নিজস্ব প্রতিবেদক : ‘আজি হতে শতর্বষ পরে/কে তুমি পড়িছ বসি আমার কবিতাখানি/শত কৌতূহল ভরে…’ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একশ’ বছরেরও বেশি আগে তাঁর পাঠকদের প্রতি এ জিজ্ঞাসা রেখেছিলেন। সেই চিরজাগরূক, বাঙালির আত্মিক মুক্তি ও সার্বিক স্বনির্ভরতার প্রতীক, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের উত্কর্ষের অন্যতম শীর্ষ রূপকার কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৫৪তম জন্মজয়ন্তী আজ পঁচিশে বৈশাখ।
১৫৩ বছর আগে এই দিনে ১২৬৮ বঙ্গাব্দে (৬ মে ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দ) কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারে জন্ম নেন তিনি। সুখে-দুঃখে, সঙ্কটে-সম্ভাবনায় বাঙালির ঘরের মানুষ হয়ে কাটিয়ে দেন দীর্ঘ জীবন। হূদয় দিয়ে অনুভব করেন মানুষের কষ্ট, বেদনা, আবেগ। সুর ও বাণী, গল্প ও ছবির মধ্য দিয়ে পথ দেখান মুক্তির।
প্রাণের অর্ঘ্যে বাঙালি আজ স্মরণ করছে এই বিশ্ববরেণ্য কবিকে। নিজেরই লেখা গানে, কবিতায়, বাণীতে অর্পণ করছে অসীম শ্রদ্ধা। নানা দিকে নানা আয়োজনে উচ্চারিত হচ্ছে কবির প্রতি মানুষের অন্তহীন ভালোবাসা।
বিশাল পৃথিবীর উন্মুক্ত দিগন্তে সফল বিচরণ ছিল রবিঠাকুরের। মানুষকে শুনিয়েছেন বিভেদের মাঝে সাম্যের বাণী। তাঁর মানবতা আর মানবিকতার ধর্ম ছুঁয়ে গেছে বাঙালির হূদয়। বিশ্বসাহিত্যের উজ্জ্বলতম নক্ষত্র কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা ও বাঙালির শৈল্পিক অহঙ্কারের এক বিশ্বব্যাপ্ত নাম।
বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী, কালজয়ী এ কবি জীবন ও জগেক দেখেছেন অত্যন্ত গভীরভাবে, যা তাঁর কবিতা, ছোটগল্প, উপন্যাস, নাটক, গীতিনাট্য, প্রবন্ধ, ভ্রমণকাহিনী, সংগীত ও চিত্রকলায় সহস ধারায় উত্সারিত হয়েছে। সাহিত্য, সংগীত ও শিল্পমাধ্যমের প্রতিটি শাখায় তাঁর অনায়াস বিচরণ সত্যিই বিস্ময়কর।
তিনি ছিলেন শান্তির কবি, মানবতার কবি, প্রকৃতির চিরন্তন সৌন্দর্য ও বৈচিত্র্যের সাধক। ১৯১৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার অর্জন করে তিনি বাংলা সাহিত্যের বৈশ্বিক অভিযাত্রাকে বেগবান করেছেন। অমৃতসরে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ১৯১৫ সালে ব্রিটিশ রাজের দেওয়া ‘নাইট’ উপাধি অবলীলায় প্রত্যাখ্যান করেন ১৯১৯ সালে। প্রাচীন ভারতীয় তপোবনের আদলে প্রতিষ্ঠিত বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় তাঁর বিপুল কর্মকাণ্ডের সাক্ষী।
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, ২৪ বছরের স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং মহান মুক্তিযুদ্ধসহ সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে রবীন্দ্রনাথের লেখনী মুক্তিকামী বাঙালিকে উজ্জীবিত করেছে। তাঁর জাতীয়তাবোধ বাঙালির অনন্ত প্রেরণার উত্স। কবির প্রতি অন্তহীন ভালোবাসায় ১৯৬১ সালে বৈরী পাকিস্তানি শাসকচক্রের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে বাঙালি যেমন রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষ পালন করেছে, তেমনি ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও গান হয়ে উঠেছিল মুক্তিকামী বাঙালির সাংস্কৃতিক সহায়সূত্র।
জীবনের প্রতিটি সমস্যা-সঙ্কট, আনন্দ-বেদনা এবং আশা-নিরাশার সন্ধিক্ষণে রবীন্দ্রসৃষ্টি আমাদের চেতনাকে স্পর্শ করে। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন প্রকৃতিলগ্ন ও জীবনমুখী শিক্ষাদর্শনের পথপ্রদর্শক। বাংলাদেশের মাটি ও মানুষের তিনি একান্ত আপনজন। শিলাইদহ ও পতিসর অঞ্চলেই তিনি রচনা করেছিলেন ছিন্নপত্র-এর সিংহভাগ এবং অসামান্য কিছু গান।
