সিলেটপোস্ট ডেস্ক::‘আমার সুবিধার লাগি আমরা টাউনো আইছলাম, এখন আমার পুয়া আর নাই, আমরা আর টাউনো থাকতাম নায়, অউমাসো আমার নাতিনর পরিক্ষা শেষ ওইলে আমরা বাড়িত যাইমুগি’।চোখের পানি মুছে মুছে কথাগুলো বলছিলেন ছাত্রজনতার বৈষম্য বিরোধী আন্দোলন চলাকালে সিলেটে পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে পুলিশের গুলিতে নিহত সাংবাদিক এটিএম তুরাবের প্রায় সত্তোর বছর বয়সী মা মমতাজ বেগম।
শুক্রবার সিলেট জেলা মহিলা দলের নেতৃবৃন্দ তাকে দেখতে গেলে তিনি এসব কথা বলেন।
মহিলা দলের নেতৃবৃন্দের সাথে কথা বলার সময় তিনি বার বার কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। এসময় সিলেট জেলা মহিলা দলের সভাপতি ও জেলা বিএনপির মহিলা বিষয়ক সম্পাদক তাহসিন শারমিন তামান্না, সহ সভাপতি ফেরদৌসী ইকবাল, জেলা বিএনপির সহ মহিলা বিষয়ক সম্পাদক ও জেলা মহিলা দলের দপ্তর সম্পাদক সুলতানা রহমান দিনা তাকে শান্তনা দেন।
এসময় সিলেট জেলা মহিলা দলের সভাপতি তাহসিন শারমিন তামান্না বলেন, তুরাবের লাশ তো স্বজনরা দেখেছেন, তার কবর জিয়ারত করতে পারছেন। কিন্তু আমার ভাই দিনার কোথায় আছেন, কিভাবে আছেন? আমরা তার কিছুই জানি না। এই জাতি ত্রিশ লক্ষ জীবন দিয়ে স্বাধীনতা এনেছে, সময়ের প্রয়োজনে বার বার রক্ত দিয়ে এই স্বাধীনতাকে রক্ষা করেছে। গণখুনি শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে সকল গুম ও খুনের বিচার করা হবে ইনশাআল্লাহ।
এসময় জেলা বিএনপির সহ মহিলা বিষয়ক সম্পাদক ও জেলা মহিলা দলের দপ্তর সম্পাদক সুলতানা রহমান দিনা বলেন, দীর্ঘ ১৬ বছরের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার আন্দোলনে আমাদের অসংখ্য নেতাকর্মীদের গুম ও খুন করা হয়েছে। বিচারের নামে জুডিশিয়ালী কিলিং হয়েছে। জুলাই-আগস্ট বিপ্লবে হাজার হাজার প্রাণ কেড়ে নেয়া হয়েছে। ইতিহাস কখনো কাউকে ক্ষমা করেনি। স্বৈরাচার শেখ হাসিনা ও ফ্যাসিস্টআ ওয়ামীলীগকেও দেশের মানুষ ক্ষমা করবে না।
দৈনিক নয়াদিগন্তের সিলেট প্রতিনিধি ও দৈনিক জালালাবাদের স্টাফ রিপোর্টার এটিএম তুরাব সিলেট শহরে তার বোনের বাসায় থেকে সাংবাদিকতা করতেন। গত বছর তিনের আগে তার বোন অ্যামেরিকায় চলে গেলে ছেলের কষ্টের কথা বিবেচায় পরিবার নিয়ে গ্রামের বাড়ি বিয়ানীবাজার থেকে সিলেট শহরে আসেন তুরাবের মা।
এখন আর ছেলেও নেই, তাই সিলেট শহরে থাকার প্রয়োজনীয়তাও নেই। তাই চলতি মাসে তুরাবের ভাইজির পরিক্ষা শেষ হলেই গ্রামের বাড়ি বিয়ানীবাজারে চলে যাবেন তারা। যে শহরে নিজের ছেলের স্বাচ্ছন্দের জন্য এসেছিলেন, সেই শহর থেকেই ফিরে যাচ্ছেন ছেলেকে ছাড়া।
শহীদ সাংবাদিক এটিএম তুরাবের বড় ভাই আবুল আহসান মোহাম্মদ আজরফ (জাবুর আহমদ) বলেন, মামলার এতদিন পরও পিবিআইর তন্তের কোন অগ্রগতি নেই, এটি রহস্যজনক। আজ পর্যন্ত আমার ভাইয়ের মুলখুনিরা বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সরকারী সুযোগসুবিধা ভোগ করছে। আমরা দিন দিন বিচার নিয়ে হতাশায় নিমজ্জিত হচ্ছি।
তিনি বলেন, পুলিশের যে কর্মকতা আমার ভাইয়ের বুকে গুলি করেছিল, সে সহ তার সহযোগীরা এখনো চাকুরীতে বহাল থেকে মামলার তদন্ত প্রভাবিত করছে। অভিলম্বে তাদেরকে চাকুরিচ্যুৎ করে গ্রেফতার করা হউক। অন্যতায় আমার ভাই হত্যার সঠিক বিচার পেতে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হচ্ছে।
