা, সংগঠক আমিনূর রশীদ চৌধূরী। তিনি তাঁর সারাজীবনের কর্মের মধ্য দিয়ে সকল প্রকার সংকীর্ণতার উর্ধ্বে বিচরণ করে গিয়েছেন। সাম্প্রদায়িকতার হলাহল তিনি পান করেন নাই, অপসংস্কৃতির কাছে মাথা নত করেন নাই, স্বার্থপরতার যুপকাষ্ঠে নিজেকে বলীদান করেন নাই। সকল প্রকারের অত্যাচার, নির্যাতন, নিষ্পেষণ তাঁকে লক্ষ্যভ্রষ্ট করতে পারেনি। লোভ, লালসার কাছে আত্মসমর্পণ করে স্বীয় আদর্শ থেকে বিচ্যুত হননি। তিনি সকল কিছু ছেড়েছেন সবকিছু পাওয়ার জন্য। সৃষ্টি করেছিলেন এক নিজস্ব জগৎ, নিজস্ব বলয় ও পরিমÊল। এই বলয়ের বাসিন্দারা সবাই অসাম্প্রদায়িক, সবাই বিবেকবান, সংকীর্ণতা, কূপমূÊকতার উর্ধ্বে এক নিজস্ব ভুবন তৈরি করেছিলেন। আবাল্য এই বলয়ে সাহসিকতার সাথে বিচরণ করে স্বীয় কীর্তি ধ্বজা উড্ডীন করেছিলেন আমীনূর রশীদ চৌধূরী। রূপোর চামক মুখে নিয়ে জন্মগ্রহণ করলেও সে মর্যাদায় সমাসীন ছিলেন না। সাধারণ অবস্থার মধ্যে অবস্থান করে অসাধারণ কাজ করে গিয়েছেন। ত্যাগ আর তিতিক্ষার বলিষ্ঠতায় ইতিহাসে কিংবদন্তী ব্যক্তিত্বের মর্যাদা লাভ করেছেন। গভীর অন্ধকার ও নৈরাশ্যের মধ্যে নিসকম্প অগ্নিশিখার মত তাঁকে পথ দেখাত তাঁর অবিচল বিশ্বাস ও আদর্শ। কোন স্বার্থপরতাই তাঁকে তার আদর্শ থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। তাঁর অগ্নিসম বিশ্বাসই পথ চলার আলোকবর্তিকা হিসেবে কাজ করেছে। আর তারই ফলশ্র“তিতে দুর্গম পথে, দুঃসাহসিকযাত্রায় সচল ছিলেন সারাজীবন। যে পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন সে পরিবারের ছেলেকে কৈশোরে দেশ মাতৃকার মুক্তির জন্য কারাবাস করার কথা নয়। আরাম আয়াস আর বিলাসিতায় জীবন ভাসিয়ে দিতে পারতেন। তাঁর যে সময়ে জন্ম সে সময়ে না হলেও তার এক যুগ পরেই এ উপমহাদেশে সম্ভ্রান্ত হিন্দু-মুসলিম পরিবারগুলোতে সাম্প্রদায়িকতা প্রবেশ করে। সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় সাম্প্রদায়িকতার চর্চা করা হত। অবস্থাসম্পন্নরা সাম্প্রদায়িকতাকে কুলীনতার একটি স্তর বলেই বিবেচনা করতেন। সাম্প্রদায়িক মনোভাব ও কর্মকাÊ তাদের জন্য সমাজে এক বিশেষ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু মিঃ আমীনূর রশীদ চৌধূরীর পারিবারিক ইতিহাসের পরিমÊলে এ আত্মপ্রতারণার মোহতা প্রবেশ করতে পারেনি। শিশুকাল থেকেই ভিন্নমত ও পথের অনুসারীদের সঙ্গে চলার ও সান্নিধ্য লাভের সুযোগে পরবতর্ীকালের জ্যোতি মঞ্জিলের বাসিন্দা শৈশব থেকেই অন্তরের জ্যোতিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠেন। সুশিক্ষিত, স্বশিক্ষিত, র“চিশীল পারিবারিক পরিবেশ সন্তানদেরে অকৃত্রিম মানবতাবাদী ব্যক্তিত্ব হিসেবে গড়ে উঠায় শক্তি, সাহস ও ক্ষেত্র তৈরী করে দিয়েছিল। যার ফলে এ ভূখÊ একজন যুগোপযোগী সমজদার রাজনীতিবিদকে পেয়েছিল, পরিশুদ্ধ সাংস্কৃতিক বলিষ্ঠ কমর্ীকে পেয়েছিল। চিন্তায় কোন কলুষতা ছিল না, কর্মে কোন ভীর“তা ছিল না। সকল সময়ে সঠিক পথে পথ চলেছেন তিনি। আলোর পথের এই অভিযাত্রী সারাজীবন আলোর পথ ধরেই চলেছেন, সার্থকতাও লাভ করেছেন অবলীলায়।
১৯১৫ সালের সতের নভেম্বর তারিখে জন্মগ্রহণকারী আমীনূর রশীদ চৌধূরী ছিলেন একজন চৌকুষ, সুপুর“ষ, সুন্দর চেহারার অধিকারী। অতি সহজেই অন্যের দৃষ্টি আর্কষণ করতে পারতেন আবার অন্যকে আপন করে নিতেও ছিলেন সক্ষম। পরিবারের সবাই শিক্ষিত, মার্জিত, র“চিশীল ও সনাতনী ভব্য। আমীনূর রশীদ চৌধূরী তাঁর অন্যান্য ভাইবোনদের চেয়ে শিক্ষায়, র“চিতে, কর্মে ও মননে এক স্বাতন্ত্র্য ধারার অনুসারী ছিলেন। যার ফলে বিপববাদে অনুপ্রাণিত হয়ে বিপবীদের সঙ্গে সংযোগ রক্ষা করতে গিয়ে জীবন ঝুঁকির সম্মুখীন হয় তঁার। পুলিশি নির্যাতন ভোগ করতে হয়, করতে হয় বহুবার