সিলেট পোস্ট রিপোর্ট : বিষে ভরা কাঁচামরিচমশলাজাতীয় সবজি কাঁচামরিচ। প্রতিদিন একটি করে কাঁচামরিচ খেলে রক্ত জমাট বাঁধার ঝুঁকি হ্রাস পায়, কমে যায় হৃৎপি-ের বিভিন্ন সমস্যা। এর ভিটামিন হাড়, দাঁত ও মিউকাস মেমব্রেনকে ভালো রাখতে সহায়তা করে, ত্বকে সহজে বলিরেখা পড়ে না। কাঁচামরিচে রয়েছে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট ও ভিটামিন-সি যা শরীরকে জ্বর, সর্দি ও কাশি থেকে রক্ষা করে, মাড়িকে রাখে মজবুত, চুলকে রাখে সুরক্ষিত। বাঙালির দৈনন্দিন রসনাপুজোর অন্যতম এই ব্যঞ্জন এখন হয়ে গেছে বিষাক্ত। কাঁচামরিচে ভয়ঙ্কর মাত্রার ‘অর্গানো সালফার’-এর অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছেন পুষ্টিবিজ্ঞানীরা। এই অর্গানো সালফার মানবদেহের জন্য এতটাই ক্ষতিকর যে, একসঙ্গে মাত্র ৫ গ্রাম পরিমাণ খেলে মৃত্যু অনিবার্য। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) সম্প্রতি প্রকাশিত তাদের সর্বশেষ গবেষণা প্রতিবেদনে এ ভয়ঙ্কর তথ্য তুলে ধরেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্য বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. নাজমা শাহীন এ প্রসঙ্গে গতকাল আমাদের সময়কে বলেন, কাঁচামরিচ অনেক গুণসমৃদ্ধ। অথচ এই মশলাজাতীয় সবজিতে মিলেছে প্রাণঘাতী কীটনাশকের ভয়ঙ্কর অস্তিত্ব। মশলাজাতীয় সবজিসহ যত ধরনের সবজি রয়েছে, এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিষ পাওয়া গেছে কাঁচামরিচে। এতে সর্বোচ্চ ৯১ শতাংশ পর্যন্ত ‘অর্গানো সালফার’-এর অস্তিত্ব ধরা পড়েছে। এর পরই আছে সাধারণ বেগুন (বিটি বেগুন নয়)। এতে পাওয়া গেছে ৮৩ শতাংশ পর্যন্ত।
ড. নাজমা শাহীন বলেন, মরিচের মধ্যে এই যে বিষ, এর ক্ষতিকর দিকগুলো সহসাই বোধগম্য হবে না। কিন্তু এই বিষ ধীরে ধীরে মানুষকে মৃত্যুর দিকে টেনে নিয়ে যাবে। ফসল উৎপাদনে যাচ্ছেতাইভাবে কীটনাশকের ব্যবহারের কারণেই খাদ্যপণ্য আর খাওয়ার উপযোগী থাকছে না।
এদিকে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি), বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল (বিএআরসি), জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউট (বিএসটিআই) এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পুষ্টিবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের সর্বশেষ গবেষণায় জানা গেছে, শুধু অর্গানো সালফারই নয়, মানুষের খাদ্যে মিলছে সিসাসহ বিষাক্ত ও ভারী অনেক ধাতুও। মাঠপর্যায়ে বেড়েছে ছত্রাকনাশকের ব্যবহার। আর প্রক্রিয়াজাতকৃত খাদ্যে ব্যবহার করা হচ্ছে কৃত্রিম রঙ, চিনি ও নানা রাসায়নিক।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বারি) বালাইনাশকের ব্যবহার নিয়ে করা সাম্প্রতিক এক গবেষণা প্রতিবেদনে জানা গেছে, কীট, মাকড় ও ছত্রাক নাশ করতে কৃষকদের মধ্যে বিষাক্ত বালাইনাশক ব্যবহার আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে গেছে। মাঠপর্যায়ে এই রাসায়নিক ওষুধ প্রয়োগের ক্ষেত্রে সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের তদারকি বেশ দুর্বল। রাসায়নিক বিক্রয়কারী কোম্পানিগুলোর ডিলারদের মাধ্যমে কৃষক পর্যায়ে এগুলো অবাধে বিক্রি হচ্ছে। বাংলাদেশে কীটনাশকের ব্যবহার নিয়ে বিশ্বব্যাংকের করা এক গবেষণায়ও এমন চিত্র ফুটে উঠেছে।
নিরাপদ খাদ্য নিয়ে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪ বছর ধরে করা এক গবেষণার ফলাফলে জানা যায়, খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ ও সংরক্ষণে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকারক দ্রব্য প্রয়োগ দিন দিন বাড়ছে। কৃত্রিম রঙ, কৃত্রিম চিনি ও খাদ্য সংরক্ষণে অবৈধভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে রাসায়নিক। এসব রাসায়নিকের অবশেষ উৎপাদিত শস্য, সবজি, ফল ও দুধের মধ্যে থেকে যাচ্ছে; যা মানবদেহে ক্যানসার, হৃদরোগসহ নানা জটিল ব্যাধির জন্ম দিচ্ছে। দেশের ৭টি বড় খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ কোম্পানির পণ্য পরীক্ষা করে এ তথ্য পেয়েছে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়।
অন্যদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খাদ্য ও পুষ্টিবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও সমুদ্রবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট প্রধান খাদ্যগুলো পরীক্ষা করে আরও আশঙ্কাজনক ও ক্ষতিকারক বস্তুর সন্ধান পেয়েছে। তাদের একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে, কীটনাশক, রাসায়নিক সারের মাত্রাতিরিক্ত প্রয়োগ এবং শিল্পকারখানা থেকে নির্গত বিষাক্ত বর্জ্য মাটি ও পানির মাধ্যমে শস্য, ফল ও সবজিতে প্রবেশ করছে, যা খাদ্যের মাধ্যমে চলে যাচ্ছে মানবদেহে।
এ প্রসঙ্গে ড. নাজমা শাহীন বলেন, ফসল রোপণ থেকে শুরু করে উৎপাদনের প্রতিটি স্তরে বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক ওষুধ মাত্রাতিরিক্তভাবে প্রয়োগ করা হচ্ছে। বিভিন্ন খাদ্য পরীক্ষা করে এমন সব বিষাক্ত ধাতু পাওয়া গেছে, যা খুবই উদ্বেগজনক। কিন্তু এ বিষয়ে কোনো পূর্ণাঙ্গ চিত্র সরকারের কাছে নেই। তিনি মনে করেন, সমস্যা চিহ্নিত না করে একের পর এক আইন করে এক্ষেত্রে ইতিবাচক ফল পাওয়া যাবে না।