এ এইচ এম মাসুম বিল্লাহ::বিশ্বজুড়ে চলচ্চিত্র বিনোদনের অন্যতম বৃহৎ মাধ্যম। মানুষের ওপর চলচ্চিত্রের বেশ শক্তিশালী প্রভাব রয়েছে। আবার এটি এক প্রকারের অর্থনৈতিক কার্যক্রম। অধিকাংশ অর্থনৈতিক কার্যক্রমের মতো চলচ্চিত্র নির্মাণ পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। চলচ্চিত্র নির্মাণে অপরিহার্যভাবে প্রচুর পরিমাণ উপকরণ প্রয়োজন পড়ে। দীর্ঘদিন ধরে এই চর্চা রয়েছে। সেই সাথে প্রয়োজন হয় প্রচুর বিদ্যুৎ ও জ্বালানি। এসব কারণে একটি চলচিত্র নির্মাণ করতে গিয়ে প্রচুর পরিমাণে বর্জ্য উৎপাদন হয়। জলবায়ুর নেতিবাচক পরিবর্তন বিশ্বজুড়ে মানবজাতির জন্য ক্রমশ বড়ো হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে, চলচ্চিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে নির্মাতারা এই হুমকির বিষয়ে সচেতনতার স্বাক্ষর রাখছেন। চলচ্চিত্র নির্মাণকে কীভাবে আরো পরিবেশবান্ধব করা যায় তা নিয়ে চলছে নানান গবেষণা, প্রচেষ্টা।
প্রি-প্রোডাকশন হতে শুরু করে ডিস্ট্রিবিউশন পর্যন্ত চলচ্চিত্রের প্রত্যেকটি ধাপে নানাভাবে পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। বিদ্যুৎ ব্যবহারের কথা বললে, শুটিংয়ের সময় প্রচুর বিদ্যুৎ প্রয়োজন। প্রথাগতভাবে যে সকল লাইটিং সিস্টেম ব্যবহার করা হয় সেগুলোতে প্রচুর বিদ্যুতের প্রয়োজন হয়। এই ধরনের লাইটিং সিস্টেমের একটি দুর্বলতা হলো এগুলো প্রচুর তাপ তৈরি করে। এই পরিস্থিতিতে ঠান্ডা করার জন্য এসির প্রয়োজন দেখা যায়। ফলে বিদ্যুৎ খরচের পরিমাণ আরও বাড়ে। কখনও শুটিংয়ে লাইটিংয়ের চাহিদা পূরণে ডিজেল চালিত জেনারেটর ব্যবহার করেন নির্মাতারা। এ ধরনের জেনারেটর প্রচুর কার্বন-ডাই-অক্সাইড বাতাসে ছাড়ে।
তবে আশার বিষয় হলো, বিশ্বজুড়ে চলচ্চিত্র নির্মাতারা ধীরে ধীরে আরও বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী প্রযুক্তি ব্যবহার করতে শুরু করেছেন। তারা এলইডি লাইট ব্যবহারে আগ্রহ হচ্ছেন। টাংস্টেন লাইট বা অন্যান্য প্রচলিত লাইটিং সিস্টেমের তুলনায় এলইডি লাইটিংয়ে কম বিদ্যুৎ প্রয়োজন। এতে তাপ খুব একটা তৈরি হয় না। ফলে বাড়তি কুলিং সিস্টেম বা এয়ারকন্ডিশনের তেমন প্রয়োজন পড়ে না। সমস্যা হলো, এলইডি লাইটের দাম বেশি। তবে দীর্ঘমেয়াদের খরচ হিসেব করলে এলইডি লাইট ব্যবহার একটি ভালো বিকল্প হতে পারে। অনেক স্টুডিও আরও একধাপ এগিয়ে আছে। সোলার প্যানেল বা অন্যান্য নবায়নযোগ্য জ্বালানির উৎস, বায়োডিজেল ব্যবহার করে শুটিংয়ে আলোর চাহিদা পূরণ করছে। বায়োডিজেল ব্যবহারে কার্বন নিঃসরণ বন্ধ না হলেও এটি জীবাশ্ম জ্বালানির চেয়ে বেশি পরিবেশবান্ধব। বিদ্যুৎ ও জ্বালানির এসকল পরিবেশবান্ধব উৎসের ব্যবহারের কারণে জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্মাতাদের নির্ভরতা কমছে, বাতাসে কার্বন নিঃসরণের পরিমাণও।