কারানিবাস। কারাবাসের ফলে জীবনে একেবারে সাধারণের সঙ্গে মিলিত হওয়া, তাদের সুখ দুঃখের ভাগীদার হওয়া যেমন সম্ভবপর হয়েছিল তেমনি শিমলনায় লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের সভায় পিতার সঙ্গে যোগদান করে এ উপমহাদেশের তৎকালীন বরেণ্য ও স্মরণীয় প্রথিতযশা, রাজনীতিবিদ, সমাজকমর্ী, ভূম্যাধিকারী সংস্কৃতিসেবী, উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী, বৃটিশরাজের সম্মানিত প্রতিনিধিদের সান্নিধ্য লাভ তঁার জীবন প্রণালীকে বিশুদ্ধ করে দেয়। এদের সংস্পর্শ তঁাকে অসাম্প্রদায়িক চেতনাসম্পন্ন রাজনৈতিকমর্ী সংকীর্ণতামুক্ত, ব্যক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে প্রেরণা যুগিয়েছে। সচেতন ব্যক্তিটি তাই সাধারণের মতো থেকে অসাধারণ অনন্যসব কাজ করে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন। বাল্যাবস্থা থেকে যেখানে সুন্দর, শুভ সেখানেই তিনি নিজেকে উপস্থাপিত করেছেন। সান্নিধ্য লাভ করতে ধর্মগোত্র বিচার করেননি, ব্যক্তি ও তার নীতি সর্বাগ্রে স্থান দিয়েছেন। ফলে সাম্প্রদায়িক বেড়াজালের উর্ধ্বে তাঁর বন্ধুত্বের সীমা সম্প্রসারিত ছিল। তাঁর গুণপণা ও অন্যান্য গুণপনাদের সঙ্গেই সংশিষ্ট হতে সহায়তা দান করেছে।
ধর্মের বাড়াবাড়ি তিনি সহ্য করতেন না। ধমর্ীয় গÊীর মধ্যে জীবনকে লালন করতে চাইতেন না। শৈশবে খৃস্ট ধর্মের অনুসারী মিসেস বেল এর আপত্য্েলহে লালিত হলেও তঁার জীবন ধারায় ধর্ম কোন প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করতে পারেনি। ধমর্ীয় বিদ্বেষ হানাহানি তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি, তাঁর বাল্যের সহপাঠী, বন্ধু-বান্ধব নিজ ধর্মের লোক না হওয়াতে অন্য ধর্মের প্রতি ছোটকাল থেকেই সহমমর্ীতা ও সহনশীলতায় পরিপুষ্ট হন। সারাজীবন এ পরিপূর্ণতা সতেজ ছিল। রাজনীতির কলুষতায়, ফরমায়েশী সংস্কৃতির উপঢৌকন তাঁর মধ্যে দোদুল্যমানতা আনতে পারেনি আর এখানেই ছিল তাঁর জীবনের চরম সাফল্যের বীজ। জীবনের সকলস্তরে শিক্ষার এ ছোট্টবোধই তাঁকে আলোকিত করেছিল, ক্ষণজন্মা করে তুলেছিল, প্রগতিশীল করেছিল, অন্যায়, অসত্যের বির“দ্ধে গর্জে উঠতে সাহস জাগিয়ে তুলেছিল। সাম্প্রদায়িক বলয়ের লোক সার্বজনীন মহৎ কিছু করতে পারে না। তঁার কোন উদাহরণ নেই। তাদের কাজ হবে এক পেষে, সীমাবদ্ধ, পাঁচ শতকের সীমাবদ্ধ বাসভূমের মতো। খোলামেলা নির্মল বায়ূর সেখানে অভাব। আমীনূর রশীদ চৌধূরীর এই সুস্থ চিন্তাই রাজনীতি ও সংস্কৃতিক ক্ষেত্রে তঁাকে প্রতিষ্ঠিত হতে সুদৃঢ় শেকড়ের কাজ করেছে। ক্যালকাটা বয়েজ স্কুলে তাঁর বাল্যশিক্ষা শুর“ হয়। এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি আমেরিকান অধ্যক্ষ দ্বারা পরিচালিত ছিল এবং এশিয়ার বিভিন্ন দেশের ভিন্ন ভিন্ন ধর্মের ছাত্ররা পড়াশুনা করত। ফলে সেখানকার শিক্ষা তাঁর সার্বজনীন মননশীলতার উৎকর্ষতা বৃদ্ধিতে সার্বিক সহায়তা প্রদান করেছিল। পাশ্চাত্য শিক্ষার বাহনের মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষা শুর“ করলেও নিজ মাতৃভাষা, নিজ দেশ ও সাধারণ জীবনের চিত্র তাঁর মনে ছাপ ফেলেছিল। এ দাগ কোনদিন মুছেনি বরং দিন দিন গভীরতর হয়েছিল।
