অধ্যাপক বিলকিস জাহান::খাদ্যমান, পুষ্টিগুণ ও নিরাপত্তা বিবেচনায় শিশুদের জন্য জন্মের পর থেকে মায়ের দুধই সর্বোচ্চ পুষ্টিকর ও নিরাপদতম খাবার। জন্মের ছয় মাস পর্যন্ত শিশুর বৃদ্ধি ও স্বাস্থ্য কেবল মায়ের দুধেই ঠিক থাকবে। ছয় মাস বয়সের পর মায়ের দুধের পাশাপাশি ঘরে তৈরি সুষম খাবারই শিশুদের জন্য উপযোগী এবং সঠিক পুষ্টিপ্রাপ্তি নিশ্চিত করে। শিশু অধিকারের আন্তর্জাতিক সনদ অনুযায়ী, নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাবার প্রাপ্তি শিশুর জন্মগত অধিকার । ষাট-সত্তরের দশকে মানুষ মায়ের দুধের ওপর নির্ভর করত। তখন প্রথম ছয় মাস বা তারও বেশি সময় ধরে মায়ের দুধই ছিল শিশুদের একমাত্র খাদ্য। তারপর ধীরে ধীরে বাণিজ্যিকভাবে দেশে শিশুখাদ্য এলো। মায়েরাও বিকল্প শিশুখাদ্যের মাধ্যমে প্রভাবিত হলেন।
গত শতকের মাঝামাঝি সময়ে গুড়া দুধ শিল্পের ব্যাপক বিস্তৃতি এবং বাজার তৈরির নীতি বহির্ভূত প্রতিযোগিতার ফলে মানুষের একমাত্র প্রাকৃতিক এই খাবার চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে । পরিণত বয়সের মানুষের জন্য বিপণনের পাশাপাশি মায়ের দুধের বিকল্প হিসেবে শিশুদের জন্যও পাস্তরিত তরল দুধ ও ফর্মূলা গুড়া দুধের ব্যাপক ভিত্তিক বিপণন কার্যক্রম শুরু করে। এই বিপণন কার্যক্রম এক পর্যায়ে আগ্রাসী ও নীতি বহির্ভূত রূপ নেয়। ফলশ্রুতিতে মাতৃদুগ্ধদানের হার ব্যাপকভাবে হ্রাস পায় । বাজারে এখন বিভিন্ন প্রকার শিশুখাদ্য পাওয়া যায়। মাতৃদুগ্ধ শুধুমাত্র মানুষের জন্য নির্ধারিত একমাত্র প্রাকৃতিক খাদ্য। মাতৃদুগ্ধ দান এমন একটি ছন্দবদ্ধ প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া, যা কোনো ক্রমে একবার বন্ধ হয়ে গেলে পুণরায় শুরু করা শুধুমাত্র কঠিন নয়, কখনো রীতিমত অসম্ভব হয়ে পড়ে । কোনো না কোনোভাবে কোনো শিশু একবার মায়ের স্তন থেকে বিচ্ছিন্ন হলে শিশুটি গুড়া দুধের ভোক্তায় পরিণত হয় । আবার, শিশুরাও একবার বোতল, চুষনিতে অভ্যস্ত হলে মায়ের দুধ আর খেতে চায় না । মাতৃদুগ্ধের বাণিজ্যিক বিকল্প বিপণনকারী কোম্পানীসমূহ এ সকল বিষয় ব্যবসা প্রসারের কৌশল হিসেবে নিয়েছে। তাই একই ব্র্যান্ডের বা ব্র্যান্ডনামের বয়সভিত্তিক ক্রম প্রস্তুত করে মাতৃদুগ্ধ বিকল্প গুড়াদুধ বিপণন করছে। অর্থাৎ কোনো শিশু একবার ব্র্যান্ডনামে গুড়াদুধে অভ্যস্ত হয়ে পড়লে, ঐ সময়ে তার বয়স যাই হোক না কেনো, বয়সের নির্দিষ্ট সীমা (ছয় মাস, বারো মাস) অতিক্রমের সাথে সাথে তার জন্য একই ব্র্যান্ডের প্রক্রিয়াজাত গুড়া দুধ বাজারে থাকে। অন্যান্য খাদ্যপণ্যের বিপণনের ক্ষেত্রে এই ধরনের কৌশল গ্রহন করা হলেও মাতৃদুগ্ধ বিকল্প গুড়া দুধের ক্ষেত্রে তা গ্রহনযোগ্য নয়। কারণ কোম্পানীসমূহের এ ধরনের বিপণন কার্যক্রমের ফলশ্রুতিতে পণ্যসমূহের অপ্রয়োজনীয় ও অযৌক্তিক ব্যবহার জীবনের শুরুতেই স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরী করে । শিশু মায়ের দুধের উপকারিতা এবং সবোর্চ্চ পুষ্টি প্রাপ্তি হতে বঞ্চিত