সিলেটপোস্ট রিপোর্ট : আন্তর্জাতিক ‘পারফিউম মার্কেটে’ বিশেষ করে আতর শিল্পে বিশ্বজুড়ে মৌলভীবাজারের বড়লেখার আলাদা পরিচয় রয়েছে। এ উপজেলা থেকে আগর এখন ছড়িয়ে গেছে দেশ-বিদেশের নানাপ্রান্তে। আগর গাছ থেকে পাওয়া যায় আতর আর সুজানগরকে বলা হয় আগরের আদি রাজধানী। এখানকার আগর তেলের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে দেশে-বিদেশে। এক সময় মধ্যপ্রাচ্যে এই তেলের চাহিদা ব্যাপক থাকলেও এখন বাজার প্রায় বিশ্বজুড়ে।
১৯৪০ সালের দিকে মৌলভীবাজারের বড়লেখায় আগর শিল্পের বিস্তৃতি ঘটে। তবে স্থানীয় লোকজন জানিয়েছেন, এ এলাকায় আগর আহরণ হচ্ছে প্রায় শতাধিক বছর থেকে। পঞ্চাশের দশকের আগ পর্যন্ত সুজানগরে সারা বিশ্বের প্রায় শতভাগ আগর তৈরি হতো বলেও জানিয়েছেন তারা। এখনও বিশ্বের ৯০ শতাংশের মতো আতর ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেন সুজানগরের লোকেরাই। আর বিশ্বে আতরের চাহিদার ৩০ শতাংশের জোগানও আসে বাংলাদেশের আগর থেকে।
প্রথম দিকে পার্শ্ববর্তী পাথারিয়া পাহাড় ও ভারতের পাহাড়ি এলাকা থেকে আগর কাঠ সংগ্রহ করে এনে সুজানগরে আগর তৈরি হতো। ষাটের দশকের শেষ দিকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ভারতীয় আগর কাঠ চোরাইয়ের অভিযোগে কারখানা মালিকদের ধরে নিয়ে যায়। তখন পেশার তাগিদে অনেক ব্যবসায়ী ও কারিগর ভারত এবং মধ্যপ্রাচ্যে পাড়ি জমান। এতে সুজানগর এলাকায় আগর উৎপাদন ও বাণিজ্যে কিছুটা ভাটা পড়লেও হারিয়ে যায়নি।
বর্তমান প্রজন্মের হাত ধরে এই শিল্প এখন শুধু ঘুরেই দাঁড়ায়নি, ছড়িয়েছে সিলেটের আনাচ-কানাচ থেকে সারাদেশে। সিলেটের প্রায় প্রতিটি উপজেলায় আগরের বাগান পাওয়া যায়, অধিকাংশ বাগানই বাণিজ্যিকভাবে চাষ করা হচ্ছে। এ প্রজন্মের তরুণরা নিজেরাই এখন গাছ লাগাচ্ছেন, বাগান করছেন। তাদের অনেকে আগর-আতর উৎপাদন করেন না, শুধু আগর গাছের বনায়ন করে উৎপাদনকারীদের কাছে গাছ বিক্রি করে দেন।
সম্ভাবনাময় এই শিল্পের দ্রুত প্রসারের ফলে সিলেট বিভাগে এখন পাঁচ শতাধিক আগরের ছোট-বড় কারখানা রয়েছে। এক সময় বড়লেখা অঞ্চলে গ্যাসের সরবরাহ না থাকায় কারখানাগুলোতে উৎপাদনে নানা সমস্যায় পড়তেন ব্যবসায়ীরা। তবে গত ক’বছর ধরে গ্যাস সরবরাহ পাওয়ায় কারখানায় জ্বালানি নিয়ে আর ঝামেলায় পড়তে হচ্ছে না তাদের। অয়েল ও সলিড এই দু’ধরনের আগর বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রফতানি হয়। যদিও ইদানীং সলিডের চেয়ে অয়েলের চাহিদাই বেশি বলে আগর ব্যবসায়ীরা জানান।
আগর কাঠের মানের তারতম্যের জন্য এগুলোকে ডবল সুপার, আগর প্রপার, কলাগাইছ আগর এবং ডোম আগর হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এসব আগর কাঠের বর্তমান বাজারদর প্রতি কেজি সর্বনিম্ন একশ’ ডলার থেকে ১৫ হাজার ডলার পর্যন্ত। ১ ঘনফুট আগর কাঠের ওজন প্রায় সাড়ে ১৩ কেজি। আগর কাঠের চিপস (সলিড) মধ্যপ্রাচ্যের বাজারে আরও উচ্চমূল্যে বিক্রি হয়ে থাকে। আরব শেখরা এসব কাঠের চিপস কিনে নিয়ে সুগন্ধি ধূপ হিসেবে ব্যবহার করেন।
অন্যদিকে বর্তমানে দেশীয় বাজারে ১ তোলা (১১.৬২ গ্রাম) আগর তেলের দাম প্রায় ৬ থেকে ৭ হাজার টাকা। সে হিসেবে প্রতি কেজি আগর তেলের দাম পড়ে ৪ লাখ ৩০ হাজার থেকে ৬ লাখ টাকা পর্যন্ত। এক সময় মূলত আরব আমিরাত, সৌদি আরব, ভারত এবং সিঙ্গাপুরের ব্যবসায়ীরা এই তেলের প্রধান ক্রেতা ছিলেন। তবে সাম্প্রতিক সময়ে ইউরোপ-আমেরিকার বাজারেও এ দেশের আগর অয়েলের বাজার বিস্তৃত হয়েছে।
