সিলেট পোষ্ট ডেস্ক : তোরে বাঁচাইয়া রাইখ্যা আমি ভুল করছিলাম। তোরে যদি তখন মাইরা ফালাইতাম, তাহলে আইজ আমার এই দশা হইতো না। আমি বরং ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছ থিকা পুরুস্কার পাইতাম। এহনো সময় আছে মামলাডা তুইল্যা নে। আমি তোরে কিছু ট্যাকা-পয়সা দিমুনে।’ এই দম্ভোক্তি বরখাস্তকৃত এক পুলিশ কর্মকর্তার। পরকীয়ার জের ধরে রাজধানীর শেরেবাংলানগরে শাহ আলম নামে এক সিএনজি চালককে সন্ত্রাসী বানানোর চেষ্টা করেছিলেন তিনি।
শাহ আলমকে ধরে নিয়ে দুই পায়ে অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলিও করেছিলেন। ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার দেখিয়েছিলেন অবৈধ একটি অস্ত্র ও তিন রাউন্ড গুলি। কিন্তু পুরো বিষয়টি সাজানো বলে জানতে পারেন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। শেষে নির্মম এই ঘটনার খলনায়ক শেরেবাংলানগর থানার তৎকালীন এসআই আনোয়ারকে গ্রেপ্তার করা হয়।
গুলিবিদ্ধ শাহ আলমের ভাই গোলাম মোস্তফা বাদি হয়ে একটি মামলাও করেন। কিন্তু বেশিদিন কারাগারে থাকতে হয়নি তাকে। জামিনে বেরিয়ে এসে শাহ আলমকে একেবারে মেরে না ফেলা নিজের ভুল ছিল বলে হুমকি দেন তিনি। গতকাল শাহ আলমের সঙ্গে আলাপকালে এসব তথ্য জানান তিনি।
শাহ আলম জানান, তাকে নানা ভাবে ‘ম্যানেজ’ করার চেষ্টা করছে এসআই আনোয়ার। বলছে, ‘আইজ হোক কাইল হোক, টাকা-পয়সা দিয়া চাকরি আমি ফিরা পামুই। তুই আমার কিছু করতে পারবি না। আমি আবার চাকরি ফিরা পাই আর না পাই তর কিন্তু খবর আছে।’
শাহ আলম জানান, সম্প্রতি বাড্ডা এলাকায় সামনা সামনি দেখা হলে আনোয়ার তাকে এসব হুমকি দেয়। তাদের বাসা মোহাম্মদপুর এলাকায় বলে বিষয়টি প্রথমে মোহাম্মদপুরের ওসিকে জানান। কিন্তু ওসি তাদের পরামর্শ দেন যেখানে ঘটনা সেখানে গিয়ে জিডি করার। পরে ভাটারা থানায় গেলে ওসি তাদের একদিন পরে যাওয়ার অজুহাতে জিডি না নিয়ে ফিরিয়ে দেন। শাহ আলম বলেন, আমি এখনও আতঙ্কে থাকি। এবার সন্ত্রাসী দিয়ে এসআই আনোয়ার আমারে খুন করাইতে পারে।
গত বছরের ১৯শে অক্টোবর রাজধানীর মোহাম্মদপুর থানাধীন কৃষি মার্কেট এলাকা থেকে গাড়িচালক শাহ আলমকে একটি মাইক্রোবাসে তুলে নেয় শেরেবাংলানগর থানার তৎকালীন এসআই আনোয়ার হোসেন। গাড়িতে হাত ও চোখ বেঁধে কয়েক ঘণ্টা ঘোরানোর পর মধ্যরাতে আগারগাঁওয়ের তালতলা নিয়ে দুই পায়ে অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি করা হয়। পরে এসআই আনোয়ার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের গোপন সংবাদের ভিত্তিতে অস্ত্র উদ্ধার অভিযানে গেলে কথিত বন্দুকযুদ্ধে শাহ আলম গুলিবিদ্ধ হয় বলে জানায়। ঘটনাস্থল থেকে একটি বিদেশী পিস্তল ও তিন রাউন্ড গুলিও উদ্ধার দেখায়। কিন্তু ঘটনার দুদিনের মাথায় পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপ-কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার জানতে পারেন পুরো ঘটনাটি সাজানো। গোপনে অনুসন্ধান করেও ঘটনার সত্যতা জানতে পারেন। পরে তার নির্দেশে শাহ আলমের ভাই গোলাম মোস্তফা বাদি হয়ে শেরেবাংলানগর থানায় একটি হত্যাচেষ্টা মামলা করেন।