হয়। পাশাপাশি শিশুদের সঠিক খাদ্য ও পুষ্টি সম্পর্কে অভিভাবকদের স্বচ্ছ ধারনা না থাকা, বুকের দুধের বিষয়ে আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি, কর্মজীবনের সাথে মাতৃদুগ্ধদান অব্যাহত রাখার সহায়ক পরিবেশ না পাওয়া সহ ইত্যাদি কারণে অতিপ্রক্রিয়াজাত গুড়া দুধের প্রসার বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই শিশুদের নিরাপদ খাবার ও সর্বোচ্চ পুষ্টি প্রাপ্তি নিশ্চিত করা এবং শিশু ও তাদের মায়ের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় এ সকল পণ্যের বিপণন কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা ও এর সদস্য দেশগুলো এ সকল বিষয়ে ঐক্যমত্য পোষন করে ১৯৮১ সালে অনুষ্ঠিত ৩৪তম অধিবেশনে এই সকল পণ্যের জন্য আর্ন্তজাতিক বিপণন নীতিমালা গ্রহন করে এবং সদস্য দেশগুলোকে নীতিমালার আলোকে আইন ও বিধি প্রণয়নের আহ্বান জানায়। বাংলাদেশ দ্রুততম সময়ে ১৯৮৪ সালে অধ্যাদেশ জারি করে এবং ১৯৯৩ সালে বিধিমালা প্রণয়ন করে। ১৯৮১ সালে প্রণীত নীতিমালা অধিকতর যুগোপযোগী ও প্রয়োগযোগ্য করার লক্ষ্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা পরবর্তী বিভিন্ন অধিবেশনে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সুপারিশ প্রণয়ন করে এবং তদানুযায়ী সদস্য দেশসমূহে আইন, বিধি সংশোধন, হালনাগাদ করার আহ্বান জানায়। সরকার ইতিপূর্বের অধ্যাদেশ রহিত করে অধিকতর সঙ্গতিপূর্ণ আইন (২০১৩ সাল) ও বিধিমালা (২০১৭ সাল) প্রণয়ন করেছে। বর্তমানে উক্ত আইন ও বিধিমালা কার্যকর রয়েছে। বাংলাদেশের মতো বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার আরও ১৪৪ টি সদস্য দেশে আন্তর্জাতিক বিপণন নীতিমালার আলোকে এই ধরনের আইন ও বিধি কার্যকর রয়েছে।
আন্তর্জাতিক বিপণন নীতিমালা International code of Marketing of Breast-Milk Substitute-এর আলোকে বিভিন্ন দেশে প্রণীত আইন ও বিধি পর্যালোচনা করে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা ২০২২ সালে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনে নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে সকল দেশের আইন ও বিধিমালা ১০০ স্কোরের ভিত্তিতে নিরীক্ষা করা হয়েছে এবং এতে দেখা যায় বাংলাদেশসহ ৩৪টি দেশের আইন অধিকতর সঙ্গতিপূর্ণ অর্থাৎ স্কোর ৭৫ এর বেশী। বাংলাদেশের আইনের স্কোর ৭৯। দক্ষিন এশিয়ায় অধিকতর সঙ্গতিপূর্ণ মালদ্বীপের আইনের স্কোর ৯৩, আফগানিস্তানের ৯২, ভারতের ৭৮ এবং মধ্যম সঙ্গতিপূর্ণ পাকিস্তানের স্কোর ৭৩, নেপালের ৭১ ও শ্রীলংকার ৬৯ । তবে ভূটানে এই ধরনের কোনো আইন না থাকলেও নীতিমালা রয়েছে ।