পরিবেশবান্ধব চলচ্চিত্র নির্মাণের বিবেচনায় চলচ্চিত্র নির্মাণ প্রক্রিয়ার অন্য যে বিষয়টি পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর সেটি হলো প্রচুর পরিমাণ উপকরণ সামগ্রীর ব্যবহার করা। সেট নির্মাণ, পোশাক ডিজাইন কিংবা প্রপস তৈরিতে প্রচুর কাঁচামাল প্রয়োজন। ফিল্মসেটগুলো প্রয়োজন মাফিক বানাতে হয়। এই কাজে কাঠ, ধাতব ও অন্যান্য ধরনের উপকরণ প্রয়োজন পড়ে। অভিনেতা-অভিনেত্রীদের পোশাক এবং প্রপসে এমন ধরনের উপকরণ ব্যবহার করা হয় যেগুলোর অনেক কিছুই পুনরায় ব্যবহার করা সম্ভব হয় না। ফলে শুটিংয়ের সেট, কস্টিউম বা প্রপসের অনেক কিছুই একসময় পরিবেশের জন্য বোঝায় পরিণত হয়। এছাড়া শুটিংয়ের দিনগুলোতেও সেটে নানা ধরনের বর্জ্য তৈরি হয়। ক্যাটারিং, প্যাকেজিং ও পরিবহণ কাজে প্রচুর বর্জ্য তৈরি হয়। এ সকল বর্জ্য পুনরায় ব্যবহার করা সম্ভব না বা অনেক সময় এগুলোর সঠিক ব্যবস্থাপনা করা হয় না।
চলচ্চিত্র নির্মাণকে পরিবেশবান্ধব করতে হলে ব্যবহৃত উপকরণগুলোর পুনরায় ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। ফিল্ম সেট, পোশাক কিংবা প্রপস- এগুলোর পুনরায় ব্যবহারের উপায় বের করা প্রয়োজন। এতে বর্জ্যের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমবে। পোশাক আর প্রপসগুলিকে পুনরায় ডিজাইন করে পরবর্তীতে ব্যবহার করা যেতে পারে। ২০০৫ সালের চলচ্চিত্র ‘দ্য ক্রনিকলস অফ নার্নিয়া: দ্য লায়ন, দ্য উইচ অ্যান্ড দ্য ওয়ারড্রোব’ এর কিছু পোশাক ২০১২ সালের চলচ্চিত্র ‘স্নো হোয়াইট অ্যান্ড দ্য হান্টসম্যান’ এ পুনরায় ব্যবহৃত হয়েছিল। ‘স্নো হোয়াইট অ্যান্ড দ্য হান্টসম্যান’ এর ব্যাকগ্রাউন্ডের চরিত্র এবং সৈন্যদের কিছু পোশাক ‘দ্য ক্রনিকলস অফ নার্নিয়া’ থেকে নেয়া হয়েছিল। মধ্যযুগীয় নান্দনিকতার সৃষ্টির জন্য এই পোশাকগুলো ব্যবহার করা হয়েছিল। তবে এই ব্যবস্থা চলচ্চিত্রটির আর্থিক সাশ্রয় করার সাথে পরিবেশের সুরক্ষায় ভূমিকা রেখেছে।
শুধু অভিনেতা-অভিনেত্রীদের পোশাকের পুনরায় ব্যবহার নয়, শুটিং সেটে ব্যবহৃত অন্যান্য উপকরণও পুনরায় ব্যবহার করার বিষয়টি বিবেচনায় রাখা প্রয়োজন। এজন্য সেটে রিসাইক্লিং কর্মসূচি গ্রহণ করা হলে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা আরও ভালোভাবে করা সম্ভব হবে। কাগজ, প্লাস্টিক এবং ধাতুর মতো উপকরণ সঠিকভাবে বাছাই করে যথাসম্ভব পুনর্ব্যবহার করা যেতে পারে। এছাড়া জৈব বর্জ্য কম্পোস্টে পরিণত করার ব্যবস্থা থাকলে তাতে পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব আরও কমানো সম্ভব হবে। ২০১৪ সালের চলচ্চিত্র ‘অ্যামেজিং স্পাইডার ম্যান-২’ নির্মাণের সময় রিসাইক্লিংয়ের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল। এর ক্রুরা কাগজ, প্লাস্টিক, ধাতব এবং ইলেকট্রনিক্সের মতো বর্জ্য পদার্থকে রিসাইক্লিংয়ের জন্য আলাদাভাবে রাখতেন। যেসব উপকরণ মাত্র একবার ব্যবহার করা যায় সেগুলো কমিয়ে যতটা সম্ভব পুনরায় ব্যবহারযোগ্য উপকরণ ব্যবহারের প্রতি তারা বিশেষ খেয়াল রাখতেন।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্র নির্মাণ শিল্প তেমন বড়ো না হলেও, এটি বিকশিত হচ্ছে। তবে পরিবেশের সুরক্ষার ক্ষেত্রে এই শিল্প এখনো নানা ধরনের বাধার সম্মুখীন হচ্ছে। শুটিংকালে পরিবেশবান্ধব উপায়ে বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য সৌর বিদ্যুতের মতো নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার সর্বোত্তম পরিবেশবান্ধব সমাধান। তবে এলইডি লাইটিং সিস্টেমও পরিবেশবান্ধব। তবে এগুলোর জন্য প্রচুর অর্থের প্রয়োজন। সেই সাথে লজিস্টিক্যাল চ্যালেঞ্জগুলোতো আছেই। বিশেষ করে, শ্যুটিং সেটে ব্যবহার করার জন্য কারিগরি প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। এটি বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পে পরিবেশবান্ধব ও জ্বালানি সাশ্রয়ী প্রযুক্তি ব্যবহারের পথে অন্যতম বাধা। এছাড়া চলচ্চিত্র ব্যবহারের জন্য টেকসই ও পরিবেশবান্ধব উপকরণের সহজলভ্যতা ও রিসাইক্লিং অবকাঠামোর ঘাটতি রয়েছে। এছাড়া, পরিবেশবান্ধব চলচ্চিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে সবার জন্য একটি নির্দেশিকা বা স্ট্যান্ডার্ডাইজড সাসটেইনেবিলিটি গাইডলাইন প্রয়োজন। সারা বিশ্বে এই ধরনের বেশকিছু গাইডলাইন আছে। গাইডলাইনের অনুপস্থিতিতে চলচ্চিত্র নির্মাতরা চাইলেও পরিবেশবান্ধব চর্চাগুলো অনুসরণ করতে পারছেন না।
বিশ্বের বড়ো বড়ো ফিল্ম স্টুডিওগুলো পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহারের প্রতি মনোযোগী হয়েছে। পুরো ফিল্ম প্রোডাকশন প্রক্রিয়ায় কীভাবে কার্বন ফুটপ্রিন্ট (পরিবেশে কার্বন নিঃসরণ) কমানো যায় সে বিষয়ে তারা আরও মনোযোগী হচ্ছে। শুটিং ফ্যাসিলিটিতে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী ব্যবস্থার সংযোজনের জন্য ওয়ার্নার ব্রাদার্স লীড সার্টিফিকেশন পেয়েছে। সোলার প্যানেল ও এলইডি লাইটিং সিস্টেম স্থাপন এবং পানির অপচয় রোধে ব্যবস্থা গ্রহণ করার মাধ্যমে ওয়ার্নার ব্রাদার্স বিদ্যুৎ ব্যবহারের পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে কমাতে সক্ষম হয়েছে। তাদের এই সাফল্য বিশ্বজুড়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ শিল্পের জন্য একটি উদাহরণ হয়ে আছে। এই শিল্পকে পরিবেশবান্ধব করার পথে ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র। চলচ্চিত্র নির্মাণের ধাপগুলো (ওয়ার্ক ফ্লো) এনালগ থেকে ডিজিটালে পরিণত হয়েছে। ফিল্ম স্টক ব্যবহারের পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। সেই সাথে কমেছে কেমিক্যাল প্রসেসিংয়ের মাত্রাও। ডিজিটাল ক্যামেরা, এডিটিং সফটওয়্যারের সাথে সাথে স্ট্রিমিং সেবা ব্যবহারের প্রতি নির্মাতাদের আগ্রহ বাড়ছে। ফলে ডিভিডি, ব্লু-রে ইত্যাদির ব্যবহার অনেক কমে এসেছে। ফলে চলচ্চিত্র নির্মাণ ও ডিস্ট্রিবিউশনজনিত প্লাস্টিক বর্জ্য ও কার্বন ফুট প্রিন্টের পরিমাণ কমছে।
