কুলাউড়া প্রতিনিধি::কুলাউড়া উপজেলার ভারত সীমান্তবর্তী ৩ ইউনিয়নের একাধিক স্পট দিয়ে অবাধে আসছে মাদকদ্রব্য। এসব মাদকদ্রব্য এখন হাত বাড়ালেই মিলছে কুলাউড়ার বিভিন্ন হাট-বাজার ও পয়েন্টে। এছাড়াও সীমান্তবর্তী ৩ ইউনিয়নের বিভিন্ন স্পট দিয়ে অবৈধভাবে অবাধে মানবপাচার কার্যক্রম চলছে দেদারছে। স্থানীয় দালালরা মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে উভয় দেশের পাসপোর্ট বিহীন বিভিন্ন মানুষকে কাটাতারের উপর দিয়ে পারাপার করছে। বিশেষ করে আওয়ামীলীগ সরকারের পতনের পর দেশের বিভিন্ন জায়গার দুর্নীতিবাজ নেতাকর্মীরা এই সীমান্ত দিয়ে রাতের আধঁারে স্থানীয় দালাল ও নেতাকর্মীদের সহায়তায় সহজে ভারতের ওপার কৈলাশহর, মাগুরলী, লাটিউরা, রাঙ্গাউটি ও টিলাবাজার দিয়ে ভারতে প্রবেশ করছে। ভারত সীমান্তবর্তী শরীফপুর, পৃথিমপাশা, কর্মধা এই তিন ইউনিয়নের ৮-১০টি স্পট দিয়ে মূলত মাদকের আনাগোনা। শরীফপুর, পৃথিমপাশা, কর্মধা, হাজীপুরের বিভিন্ন বাজার ও কুলাউড়ার দক্ষিণাঞ্চলের বৃহৎ বাজার রবিরবাজারকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে মাদকের বিশাল সিন্ডিকেট। পাচারকারীরা নিরাপদ রুট হিসেবে ব্যবহার করে আসছে এইসব এলাকার একাধিক হাট-বাজারকে। অন্যদিকে শরীফপুরের লালারচক সীমান্ত দিয়ে কিশোরী স্বর্ণা দাসকে ভারতে পাচারকালে বিএসএফের গুলিতে নিহতের ঘটনায় কয়েকদিন ওই ইউনিয়নের বিভিন্ন স্পট দিয়ে মাদক ও মানব পাচার বন্ধ থাকলেও শারদীয় উৎসবকে সামনে রেখে সক্রিয় হয়ে উঠেছে মাদক ও মানব পাচারে জড়িত চক্রগুলো। তাছাড়া দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে গত ৫ আগষ্টের পর বাংলাদেশী নাগরিকদের ভারতের ভিসা প্রাপ্তি অপ্রত্যাশিতভাবে কমে যাওয়ায় সীমান্ত দিয়ে অবৈধভাবে অনুপ্রবেশও বেড়েছে। জানা যায়, কুলাউড়া উপজেলার সীমান্তবর্তী কর্মধা, পৃথিমপাশা, শরীফপুর ইউনিয়নের ভারতীয় সীমান্তের ১৮৪২ থেকে ১৮৫১ নং আন্তর্জাতিক সীমানা পিলার দিয়ে দীর্ঘদিন ধরে মাদকসহ বিভিন্ন পণ্য চোরাচালান হয়। বর্তমানে ভিসা জটিলতায় ভারতে অবস্থানরত অনেক বাংলাদেশীর নিকটাত্মীয় ও পূজায় ভারতে যেতে পারছেন না। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে সীমান্ত এলাকার চোরাকারবারীরা টাকার বিনিময়ে অনেককেই অবৈধভাবে অনুপ্রবেশ করাতে বেশ সক্রিয় হয়ে উঠেছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে চোরাকারবারীরা মাদক ও অবৈধ অনুপ্রবেশ করাতে সীমান্তে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট তৈরি করে রেখেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ ফঁাকি দিয়ে চোরাকারবারীরা এতোটা বেপরোয়া যে কারণে স্থানীয় বাসিন্দারা ভয়ে কোন প্রতিবাদ করতে পারেন না।