পারিবারিক পরিবেশ ও শিক্ষা, বয়োজ্যেষ্ঠদের দ্বারা যথাযথভাবে পরিচালনার কারনেই ব্যতিক্রমধমর্ী পরিবারে জন্মগ্রহণ করলেও সাধারণ মানুষের দুঃখ কষ্টের সঙ্গে তিনি জড়িত ছিলেন নিবিড়ভাবে, বাল্যকাল থেকেই। রাজনীতিতে কংগ্রেস ভাবধারার সঙ্গে সংশিষ্ট থাকার কারণে অসাম্প্রদায়িকভাবে চিন্তাকে সম্প্রসারিত করতে সক্ষম হন এবং এরজন্য বির“দ্ধ শক্তির নিকট থেকে আমৃত্যু নির্যাতন, যন্ত্রণা নিদার“ণভাবে উপহার পেয়েছিলেন। মুসলিমলীগ জন্মগ্রহণ করে সাম্প্রদায়িকতার শক্তিকে কেন্দ্রীভূত করে। মুসলিম লীগের রাজনীতিই এ উপমহাদেশের দীর্ঘদিনের অসাম্প্রদায়িক চিন্তা চেতনায় ফাটল ধরায় যার পরিণতিতে ভারত বিভাগ এবং এর পরবতর্ীতে বাংলাদেশের অভ্যুদ্বয়। তিনি মুসলিম লীগের রাজনীতির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করতে পারেননি। মুসলিম লীগের সংকীর্ণ রাজনীতিকে তিনি পৃষ্ঠপোষকতা দিতে অসমর্থ হয়ে উঠেন। পরিবার থেকেও এর জন্য কোন প্রকার প্রেরণা পাননি। মুসলিম লীগের পরমত অসহিষ্ণুতা তিনি বরদাশত করতেন না। ধমর্ীয় কুসংস্কারকে নিয়ে রাজনীতি করাকে তিনি পছন্দ করতেন না। মসজিদের পাশ দিয়ে হিন্দু ধমর্ীয়দের বাদ্য বাজনাসহ মিছিল যেতে যখন বাধা আসে তখন তিনি বিষ্ময় প্রকাশ করেন। একদল মিশরীয়দের নিকট থেকে জানতে পারেন, সেখান কোন বাধা নেই। কিন্তু ধমর্ীয় গোড়াদের দ্বারা আমাদের এতদঞ্চলে এই ইস্যুকে কেন্দ্র করে বহুবার উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে, যার মুখোমুখি হয়ে তিনি নাজেহাল হয়েছেন, রক্তাক্ত হয়েছেন। আজও এভাবে তাঁর মত মনমানসিকতা সম্পন্ন মহৎ জনেরা নির্যাতিত হয়েই চলেছেন। নিভৃতচারী এ নেতার জীবনের অনেক তথ্য ও ঘটনা অনেকের কাছেই অজানা রয়ে গিয়েছে। মাস্টার দা সূর্যসেন ফেরারী অবস্থায় তাদের বাসায় অবস্থান করেছিলেন। বিপববাদের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন ছিল। উন্নত পৃথক মনমানসিকতা সম্পন্ন না হলে এ দুঃসাহসিক কাজে অংশগ্রহণ সম্ভবপর হত না। ১৯৪৭ সালের রেফারেÊামে পাকিস্তানের পক্ষে কাজ করেননি। দ্বিজাতিতত্ত্বে বিশ্বাস ছিল না। শেষ পর্যন্ত দ্বিজাতি তত্ত্ব তার অস্তিত্ব রক্ষা করতে পারল না। এগুলো সংকীর্ণ রাজনীতি, এ রাজনীতি অনুদার রাজনীতি, এ অগনতান্ত্রিক রাজনীতি। বর্তমান কিংবা অদূর ভবিষ্যতে সুদূরপ্রসারী ফল নিয়ে আসতে পারে না। মিঃ চৌধূরী তা অনুধাবন করতে পেরেছিলেন বাল্যকাল থেকে গোঁড়ামিমুক্ত, সংষ্কারমুক্ত পারিবারিক পরিবেশে লালিত পালিত হয়ে।
শুধু রাজনীতির ক্ষেত্রে নয় জীবনাচারের অন্যান্য ক্ষেত্রে সংস্কারমুক্ত, অসাম্প্রদায়িক চরিত্রের অধিকারী হিসেবে পরিচিতি অর্জন করেছিলেন। পাকিস্তান আমলে সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে, সাংস্কৃতিক আন্দোলনে তিনি কখনও অগ্রবতর্ী সেনানায়ক, কখনও নেপথের শ্রেষ্ঠ কলাকুশলকার। রবীন্দ্রনাথকে পাকিস্তান আমলে কত বিড়ম্বনার মুখোমুখি হতে হয়েছিল। তাঁর রচনা কূপমুÊকতার উর্ধ্বে ছিল বলে পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠী ও তার দোসররা রবীন্দ্র সাহিত্যকে অবহেলা করত, তাচ্ছিল্য করত এমন কী নিষিদ্ধ করার দুঃসাহস ও দেখিয়েছিল। তদানিন্তন পূর্ব পাকিস্তানে, দ্বিজাতি তত্ত্বের সূতিকাগারে যে কয়জন বলিষ্ঠভাবে রবীন্দ্র নাথের সাহিত্য, সঙ্গীতকে উর্ধ্বে তুলে ধরার সৈনিক হিসেবে কাজ করেছিলেন মিঃ আমীনূর রশীদ চৌধূরী তাঁদের মধ্যে অন্যতম। রবীন্দ্র চর্চায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন। নিজের বাড়িতে অনুষ্ঠানের আয়োজন করে দৃঢ় মনোবলের পরিচয় দিয়েছিলেন। কাজটা যত সহজ মনে হয় তত চাট্টিখানি কথা নয়। অনেকের রোষানলে, কোপানলে পড়তে হয়েছিল, অনেক প্রকারের নিগৃহিতও হতে হয়েছিল।
স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে তাঁর চারিত্রিক দৃঢ়তার জন্য অনেক ক্ষেত্রেই তাঁর যা পাওয়ার ছিল তা থেকে বঞ্চিত হতে হয়েছিল। তার জন্য তিনি বিন্দুমাত্র বিচলিত হননি। বরঞ্চ যারা অসত্য ও অন্যায় পথে তঁাকে নিগৃহিত করেছিল তারাই পথচ্যুত, পথভ্রষ্ট হয়েছে, নিজেদের ভুলের শিকারে মর্মাহত হয়েছে।
