সিলেটপোস্ট২৪রিপোর্ট :নির্বাচন কমিশন (ইসি) পৌরসভা নির্বাচনে নিরাপত্তা পরিকল্পনার দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছে সরকারি কর্মকর্তাদের ওপর। কোন পৌরসভায় আইনশৃংখলা বাহিনীর কতগুলো টিম কাজ করবে তা নির্ধারণ করবেন স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তারা। জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার ও রিটার্নিং কর্মকর্তা বিষয়টি সমন্বয় করবেন। প্রশাসন ও আইনশৃংখলা বাহিনীর কর্মকর্তাদের দাবির মুখে সোমবার নির্বাচন কমিশন এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে।বিগত নির্বাচনগুলোতে কমিশন থেকেই নিরাপত্তা পরিকল্পনা গ্রহণ করা হতো। ওই পরিকল্পনার আলোকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পরিপত্র জারি করত। গত পৌর নির্বাচনে সেনা ও নৌবাহিনী মোতায়েন হলেও এবার তা হচ্ছে না। একই সঙ্গে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) মোতায়েনের ক্ষেত্র সীমিত করা হচ্ছে। কর্মকর্তাদের প্রস্তাবনা অনুযায়ী, পৌর নির্বাচনে ইসির প্রস্তাবিত মোবাইল টিম ও স্ট্রাইকিং ফোর্সের সংখ্যাও কমিয়ে আনা হয়েছে। ইসি সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
এ প্রসঙ্গে অতিরিক্ত সচিব মো. মোখলেসুর রহমান বলেন, নেতিবাচক দিক বিবেচনা করে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি। ছোট এলাকা ও কম ভোটার নিয়ে পৌরসভা গঠিত। পৌর নির্বাচনের নিরাপত্তায় সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নেয়া হবে। এক্ষেত্রে কমিশন কোনো শৈথিল্য দেখাবে না। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের মতে, নিরাপত্তা পরিকল্পনা সংক্রান্ত কমিশনের সিদ্ধান্তের ফলে নির্বাচনে সরকারের প্রভাব বিস্তারের সুযোগ আরও বেড়ে যাবে। সরকারের নির্দেশনার বাইরে সরকারি কর্মকর্তা ও পুলিশ সদস্যদের কিছু করার সুযোগ থাকে না। তাদের সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা সরকার থেকেই নিশ্চিত করা হয়। এর আগে ইসির পর্যাপ্ত জনবল থাকা সত্ত্বেও পৌর নির্বাচনে দুই-তৃতীয়াংশ রিটার্নিং অফিসার পদে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেয়া হয়। এটা নিয়ে বিভিন্ন মহলে সমালোচনার ঝড় ওঠে। এবার নির্বাচনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক আইনশৃংখলা পরিকল্পনার দায়িত্বও সরকারি কর্মকর্তাদের ওপর ন্যস্ত করল কমিশন।প্রশাসনের ওপর বেশি নির্ভরশীল হলে নির্বাচনে অনিয়ম বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা। সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার গণমাধ্যমকে বলেন, নির্বাচনের নিয়ন্ত্রণ কমিশনের হাতে রাখতে হয়। প্রশাসনের কর্মকর্তাদের হাতে নির্বাচনী পরিকল্পনা ছেড়ে দিলে অনিয়মের ভয় থাকে। এ নির্বাচনে যেহেতু সরকারি দল নিজস্ব প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করছে, তাই তাদের প্রভাব বিস্তারের সুযোগ সৃষ্টি হবে।
সূত্র জানায়, শনিবার নির্বাচনে আইনশৃংখলা বিষয়ে করণীয় নির্ধারণ নিয়ে বিভিন্ন বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক ও রিটার্নিং কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন কমিশনাররা। ওই বৈঠকে নির্বাচনে ম্যাজিস্ট্রেট ও আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্যের সংকট রয়েছে জানিয়ে নিরাপত্তা ছক তৈরির দায়িত্ব চেয়ে বক্তব্য রাখেন একাধিক বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার ও রিটার্নিং কর্মকর্তা। তাদের ওই দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সোমবার আইনশৃংখলা পরিকল্পনার দায়িত্ব প্রশাসনের ওপর ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এক্ষেত্রে কমিশন থেকে একটি গাইডলাইন দেয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ‘সামগ্রিক নিরাপত্তা বিধানে আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিয়োগের দায়িত্বে থাকবেন রিটার্নিং অফিসার। নির্বাচনী এলাকায় মোবাইল ও স্ট্রাইকিং ফোর্স নিয়োগে পুলিশ সুপার, জেলা প্রশাসক ও রিটার্নিং কর্মকর্তার সঙ্গে পরামর্শক্রমে এ সংক্রান্ত পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। ভোট গ্রহণের তিন দিন আগে সংশ্লিষ্ট পুলিশ সুপার নির্বাচন কমিশনে সার্বিক নিরাপত্তা পরিকল্পনা পাঠাবেন।’ কমিশন কর্মকর্তারা জানান, বিগত নির্বাচনগুলোতে নির্বাচনী এলাকায় কতটি টিম থাকবে তা কমিশন থেকে নির্ধারণ করে দেয়া হতো। এবারও কমিশন থেকে একটি নিরাপত্তা পরিকল্পনা আইনশৃংখলা বৈঠকে তোলা হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা টেকেনি।
