সিলেট পোস্ট রিপোর্ট :নির্বাচনে কোনো ধরনের অনিয়ম ও কেন্দ্র দখলের ঘটনা ঘটলে তাৎক্ষণিক ভোটগ্রহণ বন্ধ করতে নির্দেশ দিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দিন আহমদ। একইসঙ্গে আচরণবিধি লঙ্ঘন ও নির্বাচনে অনিয়ম হলে রিটার্নিং কর্মকর্তাদের তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিতেও নির্দেশ দিয়েছেন তিনি।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রধান ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিনিধিদের সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকে এ নির্দেশনা দিয়েছেন সিইসি।
শনিবার সকাল ১১টায় রাজধানীর ইস্কাটনে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট (বিয়াম) ফাউন্ডেশন মিলনায়তনে এ বৈঠকের আয়োজন করা হয়।
বৈঠক সূত্র জানায়, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন জায়গায় এমপি-মন্ত্রী, ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী ও তাদের সমর্থকরা আচরণবিধি লঙ্ঘন করলেও নির্বাচন কমিশন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে না- বিরোধীদের এমন অভিযোগের মুখেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বৈঠকে মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তা ও পুলিশ প্রশাসনকে তিনি এ নির্দেশনা দিলেন।
বৈঠকে সিইসি বলেন, ‘আমি ঢাকায় বসে সব ঠিক করতে পারবো না। মাঠে আপনারা থাকেন। আইনভঙ্গ হলে এ্যাকশন নিতে হবে। তারপর আপনারা আমাকে জানাবেন, কি এ্যাকশন নিয়েছেন।’
‘আপনারা এ্যাকশন না নিয়ে কেন্দ্রীয়ভাবে এ্যাকশন নেওয়ার কথা বলেন, এটা তো হয় না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমরা এ্যাকশন নিয়েছি। নিয়েও দেখিয়েছি। এভাবে আপনারা এ্যাকশন নিন, দেখিয়ে দিন। এ্যাকশন নেওয়ার দায়িত্ব আপনাদের।’ বলেন সিইসি।
ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘যে দায়িত্ব নিয়েছেন বা দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সেটি সঠিকভাবে প্রতিপালন করতে হবে। আমাদের যেন বলা না লাগে।’
প্রয়োজনে ভোট কেন্দ্র বন্ধ
দুর্বৃত্তরা ভোটকেন্দ্র দখলের চেষ্টা করলে তাৎক্ষণিকভাবে ভোটকেন্দ্র বন্ধ করতে নির্দেশ দিয়েছেন সিইসি।
তিনি বলেন, ‘আপনারা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করবেন। ভোটকেন্দ্রে যেন কোনোভাবে প্রভাবিত না হন। দুর্বৃত্তরা যেন কেন্দ্র দখল না করে। প্রয়োজন হলে কেন্দ্র বন্ধ করে দিতে হবে।’
ভোটকেন্দ্র কারা প্রবেশ করছেন এবং কারা বের হচ্ছেন সেদিকে খেয়াল রাখতেও নির্দেশ দিয়েছেন সিইসি।
তিনি বলেছেন, ‘ভোটকেন্দ্রে কারা ঢুকলো কারা বের হল সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে যাতে একসঙ্গে অনেক দুষ্কৃতকারী ভোটকেন্দ্রে না ঢুকতে পারে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা যেন এলার্ট থাকে।’
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘আপনারা বেশি ফোর্স চান, ফোর্স দিয়ে কি হবে? ঘটনা ঘটার পরে আপনার যান তাহলে লাভ কি?
জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারদের উদ্দেশে তিনি বলেন, আমি বিশ্বাস করি না- জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার যদি একত্রে বের হন, তাহলে সেই জেলার মধ্যে কোনো রকম বেআইনি ঘটনা ঘটতে পারে। আশা করি, আপনারা আন্তরিকভাবে দায়িত্ব পালন করবেন। এ নির্বাচন কমিশনের নয়, এই নির্বাচন দেশের।’
বৈঠকে নির্বাচন কমিশনার আবু হাফিজ যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের উদাহরণ দিয়েছেন। এর প্রেক্ষিতে সিইসি বৈঠকে বলেন, ‘বিদেশে যেভাবে নির্বাচন হয়। সেই দিন আমরা এত তাড়াতাড়ি আশা করতে পারি না। তবে দিন পাল্টাবে এবং যে জোর প্রয়োগ করা লাগছে তা কমে যাবে। এতটা কন্ট্রোল করা লাগবে না।’
তিনি বলেন, ‘নির্বাচনের জন্য পুলিশ ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাদের সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে হবে।’
রিটার্নিং কর্মকর্তাদের ভূমিকায় সন্দিহান শাহ নেওয়াজ
এ দিকে বৈঠকে রিটার্নিং কর্মকর্তাদের উদ্দেশে নির্বাচন কমিশনার মো. শাহ নেওয়াজ বলেছেন, ‘আচরণবিধি লঙ্ঘন হচ্ছে, কিন্তু দোষীদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। সংবাদপত্রে আচরণবিধি লঙ্ঘন হচ্ছে- বলে সংবাদ প্রকাশ হচ্ছে, আবার আপনারা বলছেন- কিছু হচ্ছে না। তাহলে মাঝামাঝি পর্যায়ে কিছু একটা হচ্ছে সেগুলো তদন্ত করা হবে।’