চোরাকারবারীদের দৌরাত্ম্য সীমান্তবর্তী এলাকার নিরীহ অনেক পরিবার রয়েছেন আতঙ্কে। সূত্রে জানা যায়, সীমান্তবর্তী পৃথিমপাশা, কর্মধা, শরীফপুর ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রাম দিয়ে বিদেশি মদ, ফেনসিডিল, ইয়াবা, গঁাজা, নাসির বিড়ি, পার্টস, পোশাক, মোটরযানের টায়ার-টিউব ইত্যাদি অবাধে আসছে। বর্তমানে দুই দেশের চোরাকারবারীরা ২০-২৫ হাজার টাকার বিনিময়ে অবৈধভাবে অনুপ্রবেশ করাচ্ছে। কর্মধা ইউনিয়নের সীমান্তবর্তী দূর্গম পাহাড়ি এলাকা ও পৃথিমপাশা ও শরীফপুর ইউনিয়নের মনু নদীর অবস্থানগত কারণে এসব এলাকায় যোগাযোগের করুণ অবস্থা ও ভৌগোলিক কারণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য কর্তৃক ঠিকমতো ওই সব এলাকায় গিয়ে অভিযান চালাতে না পারার কারণে পাচারকারীরা মাদকদ্রব্য নিয়ে অতি সহজে যাতায়াত করে থাকে। চোরাকারবারিরা এসব মাদকদ্রব্য সীমান্ত পার করে রবিরবাজার ও আশপাশের এলাকা দিয়ে বিভিন্ন জায়গায় চালান দিয়ে থাকে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সীমান্ত এলাকার কয়েকজন বাসিন্দা জানান, শরীফপুর ইউনিয়নের আলাল মিয়া, হাসিব মিয়া, হামজা, জিয়াউল হক, বাবুল, ফখর মিয়া, দুই সহোদর ওয়াছকুরুনি ও ফাজকুরুনি, রুমেল মিয়া, লাবিব, আবু তালিব, জিয়াউল, মোহাম্মদ আলী, সামছু, আলাউদ্দিন, তাজুল, সালাম, তমজিদ এরা সীমান্তে মানবপাচারসহ বিভিন্ন চোরাকারবারীর সাথে জড়িত বলে স্থানীয় একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে। আর এদের নেপথ্যে থেকে সহযোগিতা করে যাচ্ছেন স্থানীয় মেম্বার লাল মিয়া, আলাল, নজরুল ও তাজুলসহ অনেকেই। এছাড়াও কর্মধা ইউনিয়নের মুরইছড়া নতুন বস্তির শাহীন মিয়া, ছায়েদ মিয়া, টাট্টিউলি গ্রামের আহাদ আলী, আসুক মিয়া ও পৃথিমপাশা ইউনিয়নের ধামুলী গ্রামের ছোবহান মিয়া, গণকিয়া এলাকার দুদু মিয়া দীর্ঘদিন থেকে সীমান্তে মাদকদ্রব্য, মানবপাচারসহ বিভিন্ন চোরাকারবারী পেশায় জড়িত রয়েছেন।
উল্লেখ্য, ২২ সেপ্টেম্বর রাতে পৃথিমপাশা ইউনিয়নের শিকড়িয়া সীমান্ত দিয়ে ভারত থেকে বাংলাদেশে অবৈধভাবে অনুপ্রবেশের সময় এক বাংলাদেশীকে আটক করেছে বিজিবি। আটককৃত ব্যক্তি হলেন পৃথিমপাশা ইউনিয়নের গণকিয়া গ্রামের মহরম আলীর ছেলে মোঃ খয়জুর আলী। বিজিবি তাকে আটক করে কুলাউড়া থানা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করেছে। এর আগে ৩ সেপ্টেম্বর জুড়ীর স্কুল শিক্ষার্থী স্বর্ণা দাস লালারচক সীমান্ত দিয়ে মায়ের সাথে অনুপ্রবেশের সময় বিএসএফের গুলিতে নিহত হন। টাকার বিনিময়ে চোরাকারবারীরা স্বর্না দাস ও তার মা সহ ১০ জনকে ভারতে অনুপ্রবেশের চেষ্টা চালায়। এ সময় গুলিতে স্বর্ণা দাস নিহত হলেও আরও তিনজন গুলিবিদ্ধ হন। চলতি বছরের ১৭ মার্চ পৃথিমপাশা ইউনিয়নের শিকড়িয়া সীমান্ত এলাকায় বিএসএফের গুলিতে মুরইছড়া বস্তি এলাকার বাসিন্দা আছকির মিয়ার ছেলে