সূত্র আরও জানায়, আইনশৃংখলা সংক্রান্ত বৈঠকে আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্য সংকটের কথা জানিয়ে বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা নির্বাচনে নিরাপত্তা পরিকল্পনার দায়িত্ব প্রশাসনের ওপর ছেড়ে দেয়ার অনুরোধ জানান। ওই বৈঠকে চট্টগ্রাম ও রাজশাহীর জেলা প্রশাসক বলেন, রিটার্নিং অফিসাররা স্থানীয়ভাবে পরিস্থিতি বিবেচনা করে আইনশৃংখলা বাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় করে নিরাপত্তা পরিকল্পনা করলে ভালো হয়। মুন্সীগঞ্জের পুলিশ সুপার বলেন, মোবাইল ফোর্স সাধারণত ২-৩টি কেন্দ্রের ওপর ভিত্তি করে নিয়োগ করা হয়। পুলিশ সদস্য ঘাটতির কথা বিবেচনা করে কমিশনের প্রস্তাব শিথিল করে মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের দায়িত্ব দেয়া যেতে পারে। লক্ষ্মীপুরের পুলিশ সুপার বলেন, আইনশৃংখলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ ও আইনশৃংখলা পরিকল্পনা প্রণয়নের দায়িত্ব পুলিশ সুপারের ওপর দেয়া প্রয়োজন। তিনি বলেন, নির্বাচনে বিজিবি সদস্য বেশি নিয়োগ দেয়া হলে প্যানিক সৃষ্টি হতে পারে। একই ধরনের বক্তব্য দেন আরও কয়েক কর্মকর্তা।
ইসি সূত্রে জানা গেছে, প্রশাসনের দাবি অনুযায়ী কমিশন এ নির্বাচনের নিরাপত্তায় মোবাইল ফোর্স ও স্ট্রাইকিং ফোর্স এবং বিজিবি মোতায়েনের ক্ষেত্রে পরিবর্তন এনেছে ইসি। এতে প্রতিটি পৌরসভায় পুলিশ, এপিবিএনের সমন্বয়ে একটি করে মোবাইল টিম ও একটি স্ট্রাইকিং ফোর্স মোতায়েনের জন্য বলা হয়েছে। এ হিসাবে ২৩৪টি পৌরসভায় ২৩৪টি করে মোবাইল টিম ও স্ট্রাইকিং ফোর্স থাকবে। যদিও আইনশৃংখলা বৈঠকে কমিশন প্রতিটি ওয়ার্ডে পুলিশের একটি করে মোবাইল টিম হিসেবে ২ হাজার ১৯৩টি ও প্রতি তিন ওয়ার্ডে একটি করে স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে ৭৩১টি টিম মোতায়েনের প্রস্তাব করেছিল। পুলিশের আপত্তির মুখে এখন প্রতিটি পৌরসভায় একটি করে টিম রাখতে বলছে কমিশন। প্রতিটি পৌরসভায় র্যাবের একটি করে টিম রাখার বিষয়টি অপরিবর্তিত রয়েছে। প্রতিটি হেডকোয়ার্টারে র্যাবের স্ট্রাইকিং ফোর্স থাকবে। বিজিবি মোতায়েন সীমিত করা হয়েছে। কমিশনের নিরাপত্তা পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রতিটি পৌরসভায় ১ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েনের কথা বলা হলেও পুলিশের কর্মকর্তাদের আপত্তির মুখে তা সীমিত করা হয়েছে। এখন নির্দিষ্ট ১২০টি পৌরসভায় বিজিবি রাখতে বলছে কমিশন। তবে স্থানীয় প্রশাসন ভৌগোলিক ও স্থানীয় ঝুঁকি বিবেচনায় মোবাইল ও স্ট্রাইকিং টিমের সংখ্যা বাড়াতে পারবে বলে কমিশনের কার্যবিবরণীতে উল্লেখ করা হয়েছে।
নির্বাচন কমিশন সূত্র জানায়, মূলত নির্বাচন পরিচালনার জন্য মাঠপর্যায়ে প্রধান চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে থাকেন রিটার্নিং অফিসার ও আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্যরা। নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ করার ক্ষেত্রে আইনে তাদের পর্যাপ্ত ক্ষমতা ও এখতিয়ার দেয়া হয়েছে। এরই মধ্যে বিভিন্ন পৌরসভায় পুলিশের অনেক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নির্বাচন প্রভাবিত করার অভিযোগ রয়েছে। অভিযোগের সত্যতা পাওয়ায় তিনজন ওসিকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। আরও চারজনের প্রত্যাহারের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এমন অবস্থার মধ্যে আইনশৃংখলা পরিকল্পনার দায়িত্ব পুলিশ প্রশাসনের ওপর ছেড়ে দিয়েছে কমিশন।