বাংলাদেশে সবুজ ও পরিবেশবান্ধব চলচ্চিত্র নির্মাণ শিল্পের জন্য একটি টেকসইতা নীতিমালা (সাস্টেইনাবিলিটি গাইডলাইন) ও স্ট্যান্ডার্ড তৈরি করা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে ব্রিটিশ স্ট্যান্ডার্ড ইনস্টিটিউশনের বিএস ৮৯০৯ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি। প্রি-প্রোডাকশন হতে শুরু করে পোস্ট-প্রোডাকশন এমনকি বিতরণ পর্যায় পর্যন্ত একটি চলচ্চিত্রকে প্রতিটি পর্যায়কে টেকসই ও পরিবেশবান্ধব করার জন্য এতে বিস্তারিত নির্দেশনা রয়েছে। এতে টেকসই সম্পদ ব্যবস্থাপনা, বর্জ্য হ্রাস এবং শক্তি দক্ষতার গুরুত্বের ওপর জোর দেয়া হয়েছে। যে সকল চলচ্চিত্র বিএস ৮৯০৯ অনুসরণ করে, সে সকল চলচ্চিত্রকে টেকসই সংক্রান্ত লক্ষ্য নির্ধারণ করতে হয়। এ সকল লক্ষ্য অর্জনের জন্য কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হবে এবং সেগুলোর বিস্তারিত রেকর্ড সংরক্ষণ করতে হয়। তবে, বাংলাদেশের জন্য এ ধরনের গাইডলাইন তৈরি করতে চাইলে পরিবেশবান্ধব চলচ্চিত্র নির্মাণে পথে স্থানীয় চ্যালেঞ্জ ও সুবিধাগুলোকে অবশ্যই বিবেচনায় নিয়ে সেটি করতে হবে।
এছাড়া বাংলাদেশের পরিবেশবান্ধব চলচ্চিত্র নির্মাণকে উৎসাহিত করতে সরকার নির্মাতাদেরকে বিশেষ আর্থিক প্রণোদনা দিলে সেটি গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক ভূমিকা রাখবে। অনুদান, ভর্তুকি, বা ট্যাক্সের ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা প্রদান করা হলে তা নির্মাতাদের সবুজ প্রযুক্তি ব্যবহারের প্রাথমিক খরচ মেটাতে সহায়ক হবে।
পৃথিবী জুড়ে চলচ্চিত্র নির্মাতারা পরিবেশের বিষয়ে সচেতন ভূমিকা রাখছেন। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র নির্মাতাদেরও বিষয়টি আরও সক্রিয়ভাবে দেখার সময় এসেছে। অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা, প্রয়োজনীয় অবকাঠামোর অভাব ও পরিবেশবান্ধব চলচ্চিত্র নির্মাণের একটি গাইড লাইন- এই বাধাগুলো কাটিয়ে ওঠার উদ্যোগ নিতে হবে। নির্মাতারাসহ চলচ্চিত্রের সাথে জড়িত সকলকে সাথে নিয়ে, সরকার ও পরিবেশের সুরক্ষায় কাজ করছে এমন প্রতিষ্ঠানগুলোকে সাথে নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল একাডেমি অফ ফিল্ম অ্যান্ড মিডিয়া, গ্রিন ফিল্ম স্কুল অ্যালায়েন্সের সদস্য হয়েছে। ফিল্ম প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানগুলোতে পরিবেশবান্ধব উপায়ে চলচ্চিত্র নির্মাণের বিষয় অন্তর্ভুক্ত করতে বিশ্বজুড়ে কাজ করছে গ্রিন ফিল্ম স্কুল অ্যালায়েন্স। এ ধরনের আরও অগ্রগতির হাত ধরে বাংলাদেশে পরিবেশবান্ধব চলচ্চিত্র নির্মাণ এগিয়ে যাবে-এটাই সকলের প্রত্যাশা।
লেখক: পরিচালক (জনকূটনীতি) পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, ঢাকা
(পিআইডি ফিচার)