কিশোর সাদ্দাম (১৩) নিহত হন। এ সময় তার সাথে থাকা একই গ্রামের মৃত ছাদই মিয়ার ছেলে সিদ্দেক (৩৬) আহত হন। ১৯ সেপ্টেম্বর রাতে মুরইছড়া সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশের সময় ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর হাতে বাংলাদেশের টঙ্গির বাসিন্দা মোঃ সাহিদ (৩৮), মানিকগঞ্জের বাসিন্দা আকলিমা বেগম আটক হন। বিএসএফ আটক দুজনকে ত্রিপুরার ইরানি থানায় হস্তান্তর করে মামলা দায়ের করে। আটক ব্যক্তিরা এসময় জানান দালালের মাধ্যমে ২০-৩০ হাজার টাকার বিনিময়ে তারা ভারতে অনুপ্রবেশ করেন বাংলাদেশের বিভিন্ন সীমানা দিয়ে।
সীমান্তবর্তী শরীফপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান খলিলুর রহমান বলেন, দুর্গম এলাকা হওয়ায় আমাদের ৫টি বিজিবি ক্যাম্প থাকা সত্বেও মাদক ও মানবপাচার রোধ সম্ভব হচ্ছে না। এ নিয়ে ইউনিয়ন পরিষদে জনপ্রতিনিধি, এলাকাবাসী ও বিজিবির সমন্বয়ে সভা করে মাদক ও মানবপাচার রোধের বিষয়ে কঠোর সিদ্ধান্ত হয়েছে আমরা তা প্রতিরোধে সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো।
অন্য দুই সীমান্তবর্তী ইউনিয়ন পৃথিমপাশা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এম জিমিউর রহমান চৌধুরী ও কর্মধা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মুহিবুল ইসলাম আজাদ বলেন, ভারতের সাথে বাংলাদেশের সীমান্ত থাকায় আমাদের ইউনিয়ন দিয়ে মাদক চোরাচালানের অবাধ বিচরণ রয়েছে। আমরা ইউনিয়ন পরিষদের উদ্যোগে মাসিক সভা ও উপজেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির মিটিংয়ে বিষয়টি উপস্থাপন করেছি। অবৈধ চোরাচালান ও অনুপ্রবেশ ঠেকাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর টহল ও নজরদারি বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।
মৌলভীবাজার পুলিশ সুপার এম কে এইচ জাহাঙ্গীর হোসেন (পিপিএম) জানান, সীমান্তে মানবপাচার ও চোরাচালানকারবারীদের বিরুদ্ধে পুলিশ জিরো টলারেন্স দেখাবে। বিশেষ করে সীমান্তে কাটাতারেরর উপর দিয়ে অবৈধভাবে কোনো দুর্নীতিবাজ লোকজন ও সাধারণ জনগণ যাতে ওপারে যেতে না পারে সেজন্য বিজিবির পাশাপাশি সীমান্তে পুলিশ পুরো দমে তৎপর ।
এব্যাপারে শ্রীমঙ্গল ৪৬ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফট্যানেন্ট কর্নেল মোহাম্মদ মিজানুর রহমান সিকদার বলেন, সীমান্তে অনুপ্রবেশ, মাদক ও চোরাচালান প্রতিরোধে বিজিবি সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় রয়েছে। তিনি স্থানীয়দের সহযোগিতা ও সচেতনতা কার্যক্রম বৃদ্ধি এবং চিহ্নিত কারবারীদের ধরতে অভিযান অব্যাহত থাকবে বলে জানান ।
ছবি ক্যাপশন: কুলাউড়া উপজেলার পৃথিমপাশা ইউনিয়নের শিকরিয়া সীমান্ত, ওপারে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের মাগুরুলী এলাকা।