এসআই আনোয়ারকে বরখাস্তের পর পুলিশ তাকে গ্রেপ্তারও করে। এদিকে একই সঙ্গে শাহ আলমের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত অস্ত্র মামলাটিও চলতে থাকে। দুটি মামলাই তদন্ত করে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ ডিবি।
ডিবি সূত্র জানায়, দীর্ঘ অনুসন্ধান শেষে গত ২৭শে ফেব্রুয়ারি মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক হুমায়ূন কবির বরখাস্তকৃত এসআই আনোয়ারের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেন। একই সঙ্গে শাহ আলমের বিরুদ্ধে পুলিশের দায়ের করা মামলাটির ফাইনাল রিপোর্ট দেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা। মামলা থেকে অব্যাহতি পেয়ে এক দিন পর কারাগার থেকে বেরিয়ে আসেন শাহ আলম। তবে অভিযোগপত্র দেয়ার আগেই গত জানুয়ারির ৫ তারিখে কারাগার থেকে জামিনে বেরিয়ে আসেন এসআই আনোয়ার। জামিনে বেরিয়ে আসার পর থেকে মামলা তুলে নেয়ার জন্য শাহ আলম ও তার ভাই গোলাম মোস্তফাকে নানাভাবে দেনদরবার ও চাপ দিতে থাকে আনোয়ার। শাহ আলমের ভাই গোলাম মোস্তফা বলেন, মামলা তুলে নিতে আনোয়ার নানাভাবে চাপ দিয়ে আসছে। একাধিকবার লোকও পাঠিয়েছে। কিন্তু আমরা এই ঘটনার বিচার চাই। এসআই আনোয়ারের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।
এদিকে তদন্ত সূত্র জানায়, শাহ আলমকে সন্ত্রাসী বানানোর চেষ্টায় এসআই আনোয়ার ঘটনাস্থল থেকে যে বিদেশী পিস্তল ও তিন রাউন্ড গুলি উদ্ধার দেখিয়ে সেই অস্ত্র-গুলির উৎস জানতে পারেনি পুলিশ। এসআই আনোয়ারকে একাধিকবার রিমান্ডে নিলেও অবৈধ অস্ত্র-গুলির সন্ধান সম্পর্কে মুখ খোলেনি সে। তবে তদন্ত সংশ্লিষ্টদের ধারণা, কোনও সন্ত্রাসী গ্রুপের কাছ থেকে অস্ত্র ও গুলি সংগ্রহ করেছিল এসআই আনোয়ার। উদ্ধারকৃত অস্ত্রটির গায়ে মেইড বাই জাপান ও ব্যারলে আরমানি লেখা ছিল। অবৈধভাবে এই অস্ত্র সংগ্রহ করতে তার অন্তত ৩০-৪০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। কিন্তু এসব তথ্য স্বীকার করলে ফেঁসে যেতে পারে বলে কৌশলে সব কিছু অস্বীকার করেছে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, এসআই আনোয়ার বিভিন্ন সময় নিজেই মামলার তদন্ত করতো। ফলে আইন-কানুন সম্পর্কে সে আগে থেকেই অবগত। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবির পরিদর্শক হুমায়ুন কবির জানান, অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনাটি সাজানো প্রমাণিত হওয়ায় এসআই আনোয়ারের বিরুদ্ধে নতুন করে একটি অস্ত্র মামলার আবেদন আদালতে করা হয়েছে। আদালত এখনও কোনও নির্দেশনা দেয়নি। আদালত নির্দেশনা দিলে অস্ত্র মামলাটি দায়ের করা হবে।