ভোটকেন্দ্রে সিসিটিভি স্থাপনের দাবি
বৈঠক সূত্র জানায়, একজন জেলা প্রশাসক প্রতিটি কেন্দ্রে সিসিটভি ক্যামেরা স্থাপনের দাবি জানিয়েছেন। এতে করে সন্ত্রাসী ভোট কেন্দ্রে দখলের চেষ্টা করলে পরবর্তীতে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যাবে। তিনি বলেন, ‘যেহেতু আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশ দাবি করি। কজেই আমাদের উচিত হবে সব কেন্দ্রে সিসিটিভি স্থাপন করা। তাহলে প্রকৃত দোষীদের বিচার করা যাবে।’
বৈঠকে পুলিশের মহাপরিদর্শক একেএম শহিদুল হক বলেন, ‘২৩৪টি পৌরসভায় ২১ হাজারের মতো পুলিশ সদস্য লাগবে। প্রতিটি কেন্দ্রে ৫ থেকে ৬ জন রাখতে গেলে একটু সমস্যা হবে। তাই সাধারণ কেন্দ্রে তিনজন এবং ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রে চারজন পুলিশ সদস্য রাখার পক্ষে মত দেন আইজিপি। তবে আইজিপির এ বক্তব্যের প্রেক্ষিতে ইসি সচিব মো. সিরাজুল ইসলাম বলেছেন, প্রয়োজনে টহল সদস্য কমিয়ে দিয়ে কেন্দ্রে প্রয়োজনীয় সংখ্যক পুলিশ সদস্য রাখবেন।
সরাসরি সম্প্রচার বন্ধ চান পুলিশ-প্রশাসন
ভোটকেন্দ্রে সাংবাদিক প্রবেশ ও টেলিভিশনের সরাসরি সম্প্রচার বন্ধ চান পুলিশ-প্রশাসন। তারা সরাসরি সম্প্রচার বন্ধের জন্য আহবান জানিয়েছন। তবে এতে দ্বি-মত পোষণ করে সিইসি বলেন, ‘এটা সম্ভব না।’ তখন তৃণমূলের প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হয়, এতে করে আমাদের দেশের ঘটনা বহির্বিশ্বে চলে যাচ্ছে। ফলে আমাদের ইমেজ নষ্ট হচ্ছে।
পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) একেএম শহিদুল হক সরাসরি সম্প্রচার প্রসঙ্গে বলেন, ‘গত সিটি নির্বাচনে সাংবাদিকদের সঙ্গে একটা ভুল বোঝাবুঝি তৈরি হয়েছিল। কারণ, যেখানে প্রিজাইডিং অফিসার বসে কাজ করে সাংবাদিকরা সেখানে গিয়ে সংবাদ পরিবেশন করে। এতে কাজের কিছু ক্ষতি হয়। আমার মনে হয় তাদের বাইরে থাকাই ভালো। তবে এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের সঠিক নির্দেশনা থাকলে এ ধরনের ভুল বোঝাবুঝি তৈরি হবে না।’
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে হেলিকপ্টার ব্যবহার
বৈঠকে র্যাবের মহাপরিচালক বেনজির আহমেদ বলেন, ‘ভোটকেন্দ্রে কোনো ধরনের অনিয়ম হলে আমরা তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেব। প্রয়োজনে হেলিকপ্টার ব্যবহার করা হবে। এছাড়া গাড়িতে আমাদের র্যাব সদস্যরা দায়িত্ব পালন করবেন।’
বৈঠকে একটি গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষ থেকে বলা হয়, ‘গোয়েন্দাদের তথ্য মতে, এখন পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো রয়েছে। তবে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দলের মধ্যে আন্তঃকোন্দল বাড়বে। এছাড়া কালো টাকার ব্যবহার হতে পারে। তাই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সজাগ থাকবে হবে।
উত্তর অঞ্চলে, বিশেষ করে রাজশাহী ও রংপুর অঞ্চলে জঙ্গিদের তৎপরতা বেশি। এ বিষয়ে আমাদের তৎপর থাকবে হবে। তখন রাজশাহী মহানগর পুলিশের কমিশনার বলেন, পরিস্থিতি আমাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। অভিযান অব্যাহত আছে।
গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষ থেকে আরও বলা হয়, ‘নির্বাচন শান্তিপূর্ণ রাখতে হলে সন্ত্রাস বিরোধী অভিযান চলমান রাখতে হবে। দাগি সন্ত্রাসীরা যেন ছাড়া না পায়, সেদিকে খেলাল রাখতে হবে। এছাড়া বৈধ-অবৈধ অস্ত্র ব্যবহার বন্ধ করতে হবে।
বৈঠকে নির্বাচন কমিশনার আবু হাফিজ যুক্তরাষ্টের ভ্রমণের নির্বাচন সংক্রান্ত বিভিন্ন দিক বৈঠকে তুলে ধরেন। জাবেদ আলী বিভিন্ন দিকনির্দেশনামূলক কথা বলেন। তবে নির্বাচন কমিশনার আবদুল মোবারক কোনো বক্তব্য দেননি।
বৈঠকে ইসি সচিব, নির্বাচন কমিশনাররা, পুলিশের মহাপরিদর্শক, বিজিবি, আনসার ভিডিপি, র্যাবের মহাপরিচালক গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিনিধি ও রিটার্নিং অফিসাররা (অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক-সার্বিক, ইএনও, জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা) উপস্থিত ছিলেন।