বর্তমানে বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে কোম্পানীসমূহের নীতিবর্হিভূত কার্যক্রমের ফলে মাতৃদুগ্ধদানের হার হ্রাস সারা বিশ্বে উদ্বেগের বিষয় হয়ে উঠেছে। সর্বশেষ বাংলাদেশ স্বাস্থ্য ও জনমিতি জরিপ (২০২২)-এ দেখা যাচ্ছে, জন্মের পর থেকে ৬ (ছয়) মাস বয়সী শিশুদের শুধুমাত্র মায়ের দুধ খাওয়ানোর হার বিগত জরিপের তুলনায় শতকরা ১০ ভাগ কমে ৬৫% হতে ৫৫% হয়েছে। ছয় মাস থেকে ২৪ মাস বয়সী শিশুদের শতকরা ৩২ ভাগ আগের দিন মিষ্টি জাতীয় পানীয় গ্রহণ করেছে এবং শতকরা ৪০ ভাগ শিশু অস্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ করেছে। এক্ষেত্রে সম্ভাব্য যে সকল কারণ চিহ্নিত হয়েছে, তন্মেধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কারণ মাতৃদুগ্ধ বিকল্প খাদ্যের বিপণন বৃদ্ধি । এমতাবস্থায় মাতৃদুগ্ধ দানের হার বৃদ্ধি করতে এই আইনের প্রতিপালন জোরদার করা অধিকতর প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে। বিশেষত, মা ও শিশুর স্বাস্থ্য পরিচর্যায় নিয়োজিত স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্র, প্রচার মাধ্যম, বিক্রয় কেন্দ্রে আইনের প্রতিপালন জোরদার করা এবং এ সকল ক্ষেত্রে বিপণন নিয়ন্ত্রণে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন ।
মায়ের দুধের বিকল্প নেই- এ বিষয়ে সবার মধ্যে গণসচেতনতা তৈরি করতে হবে। তাহলে এ ক্ষেত্রে আরও সাফল্য আসবে। হাতেগোনা কিছু দেশ ছাড়া বিশ্বের কোথাও পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুখাদ্যের বিজ্ঞাপন দেওয়া হয় না। তাই আমাদের দেশেও পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুখাদ্যের কোনো বিজ্ঞাপন যাতে না দেওয়া হয় সে বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে হবে। মেডিকেল কারিকুলামে বেশি করে ব্রেস্টফিডিংয়ের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করতে হবে । ব্রেস্টফিডিংয়ের বিষয়টি শিক্ষার্থীর মাইন্ডে এমনভাবে সেট করতে হবে, যাতে পেশাগত জীবনে সে এটি সর্বান্তকরণে অনুসরণ করে। সে এটাকে একটি অপরাধ মনে করবে। স্কুল কারিকুলামেও এটি ঢোকাতে হবে । একজন মাকে কিশোর বয়স থেকে ব্রেস্টফিডিংয়ের বিষয়টি জানতে হবে। তাহলে এটি তার জীবনে মননে গেঁথে যাবে। সে মা হলে তার বাচ্চাকে কোনো অবস্থয় ছয় মাস পর্যন্ত বুকের দুধ ছাড়া অন্য কিছু খাওয়াবে না।
মায়ের দুধের বিকল্প নেই, এ বিষয়ে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় প্রচার চালাতে হবে । গণমাধ্যম, চিকিৎসকসমাজ ও অন্য সবাই মিলে আইন প্রয়োগে উদ্যোগী হতে হবে । প্রচার-প্রচারণায় গণমানুষকে সম্পৃক্ত করতে পারলে উদ্দেশ্য বেশি সফল হবে। বিদ্যমান আইন অনুযায়ী কেউ আইন ভঙ্গ করলে তার তিন বছর সশ্রম কারাদণ্ড ও পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা হবে। কোনো প্রতিষ্ঠানের শিশুখাদ্য খেয়ে যদি কেউ মারা যায় তাহলে সংশ্লিষ্ট কোম্পানি ৫০ লাখ টাকা জরিমানা ও ১০ বছর কারাদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার বিধান রয়েছে। জনস্বাস্থ্য পুষ্টি প্রতিষ্ঠানসহ সবাইকে গ্রামাঞ্চলে মায়েদের সচেতন করার উদ্যোগ নিতে হবে। সংশ্লিষ্ট সবার চেষ্টায় সর্বোপরি জনসচেতনতার মাধ্যমে আগামী দিনে মায়ের দুধের বিকল্প শিশুখাদ্য বর্জন করা সম্ভব হবে।
লেখক : পুষ্টিবিদ
পিআইডি ফিচার