মধ্যপ্রাচ্যে আগর রফতানির সঙ্গে জড়িত সুজানগরের কয়েকজন ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, বড়লেখায় যে আগর তেল পাঁচ হাজার টাকায় বিক্রি হয়, সেটা আরব আমিরাত বা সৌদি আরবে অন্তত তিনগুণ বেশি দামে বিক্রি হয়। এ আগর তেলকে পরিশোধিত করে সুগন্ধি আতরসহ নানা ধরনের পারফিউম তৈরি করা হয়। এ ছাড়া নানা ধরনের ইউনানী ওষুধ তৈরিতেও এ আগর তেল ব্যবহার হয়। আগর কাঠের তৈরি চিপসের সুগন্ধি ধূপ হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যসহ সৌদি আরবে ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।
সৌদি আরব, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, কুয়েত ও দুবাইয়ে সুজানগরের বাসিন্দাদের আগর-আতর কারখানা রয়েছে বলে জানান বাংলাদেশ আগর অ্যান্ড আতর ম্যানুফেকচার অ্যান্ড এক্সপোর্টার অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারি কবির আহমদ চৌধুরী। তিনি বলেন, সুজানগরের আগরের চাহিদা বিশ্বজুড়ে। এক সময় সীমিত আকারে আগর চাষ হলেও এখন অনেকে আগ্রহী হয়েছেন।
দেশের অনেক জায়গায় ব্যক্তিগত উদ্যোগের পাশাপাশি সরকারি উদ্যোগে বন বিভাগ আগরের বনায়ন করা হচ্ছে। কৃত্রিম উপায়ে এসব গাছ থেকে আগর উৎপাদন করা হয়।
সিলেট বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, আগর বনায়ন প্রকল্পে সামাজিক বনায়নের মাধ্যমে মৌলভীবাজারের বড়লেখা ছাড়াও জুড়ী ও কমলগঞ্জ উপজেলায় আগর গাছ রোপণ করা হয়েছে। একইভাবে সিলেটের সদর এবং হবিগঞ্জের রাজকান্দি ও রঘুনাথ এলাকায় আগরের বনায়ন করা হয়েছে। এ ছাড়া ব্যক্তিগত উদ্যোগে ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে সিলেটের প্রায় প্রত্যেক উপজেলায় এখন আগরের চাষ হচ্ছে। অনেকে পতিত জমির পাশাপাশি বাড়ির আশপাশের খালি জায়গায় আগরের গাছ রোপণ করেন। সাধারণত বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহারের উপযোগী হতে আগর গাছের প্রায় সাত বছর সময় লাগে।
যদিও গাছের বয়স যত বেশি হয়, গাছটি ততই মূল্যবান হয়। তাই গাছগুলো বছরের পর বছর লালন-পালন করে থাকেন। তবে দ্রুততার জন্য এখন ব্যবসায়ীরা কৃত্রিম উপায়ে গাছে আগর উৎপাদন করেন। আগরের গাছ রোপণের অন্তত চার বছর পর সারা গাছে লোহার পেরেক ঢুকিয়ে তা আরও তিন বছরের জন্য রেখে দেওয়া হয়। ৬০-৭০ ফুট উচ্চতা হলে গাছটি কেটে ছোট ছোট টুকরা করে তা কিছু দিন পানিতে ভিজিয়ে রাখা হয়। এরপর কারখানায় বিশেষভাবে নির্মিত চুল্লিতে রেখে তাপ দেওয়া হয়। তাপ দেওয়ার পর বিশেষ ব্যবস্থায় আগর থেকে আগর অয়েল পাওয়া যায়। যা পরবর্তী সময় আতরসহ সুগন্ধি তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। অন্যদিকে গাছের টুকরো থেকে সলিড আগর পাওয়া যায়।
আগরের বৈজ্ঞানিক নাম Aquilaria agallocha আগর বাণিজ্যিকভাবে ‘Agor&_’Aloe Wood’ ও ‘Eagle Wood’ নামে পরিচিত। আগর গাছের রেসিন (Resin) অংশ হতে প্রক্রিয়াজাত করে আগর অয়েল উৎপন্ন করা হয়। আগরের এই রেসিন উৎপন্ন হয় নির্দিষ্ট কিছু ছত্রাক আক্রমণ করে গাছের ভেতর বিস্তার লাভ করলে। আগে যেসব গাছে পুরনো ক্ষত বা গর্ত থাকত, সেগুলোতে সাধারণত ছত্রাকের আক্রমণ হয়ে আগর পাওয়া যেত। এখন কৃত্রিমভাবে গাছে পেরেক ঢুকিয়ে ক্ষতের সৃষ্টি করে ছত্রাকের বিস্তার ঘটানো হয়। ছত্রাকের বিস্তারের অনুকূল তাপমাত্রা ও আর্দ্রতার জন্য বর্ষার শেষে বা শরতের প্রথম দিকে গাছে পেরেক ঢোকানো হয়।
পেরেক ঢোকানোর জন্য নির্দিষ্ট মৌসুম ভালো হলেও আগর গাছ যে কোনো পরিবেশে জন্মাতে পারে। তবে বৃষ্টিপাত বেশি, আবার সমতল ভূমির মতো পানি জমে থাকে না, আর্দ্রতা ও তাপমাত্রা রেসিন উৎপাদনে সহায়ক ছত্রাকের জন্য উপযোগী; এমন পরিবেশে আগর উৎপাদনের জন্য উৎকৃষ্ট। এজন্যই সিলেট অঞ্চলে আগরের চাষ বিস্তার লাভ করেছে। এ ছাড়া অনুকূল পরিবেশের জন্য চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকা আগর শিল্প প্রসারের জন্য উপযুক্ত। বীজ থেকে জুন-জুলাই মাসে আগর গাছের চারা করা হয়। পরবর্তী সময়ে ১০-১২ ফুট দূরত্বে তা রোপণ করা হয়।