প্রতিটিকালে কালিক সীমার বাইরে কিছুলোক জন্মগ্রহণ করে সমাজ কাঠামোর ভিত্তিগঠনে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন এবং তাঁদের কীর্তি সে সময়ের জন্য অত্যন্ত অপরিহার্য হয়েও উঠে। মিঃ আমীনূর রশীদ চৌধূরী তেমনিভাবে আমাদের আঞ্চলিক সীমার মধ্যেই নয় সারাদেশের মধ্যে নিজস্ব এক বলয় সৃষ্টি করেছেন, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের জন্ম দিয়ে গিয়েছেন যা পরবতর্ী প্রজন্মের কাছে শিক্ষনীয় ও বন্ধনীয়।
আমাদের বর্তমান সমাজ জীবনের এ ক্রান্তিকালে আমরা যখন নিজস্ব মানবিক স্বকীয়তাকে বিসর্জন দিয়ে অন্য মিথ্যার ভুবন যা একান্তই ক্ষণস্থায়ী রচনায় লিপ্ত হয়েছি তাদের কাজে মিঃ চৌধুরীর জীবনী, কর্মকাÊ, মনমানসিকতা প্রেরণার উৎস হতে পারে। উন্নত চারিত্রিক গুণাবলী সম্পন্ন মানুষের বর্তমানে বড় অভাব, সকলেই রাজনীতির বিষবাষ্পে জর্জরিত। সকল কিছুর মধ্যে রাজনীতিকে লালন করতে গিয়ে পরিশীলিত রাজনীতির অভাব ঘটিয়েছেন। ফলে সকল মহলে শুদ্ধতা স্থান করে দাঁড়াতে পারছে না। আমরা সংকীর্ণতার, অনুদারতার পরিচয় দিয়ে চলেছি। মিঃ আমীনূর রশীদ চৌধূরীর জীবন চর্চা, আদর্শের বিশেষণ সমসমায়িক কালে সবিশেষ প্রয়োজন। শেষের দেশে চলে গেলেও কিছু কিছু লোক আপন মহিমায় উজ্বল ভাস্করের ছাপ রেখে যান, মিঃ আমীনূর রশীদ চৌধূরী তেমনি কালোত্তীর্ণ, যুগোত্তীর্ণ একজন কিংবদন্তীতুল্য জননায়ক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবেন।
আমীনূর রশীদ চৌধূরীর সংক্ষিপ্ত জীবনী
মিঃ আমীনূর রশীদ চৌধূরীর জীবন ইতিহাস এতই দীর্ঘ, ব্যাপক ও বৈচিত্র্যপূর্ণ যে, স্বল্প পরিসরে তাহা পরিপূর্ণভাবে তুলে ধরা অসম্ভব। মিঃ চৌধূরীর জীবনের এক সংক্ষিপ্ত চিত্র নিম্নে তুলে ধরার চেষ্টা করা হইয়াছে।
মিঃ আমীনূর রশীদ চৌধূরী ১৯১৯ সালের ১৭ই নভেম্বর কলিকাতার ৩১ নম্বর জাননগর রোডে জন্মগ্রহণ করেন। তাহার পিতা মিঃ আব্দুর রশীদ চৌধূরীর নিবাস ছিল সুনামগঞ্জের মহকুমার পাগলা পরগণার অন্তর্গত দুর্গাপাশা গ্রামে। তাদের পূর্বপুর“ষ ফুল খান পাঠান মুলুক থেকে এখানে এসে বসবাস আরম্ভ করেন। সিলেটের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব মিঃ আব্দুর রশীদ চৌধূরী বৃটিশ শাসনামলে একষ্ট্রা এসিস্ট্যান্ট কমিশনার, আসাম ব্যবস্থাপক সভার সদস্য, ভারতীয় ব্যবস্থাপক পরিষদের সম্মানিত সদস্য ছিলেন। মিঃ আমীনূর রশীদ চৌধূরীর গর্ভধারিণী ছিলেন মিসেস রাজিয়া রশীদ। মিসেস রাজিয়া রশীদের পূর্ব পুর“ষ ইরানের মেশেদ থেকে ভারতে চলে আসতে বাধ্য হন। কারণ তারা ছিলেন সুন্নী এবং ইরানে শিয়াদের প্রাধান্য ছিল অত্যাধিক।
মিঃ আমীনুর রশীদ চৌধূরী তাঁর পিতা-মাতার তৃতীয় সন্তান। তার গর্ভধারিণী মিসেস রাজিয়া চৌধূরী কলিকাতায় কনভেন্ট স্কুল থেকে সিনিয়র ক্যামব্রিজ পরীক্ষা পাশ করেন। তিনি অত্যন্ত সুন্দরী ও মেধাবী ছিলেন এবং ইংরেজী, ফার্সি ও উদুর্ ভাষায় কবিতা লিখতেন। মিঃ চৌধূরীর জন্মের তিন মাস পর তাঁর গর্ভধারিণী মায়ের যক্ষ্মা রোগ হয়। রোগটি অত্যন্ত ছোঁয়াচে বলে চিকিৎসকগণ মিঃ চৌধূরীকে তাঁর মার কাছ থেকে সরাইয়া রাখার পরামর্শ দেন। তাঁর মায়ের সহপাঠিনী এক ইংরাজ ভদ্রমহিলা যার নাম মিসেস এ্যালিজাবেথ বেল মিঃ চৌধূরীকে তাঁর মার কাছ থেকে চেয়ে নেন। মিসেস ছিলেন নিঃসন্তান। তাঁর স্বামী মিঃ বেল কলিকাতার তৎকালীন এক বিখ্যাত বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং ডাইরেক্টার ছিলেন। ১৯১৯ সালের ১৯ শে জুন চুঁচুড়ার গংগার তীরে একটি বাড়িতে মিঃ চৌধূরীর গর্ভধারিণীর মৃত্যু হয়। তিনি তাঁর গর্ভধারিণীকে স্বজ্ঞানে কোনদিন দেখেননি। তবে মাতৃস্নেহের কোন অভাব হয়নি। প্রথমে মিসেস বেল ও পরে তাঁর আম্মা বেগম সিরাজুন্নেসা চৌধূরী (বেগম রশীদ) তাঁকে মাতৃস্নেহের অভাব বোধ করতে দেননি। বেগম সিরাজুন্নেসা চৌধূরী পাকিস্তান আমলে এম.এন.এ ছিলেন। ত্রিশ ও চলিশ দশকে সিলেটের সহিংস ও অহিংস রাজনৈতিক আন্দোলনে বেগম রশীদের অবদান ছিল অতুলনীয়।
বেল দম্পতির কাছে থাকায় মিঃ চৌধূরীর মুখে ফুটেছে ইংরেজী ভাষা। দশ বারো বছর বয়স পর্যন্ত অন্য ভাষায় কথা বলতে শিখেননি। মিঃ চৌধূরীর শিক্ষা আরম্ভ হয় ক্যালকাটা বয়েজ স্কুলে। এদিকে মিঃ বেলের ভারতবর্ষে কাজের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে মিসেস বেলের ইচ্ছে হলো মিঃ চৌধূরীকে তাদের সঙ্গে বিলেত নিয়ে যেতে। কিন্তু মিঃ চৌধূরীর আত্মীয়-স্বজনের আপত্তিতে তা আর হলো না।
ছাত্র জীবনেই মিঃ চৌধূরী স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েন। আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে এক ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে তার শিক্ষা পর্বের সমাপ্তি ঘটে। একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী হিসেবে তার অবদান অবিস্মরণীয়। তিনি যে সময় রাজনীতি করেছেন সে সময় ফুলের মালা ও জিন্দাবাদ ছিল না। ছিল জেল, জরিমানা, ফাঁসি। স্বাধীনতা সংগ্রামে মিঃ চৌধূরী সহিংস ও অহিংস উভয় পন্থায় অংশ নিয়েছেন প্রত্যক্ষভাবে। নেতাজী সুভাষ বসু ও চট্টগ্রামের মাস্টারদা’র আদর্শ তার উপর প্রভাব ফেলেছিল। তিনি সুভাষ বসুর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে এসেছিলেন। অবিভক্ত ভারতবর্ষ স্বাধীনতা সংগ্রামে তার কয়েক দফায় কারাদÊ হয়েছে। কারাযন্ত্রণা ভোগ করা ছাড়াও অন্যান্য বহুভাবে মিঃ চৌধূরী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে তাঁহার মত ত্যাগী পুর“ষের বা বীরের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। মিঃ চৌধূরী তাঁহার আত্মজীবনী গ্রন্থে লিখেছেন, ‘জেল খেটেছি, পুলিশের সন্দেহভাজন হয়েছি। একবার এদের খাতায় নাম লেখা হয়ে গেলে তা আমরণ থেকে যায়। এককালে যা যা করেছি তার কয়েকটির জন্য ফাঁসি হতে পারত ইংরেজদের বিচারে, কিন্তু গ্রহের ফেরে আজও স্বাধীন দেশে বেঁচে আছি। রাজনীতিতে প্রবেশের পিছনে অন্যান্যরা ছাড়া মৌলভী রিয়াজুদ্দীনের অনুপ্রেরণা ছিল সবচাইতে বেশি।
রাজনৈতিক জীবনে মিঃ আমীনূর রশীদ চৌধূরী এই উপ-মহাদেশের বিশিষ্ট রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে এসেছিলেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন মহাত্মা গান্ধী, মিঃ জিন্নাহ, নেতাজী সুভাষ বসু, পÊিত নেহের“, মাওলানা আবুল কালাম আজাদ, ফখর“দ্দীন আলী আহমদ (রাষ্ট্রপতি), ভি.ভি.গিরি (রাষ্ট্রপতি), খান আব্দুল কাইয়ুম খান, মিঃ ফিরোজ খান নূন, চৌধূরী খালিকুজ্জামান, ডাঃ বিধান রায়, আসামের প্রাক্তন মূখ্যমন্ত্রী সৈয়দ স্যার সাদুলাহ, মিঃ গোপীনাথ বড় দলই, জননেতা মিঃ টি আর পুকন, মিঃ নবীনচন্দ্র বড়দলই, মিঃ দেবেশ্বর শর্মা, মিঃ কে চান্দ, মিঃ আব্দুল মতিন চৌধূরী প্রমুখ। এছাড়া আরো বহু বিশিষ্ট রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব রয়েছেন যাদের পরিচিতি সারা উপ-মহাদেশে ছড়িয়ে আছে। মিঃ চৌধূরীর সাথে তাদের ব্যক্তিগত পর্যায়ে পরিচিতি ছিল। তাঁদের অনেকে সিলেটে তাঁর বাড়িতে আতিথ্য গ্রহণ করেছেন। বৃটিশ ভারতে রাজনৈতিক জীবনে তিনি তৎকালীন বৃটিশ রাজ প্রতিনিধি ও গভর্ণর জেনারেলের অতিথিও হয়েছিলেন। রাজনৈতিক জীবনে কংগ্রেসের সাথে তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর বলতে গেলে তিনি সক্রিয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেননি। তিনি টুলটিকর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানও ছিলেন।
মিঃ আমীনূর রশীদ চৌধূরীর জীবনে রাজনৈতিক দিক ছাড়াও সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সেবামূলক দিকগুলি উজ্জ্বলতায় ভরপুর। তাঁর মানবিক গুণাবলী, তার প্রতিভা, মেধা, সাহস ও বুদ্ধি তাকে সকল ক্ষেত্রে মহান করেছে। সাংবাদিকতা ক্ষেত্রে তার অবদান উজ্জ্বল হয়ে থাকিবে। প্রকৃতপক্ষে তার সাংবাদিকতা শুর“ ১৯৩৪ সালে। সে সময়ে সিলেটের এ্যাডিশনেল ডিষ্ট্রিক্ট ম্যাজিষ্ট্রেটের কোর্টে একটি বিখ্যাত মামলার খবর সংগ্রহ থেকে তার সাংবাদিকতা শুর“। মিঃ চৌধূরীর ভাষায় : ‘আমি গেলাম যুগভেরীর সম্পাদক মিঃ মকবুল হোসেন চৌধূরীর কাছে। বললাম, আমাকে কোর্টে পাঠাবার ব্যবস্থা করে দিতে, কারণ ঐসব মামলায় বাহিরের কাউকে ভিতরে যেতে দেওয়া হত না। যুগভেরীর সম্পাদক আমাকে যুগভেরীর প্যাড দিয়ে বললেন, ‘কি লিখতে হবে তুমি ঠিক করে আন।’ আমাকে যুগভেরীর প্রতিনিধি হিসেবে কোর্টে হাজির থাকার অনুমতি দেবার জন্য লিখে তাঁর দস্তখত নিলাম এবং এ.ডি.এম এর নিকট উপস্থিত হলাম। জীবনের প্রথম সাংবাদিকতা করতে গেলাম। সাংবাদিকতা ঠিকই করেছিলাম। মিঃ মকবুল হোসেন চৌধূরী আমার রিপোর্ট দেখে বলেছিলেন, ‘তুমি ইচ্ছে করলে রিপোর্টার হতে পারবে, তোমার হাত আছে।’
১৯৩১ সালে মিঃ আব্দুর রশীদ চৌধূরী কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ‘যুগভেরী’র নামটা মিঃ আমীনূর রশীদ চৌধূরীর দেয়া। তিনি ‘যুগভেরী’ পত্রিকার যুগ ও ‘রণভেরী’ নামে শিশুপাট্য বইয়ের ‘ভৈরী’ নিয়ে যুগভেরী নামকরণ করেছিলেন।
যুগভেরীর সাথে মালিক ও সম্পাদক হিসেবে তার জীবন শুর“ হয় ১৯৬১ সাল থেকে। ‘ইষ্টার্ণ হেরাল্ড’ নামের একটা ইংরেজি পত্রিকাও তিনি বের করেছিলেন যা অবশ্য বর্তমানে নেই। যুগভেরী তার মালিকানা ও সম্পাদনায় আসার পর তার মর্যাদা ও প্রভাব আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রকৃতপক্ষে যুগভেরী থেকে কোন লাভ হয় না। মিঃ চৌধূরী তার অন্যান্য আয় থেকে অর্থ ব্যয় করে যুগভেরী দীর্ঘদিন ধরে টিকিয়ে রেখেছেন বা রাখছেন। যুগভেরী তার সম্পাদনায় সত্যিকার অর্থে সিলেটের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। মিঃ চৌধূরী সিলেটের স্বার্থ সংশিষ্ট বিষয় নিয়ে যখনই যা লেখার প্রয়োজন মনে করেছেন তা লিখেছেন- কোন হুমকি, কোন রক্তচক্ষু, কোন প্রলোভন তাকে দমাতে পারেনি। সত্য ও বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতায় তার ভূমিকা উজ্জ্বল। সম্পাদককালীন জীবনে তিনি বহুবার বিব্রতকর অবস্থার সম্মুখীন হয়েছেন। কিন্তু সাংবাদিকতার স্বার্থে, জেলার বৃহত্তম স্বার্থে তিনি হাসিমুখে তা সামলে নিয়েছেন।
সিলেটের সাহিত্য-সাংস্কৃতিক জগতে তার পদচারণা বা অবস্থা অত্যন্ত উজ্জ্বল। সিলেট মুসলিম সাহিত্য সংসদের জন্মকাল থেকে তিনি ইহার সাথে জড়িত ছিলেন। সিলেট মুসলিম সাহিত্য সংসদের সভাপতি হিসেবে তার ভূমিকা ছিল সত্যি প্রশংসনীয়। তিনি সাহিত্য সংসদের পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন দীর্ঘদিন। সাহিত্য সংসদের বহু মূল্যবান পুস্তক সংগ্রহে তার ভূমিকা ছিল অনন্য। তার কাব্য ও সংগীত প্রতিভাও উলেখ করার মতো। তিনি রেডিও বাংলাদেশের একজন নিয়মিত গীতিকার ছিলেন। তার লেখা বহু গান রেডিও পাকিস্তান ও রেডিও বাংলাদেশ থেকে প্রচারিত হয়েছে। ‘গানের ডালি’ নামে তার লেখা গানের একটা বই প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া আরো অসংখ্য গান লিখেছেন।
মিঃ আমীনূর রশীদ চৌধূরীর জীবনের উলেখযোগ্য অংশ কাটিয়েছে কবি-সাহিত্যিক ও শিল্পীদের ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে। কবি কাজী নজর“ল ইসলাম, তারা শংকর, বনফুল, সজনীকান্ত দাস প্রমুখের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য তিনি লাভ করেছেন। এছাড়া আরো বহু সাহিত্য সংগীত প্রতিভার সাথে তার অন্তরঙ্গ সম্পর্ক হইয়াছে। তাদের পরিচিতি সাহিত্য জগতে দেদীপ্যমান। প্রখ্যাত ভাষাবিদ ও পÊিত সৈয়দ মুজতবা আলীর সঙ্গে সম্পর্ক ছিল খুবই ঘনিষ্ঠ। বিশিষ্ট কবি বেগম সুফিযা কামাল তাকে বোনের অকৃপণ স্নেহ দিয়ে আসছিলেন।