এই অঞ্চলের গ্রামীণ দরিদ্র শ্রেণির মানুষের জন্য তাঁর পল্লী উন্নয়ন প্রচেষ্টা আজও আমাদের কাছে অনুসরণীয় হয়ে আছে। রবীন্দ্রনাথের বাবা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও মা সারদা দেবী। ১৫ সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন চতুর্দশতম। পিতামহ ছিলেন প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর। তাঁদের পূর্বপুরুষ ছিলেন পূর্ববঙ্গের অধিবাসী। বাণিজ্য সূত্রে পশ্চিমবঙ্গে গিয়ে বসবাস শুরু করেন।
পরে জমিদারি সূত্রে পুনরায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বসতি গড়ে ওঠে বাংলাদেশে। গাজীপুর, সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর, নওগাঁর পতিসর ও কুষ্টিয়ার শিলাইদহে গড়ে তোলেন কুঠিবাড়ি। শ্বশুরবাড়ি ছিল খুলনার দক্ষিণ ডিহিতে। জমিদারি দেখভালের পাশাপাশি নিমগ্ন ছিলেন পল্লী উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নে। নির্মাণ করেছেন রাস্তাঘাট। প্রতিষ্ঠা করেছেন শিক্ষালয়-হাসপাতাল। জলকষ্ট নিবারণে খনন করেছিলেন দিঘি।
মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের বিজয় অর্জনের পর রবীন্দ্রনাথের লেখা গান ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতের মর্যাদা পেয়েছে। ভারতের জাতীয় সংগীত ‘জনগণমন-অধিনায়ক জয় হে ভারত ভাগ্যবিধাতা’-ও তাঁরই রচনা। তিনি ছিলেন একাধারে কবি, কথাশিল্পী, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার, নাট্যাভিনেতা, সংগীত রচয়িতা, সুরকার, গায়ক ও চিত্রশিল্পী। সৃষ্টিশীলতার সমান্তরালে সমানভাব চালিয়ে গেছেন ধর্ম, দর্শন, রাজনীতি ও সমাজভাবনা।
লিখে রেখে গেছেন সহস্রাধিক কবিতা, ২৪টি নাটক-নাটিকা ও গীতিনাট্য, আট খণ্ডের ছোটগল্প, আটটি উপন্যাস, আড়াই হাজারের বেশি গান। তাঁর আঁকা ছবি ও রেখাচিত্রের সংখ্যাও দুই হাজারের ওপর। লিখেছেন বিজ্ঞান ও দর্শনের বই। তাঁর ডায়রি ও চিঠিপত্র আজ মানুষের জন্য অমূল্য।
তারপর একদিন বাতাসে তুলে বিরহের সুর, চলে যান দূরে-বহুদূরে। টানা চার বছর রোগভোগের পর ১৯৪১ সালের ৭ আগস্ট (২২ শ্রাবণ ১৩৪৮) জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির উপরতলার একটি কক্ষে প্রাণত্যাগ করেন। রেখে যান মানুষের জন্য অমোঘ আশীর্বাণী-‘হে নূতন/দেখা দিক আর-বার জন্মের প্রথম শুভক্ষণ।/তোমার প্রকাশ হোক কুহেলিকা করি উদ্ঘাটন/সূর্যের মতোন।’
রবীন্দ্রজয়ন্তী উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন। বাণী দিয়েছেন বিরোধীদলীয় নেতা বেগম রওশন এরশাদসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ।
রাষ্ট্রপতি তাঁর বাণীতে বলেন, রবীন্দ্রনাথকে স্মরণ মানেই মহত্ মানবিক মূল্যবোধকে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন, যা ধর্ম-বর্ণ ও গোত্রের সঙ্কীর্ণ সীমা ভেদ করে রূপসাগরে গান গায় অরূপরতনের। কবির এই অরূপরতন তো প্রকৃতপক্ষে তাঁর জীবনদর্শনেরই নাম, যে দর্শনের মূলে রয়েছে সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নার শিল্পিত রূপায়ণ। বাংলা সাহিত্যের সর্ব শাখায় তো বটেই বাঙালি সংস্কৃতির নানা ক্ষেত্রকে প্রায় একক চেষ্টায় তিনি দান করেছেন নতুনতর মাত্রা।
প্রধানমন্ত্রী তাঁর বাণীতে বলেন, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতির স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে কালোত্তীর্ণ বিশ্বকবির সৃষ্টিকে প্রেরণা হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। কবিগুরুর অমর সৃষ্টি ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটি জাতির পিতা বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে গ্রহণ করেন, যা দেশের মানুষের মনে সঞ্চারিত করেছে দেশপ্রেমের নতুন প্রেরণা।
বিশ্বব্যাপী দ্বন্দ্ব্ব, সংঘাত ও বৈষম্যের বিলোপ সাধন এবং ধর্ম-বর্ণ-ভাষার বৈচিত্র্য সমুন্নত রাখতে রবীন্দ্রনাথের জীবন ও দর্শন এক উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা।