সিলেটপোস্টরিপোর্ট:সিরাজগঞ্জের রতনকান্দি উপজেলায় বাড়ি মো. রিপনের। এক বন্ধুর প্রস্তাবে টেকনাফ সমুদ্র সৈকতে ছুটি কাটানোর প্রস্তাব লুফে নিয়েছিলেন তরুণ রিপন। খুশি মনে কক্সবাজার রওনা হন তিনি। কিন্তু তখনও তিনি জানতেন না যে আনন্দময় এই যাত্রা থেকেই তার জীবনে যন্ত্রণাদায়ক এক অগ্নিপরীক্ষার শুরু হতে যাচ্ছিল কেবল।
বন্ধু মো. জাকিরের কথামতো দেরি না করে তড়িঘরিই কক্সবাজারের উপকূলীয় শহর টেকনাফে পৌঁছান রিপন। সেখানেই মানবপাচারকারীদের স্থানীয় এজেন্ট জাকির ও রিপনকে পাচারকারীদের কাছে বিক্রি করে দেয় মাত্র ১৫ হাজার টাকায়।
পাচারকারীরা রিপনকে জোর করে সাগরে অপেক্ষারত মালয়েশিয়াগামী ট্রলারে উঠিয়ে দেয়। ওই ট্রলারে আগে থেকেই অারও ১৬৪ জন যাত্রী ছিল। তাদের বেশির ভাগই ছিল মিয়ানমার বা থাইল্যান্ডের নাগরিক। এরপর শুরু হয় সাগরে রিপনের অনিশ্চিত যাত্রা। সেখানেই তাকে নির্যাতনের শিকার হতে হয় পাচারকারীদের। নির্যাতন তো ছিলই, খাবার ও পানির সংকটে জীবন আরও দুর্বিসহ হয়ে ওঠে রিপন ও তার সহযাত্রীদের।
গত মঙ্গলবার হঠাৎ করেই যেন পুরো পরিস্থিতি পাল্টে গেলো। মানবপাচারকারীদের ধরতে চলমান অভিযানে ধরা পড়ার ভয়ে যাত্রী, দালাল এবং মিয়ানমার থেকে অাসা ১৮ নারী ও অারেকটি ট্রলারসহ তাদের মাঝ সমুদ্রে ফেলে পালিয়ে যায় পাচারকারীরা।
এমনকি সেসময় তাদের মধ্যে কেউ নৌকাও চালাতে জানতো না। পরে রিপন ও ট্রলারের অারেক যাত্রী অনেক কষ্টে সেন্ট মার্টিন দ্বীপের দিকে ট্রলারটিকে নিয়ে যান। সেখানে গত মঙ্গলবার কোস্টগার্ড তাদেরকে অাটক করে।
রিপনসহ সেদিন অবৈধপথে মালয়েশিয়া যাওয়ার পথে অাটক হওয়া ১১৬ জনকে বর্তমানে অান্তর্জাতিক অভিবাসী সংস্থা (অাইওএম) এর একটি দল চিকিৎসা সাহায্য দিচ্ছে।
অাশ্চর্যের বিষয় হলো, উদ্ধার হওয়া এসব মানুষের মধ্যে মো. রফিক, অাবুল কাশেম, জাহাঙ্গীর অালম ও মো. হাশেম নামে কক্সবাজারের চার ফটোগ্রাফারও রয়েছেন। তাদেরকেও টেকনাফ থেকে মানবপাচারকারীরা অপহরণ ও মালয়েশিয়াগামী ওই ট্রলারে উঠতে বাধ্য করেছিল। সেসময় পাচারকারীরা তাদের কাছ থেকে ক্যামেরা ও মোবাইল ফোনও নিয়ে নিয়েছিল।
যদিও তাদের মধ্যে উদ্ধার হওয়া অধিকাংশ লোককে যে জোর করে ট্রলারে ওঠানো হয়েছিল এমনও নয়। কেউ কেউ স্বেচ্ছায় পাচারকারীদের ফাঁদে ধরা দিয়েছিলেন মালয়েশিয়া যাওয়ার লোভে।
তেমনই একজন নরসীংদির জাহাঙ্গীর (৩২) মালয়েশিয়ায় গিয়ে একটু ভালো আয়-উপার্জনের আশায় ইউসুফ নামে এক দালালের হাত ধরে তার ঠাঁই হয়েছিল ওই ট্রলারে। এরপর তাকেও দীর্ঘ ৪৫ দিন সহ্য করতে হয়েছে অবর্ণনীয় কষ্ট অার নির্যাতন।
জাহাঙ্গীর জানান, এই ৪৫ দিনের প্রতিদিনই তাদের সকালের নাস্তা হিসেবে খেতে দেওয়া হতো চিড়া অার গুড়। দুপুরে দেওয়া হতো ওষুধ মেশানো ভাত, যাতে উত্তাল সাগরে কেউ বমি না করে। অার পানীয় হিসেবে তাদের একমাত্র সম্বল ছিল নোনা পানি।
জাহাঙ্গীরের মতোই অারেকজন কক্সবাজার উপজেলার নুরুল হাকিম (৫৩) ট্রলারে কেউ একটু বেশি নড়াচড়া করলে বা পানির কথা বললে পাচারকারীরা তাদের বেদম মারধর করতো।
মাদারীপুর থেকে অাসা মো. মাসুম জানান, তিনিও ওই ট্রলারটিতে ৪৫ দিন ছিলেন। টেকনাফের নবী হোসেন ও বাবুল নামে দুই দালাল তার ওপর অকথ্য নির্যাতন চালায় বলে জানান তিনি।
অভিবাসন বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা অাইওএম এর চিকিৎসক দলের সদস্য ডা. সৌমেন জানান, উদ্ধার হওয়া ট্রলারটির যাত্রীদের কারও অবস্থাই এখন অাশঙ্কাজনক নয়। তবে তাদের মধ্যে কেউ কেউ বেশ দুর্বল হয়ে পড়েছে।
টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) অাতাউর রহমান জানান, অাটককৃতদের পুলিশের কাছে হস্তান্তর করেছে কোস্টগার্ড। শিগগিরই তাদেরকে তাদের পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার পদক্ষেপ নেওয়া হবে।