মিঃ চৌধূরীর বাসভবন আম্বরখানার জ্যোতি মঞ্জিল সিলেট শহরের সংস্কৃতি চর্চার এক বিশিষ্ট কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত। নববর্ষ বা রবীন্দ্র-নজর“ল জন্মবার্ষিকীতে তাদের বাড়িতে প্রায় প্রতি বছরই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। তাদের গোটা পরিবার সংস্কৃতি চর্চায় উৎসাহী। মিঃ চৌধূরী ‘সিলেটী নাগরী লিপি’ সাহিত্যের উন্নয়নে যথেষ্ট অবদান রেখে গিয়েছেন। সিলেটী নাগরী গবেষণায় নিয়োজিত ‘সিলেট একাডেমীকে তিনি সিলেট শহরের চৌহাট্টায় একখÊ বহু মূল্যবান ভূমি দান করেছেন। প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন সংগ্রহে তার প্রচেষ্টা প্রশংসনীয়। তারই প্রচেষ্টায় সিলেটে কয়েকটি প্রাচীন তাম্রালিপি ও শিলালিপি উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। এছাড়া সাহিত্য-সাংস্কৃতিক ও সাংবাদিকতা ক্ষেত্রে তার বহু ধরনের প্রশংসনীয় তৎপরতা রয়েছে। তিনি সিলেট প্রেসক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। দীর্ঘ কয়েক বছর তিনি প্রেসক্লাবের সভাপতি ছিলেন। এছাড়া তিনি বাংলাদেশ সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয়ের সংবাদপত্র হিসেবে তিনি বিদেশ সফল করেছেন। সর্বশেষ সফর করেছেন সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সাথে যুগোশোভিয়া।
মিঃ আমীনূর রশীদ চৌধূরী অন্যান্য পত্রিকার সাথে কলকাতার বিখ্যাত সাপ্তাহিক ‘দেশ’ পত্রিকায় লিখতেন। কলিকাতার ‘বারো মাস’ তার আত্মজীবনী প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছে। তিনি রেডিও বাংলাদেশ সিলেট কেন্দ্রের উপদেষ্টা কমিটির সদস্য ছিলেন।
একজন চা-কর হিসেবে তার ব্যাপক পরিচিতি রয়েছে। তিনি একজন প্রবীণ চা-বিশেষজ্ঞ। চা সম্পর্কে নবাগতরা তার মূল্যবান পরামর্শ পেয়ে থাকেন। তিনি নূরজাহান ও আমীনাবাদ চা বাগানের সত্ত্বাধিকারী। পাকিস্তান টি এসোসিয়েশনের তিনি ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন। পরে তিনি বাংলাদেশীয় চা সংসদের ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনি পাকিস্তান ন্যাশনাল টি এসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠা অবৈতনিক সেক্রেটারী ছিলেন। এছাড়া ছিলেন টি বোর্ডের মেম্বার। তিনি বাংলাদেশ চা শ্রমিক প্রভিডেন্ট ফান্ডের অন্যতম ট্রাস্ট্রি ছিলেন। বাংলাদেশ রেলওয়ে এডভাইসারী কাউন্সিলের তিনি সদস্য (বাংলাদেশীয় চা সংসদের প্রতিনিধি হিসেবে) ছিলেন।
তিনি তিনবার জেনিভায় আই.এল.ও কমিটি অন ওয়ার্কস অন প্যান্টেশন-এ পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। তিনি ছিলেন এমপয়ার্স গ্র“পের প্রতিনিধি। একবার সম্মেলনে তাকে এমপয়ার্স গ্র“পের ভাইস চেয়ারম্যান করা হয়।
বাংলাদেশ স্বাধীনতা যুদ্ধে মিঃ চৌধূরীর অবদান অবিস্মরণীয়। তিনি ৭১ সালের মার্চ-এপ্রিল মুক্তিযুদ্ধের জন্যে চা-বাগান সমূহ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ চাঁদা তুলে দিয়েছেন। পাক হানাদার বাহিনী মিঃ চৌধূরীকে বন্দী করে সালুটিকরের নিকটবতর্ী তৎকালীন সিলেট আবাসিক বিদ্যালয়ের বন্দী ১৩০ দিন আটক করে রাখে এবং তার উপর অমানুষিক নির্যাতন করে। এ নির্যাতনের ফলে মিঃ চৌধূরী শারীরিক দিক থেকে ভেঙে পড়েন। বন্দিদশা থেকে মুক্তি পেয়ে তিনি স্বপরিবারে বিলাতে চলে যান এবং সেখানে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে কাজ করেন। সে সময়ে কলিকাতার দেশ পত্রিকায় তার লেখা পাক নির্যাতনের বিবরণ প্রকাশিত হয় যা সে সময় তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি করে। এছাড়া স্বাধীনতা সংগ্রামে তাঁর বিপুল পরিমাণ সম্পত্তির ক্ষতি সাধিত হয়।