এসময় উপস্থিত ছিলেন- সিলেট জেলা মহিলা দলের শিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক নুরুন নাহার ইয়াসমিন, মহিলা দল নেত্রী জান্নাত জামান চৌধুরী, বিলকিস আক্তার, জুলি পুরকায়স্থ, আমিনা বেগম, মিনা বেগম, রাবিয়া বেগম, রায়না বেগম প্রমূখ।
উল্লেখ্য, উল্লেখ্য, ছাত্রজনতার বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালে গত ১৯ জুলাই (শুক্রবার) জুমার নামাজের পর সিলেট মহানগরের বন্দরবাজার এলাকার কালেক্টরেট জামে মসজিদ এলাকায় বিএনপি ও পুলিশের সংর্ঘষের সময় পেশাগত দায়িত্ব পালন কালে পুলিশের গুলিতে নিহত হন সাংবাদিক তুরাব। হত্যাকান্ডের পাঁচ দিন পর তুরাবের পরিবারের পক্ষ থেকে ৮-১০ জন পুলিশ সদস্যকে অভিযুক্ত করে একটি অভিযোগ দায়ের করেন এসএমপির কোতোয়ালি মডেল থানায়। তবে সেটি মামলা হিসেবে গ্রহণ করেনি তৎক্ষালিন কোতোয়ালী থানা পুলিশ।
পুলিশ ওই সময় জানায়- আগেই তাদের পক্ষ থেকে বিএনপি ও জামায়াতের ৩৪ জনের নামোল্লেখ করে অজ্ঞাত আরও কয়েকশকে আসামি করে একটি মামলা দায়ের করেছে তুরাব হত্যাকান্ডের ঘটনায়। তাই তুরাবের ভাইয়ের দায়ের করা অভিযোগটি সাধারণ ডায়েরি হিসেবে রেকর্ড করেছে তারা। তবে পরবর্তীতে জানা যায়, পুলিশের এজাহারে গুলিতে উল্লেখ ছিল না মৃত্যুর বিষয়টি।
গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামীলীগ সরকারের পতনের পর ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা পালিয়ে গেলে ১৯ আগষ্ট এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান কামালসহ ১৮ জনের নামে আদালতে মামলা দায়ের করা হয়র। সেই সাথে ২০০ থেকে ২৫০ জনকে আসামি করা হয়েছে। শুনানি শেষে মামলার এফআইআর করার নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।
মামলায় অন্যান্য আসামিরা হলেন- অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (ক্রাইম উত্তর) মো. সাদেক দস্তগীর কাউসার, সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-কমিশনার আজবাহার আলী শেখ, সহকারী কমিশনার (কোতোয়ালি) মিজানুর রহমান, এসএমপির কোতোয়ালি মডেল থানার বন্দরবাজার ফাঁড়ির ইনচার্জ কল্লোল গোস্বামী, থানার সাবেক ওসি মঈন উদ্দিন, ওসি (তদন্ত) ফজলুর রহমান, থানার এসআই কাজি রিপন সরকার, মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি ও সিসিকের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর আফতাব উদ্দিন, জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহ-সভাপতি পিযূষ কান্তি দে, সিলেট সিটি করপোরেশনের পিআরও সাজলু লস্কর, সরকারি কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি ও সিসিকের ৩২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর রুহেল আহমদ, জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক সজল দাস অনিক, নগরের চালিবন্দর নেহার মঞ্জিলের বাসিন্দা শিবলু আহমদ (মো. রুহুল আমিন), এসএমপির কনস্টেবল/২১৬৮ সেলিম মিয়া, কনস্টেবল/১৯৫৭ আজহার, কং/২২৫৫ ফিরোজ, কং/১৬০৩ উজ্জ্বল।