মিঃ চৌধূরীর সবচেয়ে বড় গুণ তিনি একজন দানশীল। তার দান নীরবে, গোপনে- যা একজন প্রকৃত দানশীলের বৈশিষ্ট্য। তার দানে বহু ব্যক্তি উচ্চশিক্ষিত হয়েছেন। তিনি মেধাবী ও গরীব ছাত্রদের নিয়মিত বৃত্তি দিয়ে থাকেন এবং এই খাতে বছরে হাজার হাজার টাকা ব্যয় হয়। তিনি রোগীর সেবায়, আর্ত মানবতার সেবায় সাহিত্য-সংস্কৃতির সেবায়, দুঃস্থ শিল্পী-সাহিত্যিকদের সেবায় সর্বদা অগ্রভাগে থাকেন। তার মত দানশীল ব্যক্তি আমাদের সমাজে দুর্লভ।
ধমর্ীয় ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি তার আর্থিক সাহায্য পেয়ে থাকে। তিনি রেডক্রসের আজীবন সদস্য ছিলেন। শ্রীমঙ্গলে শেফা ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের প্রস্তাবিত হাসপাতালে তিনি লক্ষাধিক টাকা দান করেছিলেন। এছাড়া সিলেট শহরের চৌহাট্টায় এক খন্ড মূল্যবান ভূমি শেফা ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টকে দান করেছিলেন যেখানে বর্তমান লায়ন শেফা ফ্রি ক্লিনিক পরিচালিত হয়। সম্ভবত: শিক্ষাখাতে তার দান সর্বাধিক। ছাত্র বৃত্তি ছাড়াও বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তিনি আর্থিক ও অন্যান্য ধরনের সাহায্য দিয়ে থাকেন। তিনি সিলেট মহিলা কলেজ ও মদন মোহন কলেজ পরিচালনা কমিটির সদস্য ছিলেন। দেশ বিভাগের পর মহিলা কলেজ যখন সরকারী থেকে বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়ে ধ্বংসের দিকে এগিয়ে গেলে তখন মিঃ চৌধূরীসহ কয়েকজনের প্রচেষ্টায় কলেজটির অস্তিত্ব রক্ষা পায়।
মিঃ চৌধূরী লায়ন্স ক্লাব অব সিলেটের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন। তিনি সিলেট স্টেশন ক্লাবের আজীবন সদস্য ছিলেন। এছাড়া তিনি লাক্কাতুড়া গলফ ক্লাব, বালিশিরা ক্লাব ও জুরি লংকা ক্লাবের সদস্য ছিলেন। তিনি ছিলেন গলফ খেলায় পারদশর্ী। মিঃ চৌধূরীর এক সমৃদ্ধ ব্যক্তিগত পাঠাগার রয়েছে যেখানে দেশ-বিদেশের প্রাপ্য বইয়ের সমাবেশ ঘটিয়েছিলেন। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় তার পাঠাগারে ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয় এবং অনেক বই চুরি হয়ে যায়। জ্ঞান পিপাসু মিঃ চৌধূরীর অধিকাংশ সময় কাটত পড়াশুনায়।
মিঃ আমীনূর রশীদ চৌধূরী একজন বিশিষ্ট ফটোগ্রাফার বা চিত্রগ্রাহক হিসেবে পরিচিত। তার নিজের ভাষায় ১৯২৪ সালে আমার নবম জন্মদিনে আমাকে একটি টু, সি বক্স ব্রউনি ক্যামেরা উপহার দেন এবং ফটো তোলার প্রাথমিক সব কিছু শিখিয়ে দেন। এই ক্যামেরা দিয়ে বহু ছবি তুলেছি। পরবতর্ীকালে রোলী ফ্লক্স,, ফোন্টাফ্লেক্স, ক্যানন ইত্যাদি বহু উচ্চ মূল্যের ক্যামেরা কিনে ব্যবহার করেছি। কিন্তু আজও মনে হয় যেন সেই বক্স ক্যামেরায় তোলা ছবির তুল্য ছবি তুলতে পারিনি। এককালে আমি সন্তোষ কুমার, রবীন রায়, কোলকাতার শম্ভু সাহা, বোম্বের হাবিব ইব্রাহিম রহমত উলা (ইনি পরবতর্ীকালে লন্ডনে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত নিযুক্ত হয়েছিলেন) এ.জে প্যাটেল, হায়দরাবাদের রাজা দীন দয়াল, পালানপুর স্টেইটের একে সঈদ প্রমুখ ব্যক্তিদের সঙ্গে পালা দিয়ে ছবি তুলতাম। সারা ভারতবর্ষে এমনকি পৃথিবীর বহু জায়গায় আমার তোলা ছবি নিয়ে যেতেন এবং মাঝে মাঝে এক একটি ছবির জন্য উচ্চমূল্য তো পেতাম।’
এ তথ্য হয়তো অনেকেরই জানা নেই যে, মিঃ আমীনূর রশীদ চৌধূরী চলচ্চিত্রের চিত্র গ্রহণ করেছেন। তিনি পৃথিবীর বহু দেশে ভ্রমণ করেছেন এবং বিচিত্র অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। তার বহু বিদেশী বন্ধু রহিয়াছে। ঢাকায় অবস্থানরত বিভিন্ন দেশের মাননীয় রাষ্ট্রদূত তাকে বাসভবনে আতিথ্য গ্রহণ করেছেন।